অধ্যায় ৫
বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ
--------------------------------------
[MCQs]
1. শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-
(a) ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে
(c) ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ✔
(d) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে
2. শান্তিনিকেতনে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন-
2. শান্তিনিকেতনে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন-
(a)প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর
(b) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ✔
(c) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
3. রবীন্দ্রনাথ আশ্রম বিদ্যালয় স্থাপন করেন-
(a) বীরভূমে
(b) শান্তিনিকেতনে ✔
(c) কলকাতায়
(d) শিলাইদহে
4. বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন-
(a) ব্রজেন্দ্রনাথ শীল
(b) বিধুশেখর ভট্টাচার্য
(c) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ✔
5. বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন-
(a) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(b) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ✔
(c)স্বামী বিবেকানন্দ
(d) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
6. শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব হিসেবে পালন করা হয়-
(a) ২৫ বৈশাখ
(b) ২৫ আষাঢ়
(c) ২২ শ্রাবণ ✔
(d) ২২ অগ্রহায়ণ দিনটি
4. নীচের কোন্ ব্যক্তি 'মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়' প্রতিষ্ঠা করেন?
(a) মহেন্দ্রলাল সরকার
(b) তারকনাথ পালিত
(c) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ✔
Short Question Answer
1 *জাতীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে আর্থিক সহায়তা করেন এমন কয়েকজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করো।
উত্তর জাতীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ৫ লক্ষ টাকা, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী ২.৫ লক্ষ টাকা এবং সুবোধচন্দ্র মল্লিক ১ লক্ষ টাকা দান করেন।
2. জাতীয় শিক্ষায় ডন সোসাইটির কী ভূমিকা ছিল?
উত্তর সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ডন সোসাইটি (১৯০২ খ্রিস্টাব্দ)-র কার্যাবলি ও এখান থেকে প্রকাশিত 'ডন' পত্রিকা জাতীয় শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আদর্শবোধ, ধর্মবোধ, নীতিবোধ, জাতীয়তাবোধ, চরিত্রগঠন প্রভৃতির বিকাশে ডন সোসাইটি চেষ্টা চালায়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে (৫ নভেম্বর) সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত বিরাট জনসভায় জাতীয় শিক্ষার পক্ষে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এটি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনের সঙ্গে মিশে গিয়ে জাতীয় শিক্ষাকে আরও সমৃদ্ধ করে।
3. * বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষকের নাম লেখো।
উত্তর বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষক ছিলেন রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকার, হারানচন্দ্র চাকলাদার, সখারাম গণেশ দেউসকর, ধর্মানন্দ কোশাম্বী প্রমুখ।
4. *জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যর্থ হওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করো। অথবা, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যর্থ হওয়ার দুটি কারণ লেখো।
উত্তর জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণগুলি ছি
[1] সরকারি বাধার ফলে জাতীয় শিক্ষার অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
[2] জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরি লাভের সুযোগ ছিল না।
[3] এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি যথেষ্ট আর্থিক সংকটের শিকার হয়।
[4] শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা জাতীয় শিক্ষার চেয়ে বরং ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাকেই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছিলেন।
5. জাতীয় শিক্ষার গুরুত্ব কী ছিল?
উত্তর জাতীয় শিক্ষার প্রধান গুরুত্বগুলি ছিল
[1] এই শিক্ষা ব্রিটিশ সরকারের বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ।
[2] এই শিক্ষা গ্রহণ করে পরবর্তীকালে একদল দেশপ্রেমিক তরুণের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
[3] জাতীয় শিক্ষার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্বাধীন ভারতে শিক্ষাদান ও গবেষণার কাজে যথেষ্ট সাফল্য দেখায়।
6. *কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি কী?
উত্তর কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি হল বাংলার একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট একসঙ্গে মিলে যায় এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নাম হয় কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি।
7. শিশুশিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা কী ছিল?
উত্তর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুমনকে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি চাইতেন বিশ্বপ্রাণের স্পন্দন শিশুমনকে ছুঁয়ে যাক। নৈসর্গিক পরিবেশের মধ্যে শিশুদের বড়ো করে তোলাই তাঁর শিক্ষার লক্ষ্য ছিল।
8. *ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোর বিরুদ্ধে বাংলায় গড়ে ওঠা দুটি উদ্যোগ উল্লেখ করো।
উত্তর ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামোর বিরুদ্ধে বাংলায় গড়ে ওঠা দুটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হল-
[1] ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বদেশি শিক্ষার প্রসারের ব্যবস্থা করা এবং
[2] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা।
9. ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ছিল কেন?
উত্তর ঔপনিবেশিক শিক্ষা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ ছিল, কারণ-
[1] ভারতের চিরাচরিত শিক্ষায় যা কিছু সদর্থক ছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা তা ধ্বংস করে।
[2] ঔপনিবেশিক শিক্ষাকাঠামোয় ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অবহেলা করা হয়।
[3] ইংরেজি ভাষার বাহন এই শিক্ষা ভারতে গণশিক্ষার প্রসারে ব্যর্থ হয়।
[4] এই শিক্ষার মাধ্যমে ইংরেজদের গোলাম করণিক তৈরি এবং খ্রিস্টান ধর্মের প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়।
10. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শিক্ষা কী?
উত্তর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে 'শিক্ষা হল, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন'। এক কথায়, পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিজেকে জাতির 1 উপযোগী, দক্ষ ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার নামই শিক্ষা।
11. *রবীন্দ্রনাথের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য বা কাজ কী?
উত্তর রবীন্দ্রনাথের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য বা কাজগুলি হল-
[1] বিদ্যার উৎপাদন,
[2] বিদ্যা দান,
[3] মুক্ত-চিন্তার চর্চা এবং
[4] সত্যানুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রভৃতি।
12. শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল-
[1] প্রাচীন ভারতের 'তপোবন' কেন্দ্রিক আশ্রমিক শিক্ষাধারা চালু করে নিভৃতে আধ্যাত্মিক সাধনা ও বিদ্যাচর্চা করা।
[2] প্রকৃতির সঙ্গে শিক্ষার্থীর নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলা।
13*কে, কবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন্ কোন্ বিষয় পড়ানো হত?
উত্তর: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বীরভূম জেলার বোলপুরের নিকটবর্তী শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়, অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, পল্লি উন্নয়ন-সহ সমস্ত ব্যাবহারিক বিজ্ঞান পড়ানো হত।
14 *বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা বিদেশি শিক্ষকের নাম লেখো।
উত্তর: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা বিদেশি শিক্ষক ছিলেন ইংরেজ যুবক কৃষিবিশেষজ্ঞ লেনার্ড এলমহার্স্ট, এনড্রজ, পিয়ারসন, খ্যাতনামা ঐতিহাসিক সিলভাঁ লেভি ও তাঁর স্ত্রী মাদাম লেভি। এ ছাড়া জার্মান ঐতিহাসিক উইন্টারনিৎস, তাঁর ছাত্র লেসনি, ব্রিটিশ শিল্পবিশারদ স্টেলা ক্রামরিশ, ইহুদি বহুভাষাবিদ স্লোমিথ ফ্লাউম প্রমুখ।
15 *বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের উন্নতির উদ্দেশ্যে গৃহীত কয়েকটি পদক্ষেপ উল্লেখ করো।
উত্তর: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের উন্নতির উদ্দেশ্যে যেসব যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তা হল -
(1) বিদেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা শিক্ষকদের বিশ্বভারতীতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ,
(2) দেশবিদেশের বহু মূল্যবান গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা গ্রন্থাগারে সংগ্রহ করা এবং
[3] বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান।
16 *বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষার্থীর নাম লেখো।
উত্তর: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষার্থী ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অস্কারবিজয়ী চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি প্রমুখ।
17 *রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর শিক্ষানীতির দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
উত্তর [ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর শিক্ষানীতির দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল-
[1] প্রকৃতি ও মানুষের সান্নিধ্যে শিক্ষাদান এবং
[2] শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন।
18 *রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভাবনা সম্পর্কে কী জান?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন, প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
19 *রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রজাকল্যাণের ক্ষেত্রে কী ধরনের উদ্যোগ নেন?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রজাকল্যাণে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেন। যেমন-
[1] তিনি হিতৈষী তহবিল প্রতিষ্ঠা করে তহবিলের অর্থ গ্রামে রাস্তাঘাট নির্মাণ, মন্দির-মসজিদের সংস্কার, স্কুল- মাদ্রাসা স্থাপন, চাষিদের সহায়তা প্রভৃতি কাজে ব্যয় করেন
[2] তাঁর উদ্যোগে শিলাইদহে মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয় ও পতিসরে হাসপাতাল স্থাপিত হয়,
[3] তিনি কৃষকদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি প্রভৃতি উদ্দেশ্যে নানা উদ্যোগ নেন,
[4] সালিশি সভা গঠন করে গ্রামীণ বিরোধের মীমাংসার ব্যবস্থা করেন।
20. *রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক গঠিত 'হিতৈষী তহবিল' কী?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়ে প্রজাকল্যাণের উদ্দেশ্যে 'হিতৈষী তহবিল' নামে একটি তহবিল গঠন করেন। প্রজাদের সদ্য বকেয়া খাজনার ওপর সামান্য হিতৈষীবৃত্তি ধার্য করে এবং জমিদারি থেকে তার সমপরিমাণ অর্থ ভরতুকি দিয়ে এই তহবিল গঠন করা হয়। গ্রামে রাস্তাঘাট নির্মাণ, মন্দির-মসজিদের সংস্কার, স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপন, চাষিদের বিপদকালে সাহায্যদান প্রভৃতি উদ্দেশ্যে এই তহবিলের অর্থ ব্যয় করা হত।
21. *কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন 'গোলদীঘির গোলামখানা' বলে ব্যঙ্গ করা হত?
উত্তর: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গোলদীঘির নিকটে অবস্থিত ছিল। এখানে পড়াশোনা করে প্রধানত ব্রিটিশদের অফিস-আদালতে কেরানি তৈরি হত। এজন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ এই বিশ্ববিদ্যালয়কে 'গোলদীঘির গোলামখানা' বলে ব্যঙ্গ করতেন।
22 *জাতীয় শিক্ষা পরিষদ কেন প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ যেসব কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেগুলি হল-
[1] জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দান করা,
[2] শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা,
[3] নৈতিক শিক্ষা দান করা,
[4] মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি।
23. *কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী ধরনের
উদ্যোগ নেন?
উত্তর: কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-
[1] শিলাইদহে আদর্শ কৃষিক্ষেত্র স্থাপন করে সেখানে ট্র্যাক্টর, পাম্পসেট ও জৈব সার ব্যবহার চালু করেন।
[2] শিলাইদহে কৃষি খামার গড়ে তোলেন।
[3] পতিসরে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।
[4] উন্নত কৃষিবিদ্যা শেখার উদ্দেশ্যে নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদার ও জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকে বিদেশে পাঠান।
24. * কে, কবে টেগোর অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠা করেন? এর উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে টেগোর অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠা করেন। টেগোর অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে কৃষিজ পণ্য কিনে তা বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করা।
25. গ্রামীণ শিল্প ও বৃত্তি শিক্ষার প্রসারে রবীন্দ্রনাথের অবদান কীরূপ ছিল?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতিশিক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর কাছে এই শিক্ষাই হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশের মাধ্যম। তিনি শান্তিনিকেতনে ও শ্রীনিকেতনে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বৃত্তিশিক্ষায়ও জোর দেন। গ্রামীণ কুটির শিল্প ও হস্তশিল্পের প্রতিও তিনি বিশেষ দৃষ্টি দেন। এবিষয়ে অন্যতম উদাহরণ হল 'আমার কুটির'। তাঁর কাছে গ্রামীণ শিল্প ও বৃত্তিশিক্ষা সাধারণ শিক্ষার অঙ্গস্বরূপ।
26. বিশ্বভারতী কীভাবে গড়ে উঠেছিল?
অথবা, কত খ্রিস্টাব্দে কে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
উত্তর: মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ধর্মচর্চা করার উদ্দেশ্যে ভুবনডাঙ্গায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ভুবনডাঙ্গার স্নিগ্ধতা, নিবিড়তা ও বিরাজমান শান্তি লক্ষ করে দেবেন্দ্রনাথ এর নামকরণ করেন 'শান্তিনিকেতন'। তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি আদর্শ শিক্ষাদান ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে শান্তিনিকেতনে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। সেই মতো তিনি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
27. ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত কী ছিল?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেননি, আবার বর্জনও করেননি। তিনি দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন।
28. শিক্ষা সত্র কী?
উত্তর: শিক্ষা সত্র হল গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বীরভূমের শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত একটি বিদ্যালয়। এটি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে শ্রীনিকেতনে স্থানান্তরিত হয়।
29. রবীন্দ্রনাথ কী উদ্দেশ্যে 'শ্রীনিকেতন' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
অথবা, শ্রীনিকেতন কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো। এর মধ্যে ছিল গ্রামে কৃষির উন্নতিসাধন, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ প্রতিরোধ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি করা প্রভৃতি। এই উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতনে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে 'পল্লিসংগঠন কেন্দ্র' স্থাপিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেন শ্রীনিকেতন।
VERY SHORT ANSWER QUESTION
1. জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে গড়ে ওঠা অন্যতম কলেজটির নাম লেখো।
» জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে গড়ে ওঠা অন্যতম কলেজটির নাম বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ।
2. কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি নিযুক্ত হন?
>> রাসবিহারী ঘোষ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি নিযুক্ত হন।
3. কে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন?
» রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
4. কবে, কোথায় প্রথম জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়?
» ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর রংপুরে প্রথম জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
5. কোথায় প্রথম 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ' গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়?
» ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর পার্ক স্ট্রিটের এক সভায় প্রথম 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ' গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
6. কত জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়?
>> ৯২ জন সদস্য নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়।
7. রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কীরূপ পরিবেশে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন?
>> রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
Long Question Answer
1.জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট আলোচনা করো।
উত্তর: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
ভূমিকা: ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education বা NCE) প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ছিল ।
নিম্নরূপ:
[1] বয়কট আন্দোলন: লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ করলে এর বিরুদ্ধে বয়কট আন্দোলন শুরু হয়। জাতীয় নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে 'গোলদীঘির গোলামখানা' বলে ব্যঙ্গ করে ছাত্রদের এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার আহ্বান জানান। কারণ, দীঘির সন্নিকটে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানত ব্রিটিশদের অফিস-আদালতের কেরানিই তৈরি করত।
[2] শিক্ষাক্ষেত্রে বিকল্প উদ্যোগ: স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে বিদেশি সবকিছু বয়কট করে এর বিকল্প হিসেবে দেশীয় জিনিসপত্রের ব্যবহার শুরু হয়। বিভিন্ন শিক্ষাবিদ বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিহোর স্বদেশি ধাঁচের একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। সম্ভবত প্রসন্নকুমার ঠাকুরই সর্বপ্রথম 'জাতীয় শিক্ষা' কথাটি ব্যবহার করেন।
[3] জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ব্যাপ্তি: স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলায় জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর পার্ক স্ট্রিটে ১৫০০ জন প্রতিনিধি নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে স্বদেশি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ' গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
[4] জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠন: এইরকম পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে স্বদেশি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ ৯২ জন সদস্য নিয়ে 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ' প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার: বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় আদর্শ অনুসারে শিক্ষাদানের কথা ভাবছিলেন। সেই সময় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারে 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ' (১৯০৬) গঠিত হওয়ার সুযোগ আসে এবং এই পরিষদ জাতীয় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
2 *জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে জাতীয় নেতৃবৃন্দের উদ্যোগ কীরূপ ছিল?
উত্তর: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় শিক্ষার অগ্রগতি
ভূমিকা: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে এদেশে স্বদেশি শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই বিষয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেন।
[ 1] ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা: দেশীয় নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতায় সরব হন ও বিকল্প স্বদেশি ধাঁচের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। সম্ভবত 'জাতীয় শিক্ষা' কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর।
[2] বিকল্প সংস্থা গঠন: সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে (১১ মার্চ) ৯২ জন সদস্য নিয়ে 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ' গড়ে ওঠে। এই পরিষদের প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল-জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দান করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা, নৈতিক শিক্ষা দান করা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি।
[3] আর্থিক সহায়তা লাভ: জাতীয় শিক্ষা ও জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কাজকর্মের প্রসারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা করেন এই ব্যাপারে ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ৫ লক্ষ টাকা, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী ২.৫ লক্ষ টাকা এবং সুবোধচন্দ্র মল্লিক ১ লক্ষ টাকা দান করেন।
[4] বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ গঠন: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ-এর অধীনে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকার, হারানচন্দ্র চাকলাদার, সখারাম গণেশ দেউসকর, ধর্মানন্দ কোশাম্বী প্রমুখ খ্যাতনামা শিক্ষকগণ এখানে শিক্ষাদান করতেন।
[5] বহু জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: দেশীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ-এর উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়।
উপসংহার: বাংলার তৎকালীন জাতীয় নেতৃবৃন্দ একদিকে বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতায় সরব ছিলেন, অন্যদিকে স্বদেশি শিক্ষার প্রচলনে ও অর্থনৈতিক তহবিল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
3 *জাতীয় শিক্ষার প্রসারে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা কেমন ছিল?
উত্তর: জাতীয় শিক্ষার প্রসারে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা
ভূমিকা: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্বদেশি বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে গড়ে-ওঠা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ জাতীয় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
[1] উদ্দেশ্য: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা দান করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশসেবার মনোভাব জাগিয়ে তোলা, নৈতিক শিক্ষা দান করা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি।
[2] বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা: স্বদেশি প্রথায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকার, হারানচন্দ্র চাকলাদার, সখারাম গণেশ দেউসকর, ধর্মানন্দ কোশাম্বী প্রমুখ খ্যাতনামা শিক্ষকরা এখানে শিক্ষাদান করতেন।
[3] বহু জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রেরণায় বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট। বিভিন্ন ধনবান ব্যক্তির আর্থিক সহায়তায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি নিযুক্ত হন রাসবিহারী ঘোষ।
[4] সামাজিক অবদান: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে
বহু শিক্ষার্থী স্নাতক হয়ে পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে। এসব প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ছাত্রসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি ছিলেন অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন হীরালাল রায় ও উপেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ।
উপসংহার: 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ' শহর ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এই পরিষদ জাতীয় আদর্শ অনুসারে শিক্ষাদান, পাঠ্যসূচি নির্মাণ, আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি উদ্যোগ গ্রহণ করে।
4. *জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগ এবং জাতীয় শিক্ষার প্রসার কেন ব্যর্থ হয়?
উত্তর: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগ এবং জাতীয় শিক্ষার প্রসার ব্যর্থ হওয়ার কারণ
ভূমিকা: লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা প্রদেশ দ্বিখন্ডিত করলে এই সময় বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে নেতৃবৃন্দ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতে স্বদেশি ধাঁচে জাতীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই উদ্যোগ বিভিন্ন কারণে অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। যেমন-
[1] সরকারের বিরূপতা: ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে-ওঠা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ও জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকার মোটেই সুনজরে দেখেনি। সরকারি প্রতিবন্ধকতার ফলে স্বদেশি ধাঁচে গড়ে-ওঠা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতি পদে পদে ব্যাহত হয়েছে।
[2] কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনা: সরকার তার নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়নি। এজন্য জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে ডিগ্রি পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে সরকারি চাকরি লাভ করার সুযোগ একেবারেই ছিল না। ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের শিক্ষার্থীরা জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে।
[3] আর্থিক সংকট: প্রথমদিকে অনেক উৎসাহ ও আশা নিয়ে জাতীয় শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ শুরু হলেও কিছুকাল পর থেকে আর্থিক সংকটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির কাজকর্ম ব্যাহত হতে থাকে। সূচনা লগ্নে বহু আর্থিক দান পাওয়ার আশা থাকলেও অনেকাংশেই তা পূরণ হয়নি।
[4] অভিভাবকদের অনীহা: বেশিরভাগ অভিভাবক ও শিক্ষার্থী জাতীয় শিক্ষার চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা গ্রহণেই বেশি আগ্রহী ছিল। ফলে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে বঙ্গভঙ্গ- বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন দুর্বল হতে শুরু করলে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাও ক্রমে ব্যর্থ হতে থাকে।
উপসংহার: প্রবল প্রত্যাশা নিয়ে 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ' গঠিত হলেও কিছুকালের মধ্যেই এই পরিষদের উদ্যোগ এবং জাতীয় শিক্ষার প্রসার অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলি ছিল জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের বিমাতৃ সুলভ আচরণ, সরকারি কর্মক্ষেত্রে এখানকার শিক্ষার্থীদের প্রতি বঞ্চনা, তীব্র অর্থনৈতিক সংকট প্রভৃতি।
5. *শিক্ষা সংক্রান্ত ঔপনিবেশিক ধারণার বিরোধিতায় গৃহীত কয়েকটি উদ্যোগের উল্লেখ করো।
উত্তর: শিক্ষা সংক্রান্ত ঔপনিবেশিক ধারণার বিরোধিতায় গৃহীত কয়েকটি উদ্যোগ
ভূমিকা: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে এদেশে আধুনিক শিক্ষার বিকাশ ঘটেনি। ব্রিটিশ সরকার এদেশে সুপরিকল্পিতভাবে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটায়। তবে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে বহু ভারতীয় মনীষী এর বিকল্প হিসেবে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারে উদ্যোগী হন।
[1] জাতীয় শিক্ষার উদ্যোগ: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন শুরু হলে এদেশে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধিতা করে স্বদেশি ধাঁচে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ গৃহীত হয়। এর জন্য ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গড়ে তোলা হয়।
[2] 'গোলদীঘির গোলামখানা' পরিত্যাগ: জাতীয় নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে 'গোলদীঘির গোলামখানা' বলে ব্যঙ্গ করে ছাত্রদের এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার আহ্বান জানান। কারণ, গোলদিঘি বা কলেজ স্কোয়ারের কাছে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা না দিয়ে শুধু ব্রিটিশদের অফিস-আদালতে কাজের জন্য কেরানি তৈরি করত। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু ছাত্রছাত্রী সেই 'গোলামখানা' ছেড়ে জাতীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করে।
[3] রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগ: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিকল্প শিক্ষানীতি দেশবাসীকে এক নতুন দিশা দেখাতে সমর্থ হয়। নিজস্ব শিক্ষানীতি নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো এবং ব্রিটিশ শিক্ষানীতির বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি বীরভূমের শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
উপসংহার: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনার ফলে স্বদেশি যুগে ভারতে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর ফলে ভারতীয় শিক্ষা কিছুকালের মধ্যে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ত্যাগ করতে সক্ষম হয়।
6 *রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতীর উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা
করো।
অথবা, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে টীকা লেখো।
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতীর উদ্যোগ/ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭- ১৯০৫ খ্রি.) নিভৃতে ধর্মচর্চা করার উদ্দেশ্যে বীরভূম জেলার বোলপুরের নিকটবর্তী ভুবনডাঙ্গায় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভুবনডাঙ্গার নতুন নাম দেন 'শান্তিনিকেতন'। দেবেন্দ্রনাথ ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে এখানে উপাসনা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
[1] ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে একটি ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম ৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়। এখানে প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়।
[2] শিক্ষাপদ্ধতি: ব্রহ্মবিদ্যালয়ে আশ্রমিক গুরুকুল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে এবং ছাত্র- শিক্ষকের ব্যবধান দূর করে শিক্ষাদান করাই ছিল ব্রহ্মবিদ্যালয়ের শিক্ষানীতির মূলকথা। এখানে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকত না।
[3] বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভাবনা: পাঠভবনের প্রবর্তিত শিক্ষানীতিতে একটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ উদ্যোগ নেন। তিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে শুরু করেন, যার নাম হয় 'বিশ্বভারতী'।
[4] বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: অবশেষে রবীন্দ্রনাথ বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের সন্নিকটে শান্তিনিকেতনে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে কলাবিদ্যার পাশাপাশি অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, পল্লি উন্নয়ন-সহ বিভিন্ন ব্যাবহারিক শিক্ষার পাঠদান শুরু হয়।
[5] পর্যটন শিল্পকেন্দ্র: রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নিজের এবং অন্যান্য আশ্রমিকদের বসবাসের জন্য সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরি করান। পরবর্তীকালে আশ্রমবাসী শিল্পী ও ভাস্করদের বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মের দ্বারা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সুসজ্জিত হয়ে একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়।
[6]কেন্দ্রীয় মর্যাদা: ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।
উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বধর্ম ও বিশ্বসংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
7. *রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনায় মানুষ সম্পর্কে কী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনায় মানুষ
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে তাঁর শিক্ষাচিন্তার বিষয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। তাঁর শিক্ষাভাবনায় মানুষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। তিনি শিক্ষাভাবনার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
[1] মানুষের দুর্দশা দূর করা: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দিলে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম গ্রামের সাধারণ মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পান। তিনি উপলব্ধি করেন, গ্রামই হল ভারতের প্রাণ, গ্রামের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবে না। এজন্য তিনি গ্রাম সংগঠনের মাধ্যমে পল্লিমঙ্গল সাধনের উদ্যোগ নেন।
[2] কৃষির উন্নতি: রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন, গ্রামের মানুষের কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকার উন্নতি না হলে তাদের প্রকৃত উন্নতি হবে না। এজন্য গ্রামের কৃষিবিদ্যার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকায় পাঠান। পরে জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকেও তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বিদেশে কৃষিবিদ্যা পড়ার জন্য পাঠান। রথীন্দ্রনাথ, তাঁর বন্ধু ও নগেন্দ্রনাথ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে ফিরে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষবাস এবং বীজ, সার, সেচ প্রভৃতির ব্যবহার শুরু করেন।
[3] কুটিরশিল্পের বিকাশ: রবীন্দ্রনাথ গ্রামের মানুষের মধ্যে কুটিরশিল্পের প্রসারের বিষয়েও চিন্তাভাবনা করেন। তিনি একজন তাঁতিকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে সেখানকার দরিদ্র মানুষকে তাঁতের কাজ শিখতে উৎসাহিত করেন। এ ছাড়া মৃৎশিল্প-সহ বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের প্রসার ঘটানোর বিষয়েও তিনি চিন্তাভাবনা করেন।
[4] শিক্ষার প্রসার: গ্রামের মানুষের অজ্ঞতা দূর করার উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো অত্যন্ত জরুরি বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। তাঁর মতে, গ্রামের মানুষের সেবা করতে হলে তাদের সম্পর্কে আগে শিক্ষালাভ করতে হবে। গ্রামের মানুষের মধ্যেও শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
[5] সম্প্রীতির প্রসার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন। সম্ভাব্য সংঘাতের অনুমান করেও তিনি হিন্দু-মুসলমান-ব্রাহ্মণ-চণ্ডালের বিভেদ দূর করে কর্মক্ষেত্রে প্রাণচঞ্চলতা নিয়ে আসার কথা বলেন। তিনি বলেন, "সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে।" এই সাহা ও শেখ কোনো বিশেষ সম্প্রদায় ছিল না। তারা হল আসলে 'আমলা' ও 'চাষা'।
উপসংহার: কোনো শিক্ষাই মানুষকে বাদ দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তাই রবীন্দ্রনাথ সকল মানুষকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে এসে বিভিন্ন মানুষের মধ্যেকার বিরাট ব্যবধান দূর করতে চেয়েছিলেন।
৪ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ কী ছিল?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শিক্ষাকে যেমন দেখেছিলেন, তার কয়েকটি দিক-
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিতে "শিক্ষা হল, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন।” কিন্তু তাঁর আমলে ভারতে যে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা রবীন্দ্রনাথের মনঃপুত হয়নি। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপকে তিনি ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছেন।
[1] যান্ত্রিক ব্যবস্থা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছেন। তাঁর কাছে শিক্ষাপ্রদানের ঔপনিবেশিক স্কুল-ব্যবস্থা একটি কারখানার মতো। তিনি বলেছেন, "ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল, মাস্টার এই কারখানার অংশ-চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়।"
[2] নীরস বিষয়: ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় চার দেয়ালের ভেতর শিক্ষাগ্রহণ রবীন্দ্রনাথের কাছে নীরস ঠেকেছে। তাঁর মতে, এই ব্যবস্থায় শিক্ষাগ্রহণ আসলে নীরস পাঠ্যবস্তু গ্রহণ করে শুধুমাত্র ডিগ্রি অর্জন ছাড়া আর কিছু নয়।
[3] সীমিত সুযোগ: রবীন্দ্রনাথের মতে, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ কম। কারণ, এই ব্যবস্থায় কেবল শহরের একটা শ্রেণির মানুষ শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে। আর ভারতের অবশিষ্ট জনমানব অশিক্ষার অন্ধকারেই থেকে যায়।
[4] প্রগতি বিরোধী পদ্ধতি: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি অন্যতম দিক ছিল বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ। তাই এই ব্যবস্থা প্রগতিশীলতার বিরোধী। কেন-না, রবীন্দ্রনাথের মতে, বিদেশি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল চিন্তাধারা আত্মস্থ করার কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
[5] জ্ঞানার্জনের প্রতিবন্ধক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাই শিক্ষার্থীর সহজাত জ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারে। তাই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান শিক্ষার্থীর স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বলে তিনি মনে করতেন।
[6] জ্ঞানভিক্ষার কেন্দ্র: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে জ্ঞানভিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় মর্যাদাকে বাদ দিয়ে পাশ্চাত্যর ধার করা বিদ্যাকে অনুকরণ করাই যেন প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'শিক্ষা সমস্যা', 'শিক্ষার হেরফের', 'স্বদেশি সমাজ', 'তোতাকাহিনী' প্রভৃতি রচনায় ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার নানান ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরে তার সমালোচনা করেছেন। তিনি ভারতের ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি থেকে পৃথক শিক্ষানীতি প্রবর্তনের বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছেন। পরবর্তীকালে নিজ উদ্যোগে তিনি দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
9. বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তার পরিচয় দাও।
উত্তর:বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তা
ভূমিকা: প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত-এ কথা রবীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁর শিক্ষাভাবনায় প্রকৃতি ও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাঁর শিক্ষা ভাবনার এই বৈশিষ্ট্যটি বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
[1] বিশ্ববিদ্যার সাধনা: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যা সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, "বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র। সাধারণভাবে বলা চলে সে সাধনা বিদ্যার সাধনা।' তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য হল বিদ্যা উদ্ভাবন, গৌণ উদ্দেশ্য হল বিদ্যা দান।
[2] শিক্ষার অবারিত দ্বার: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। দেশবিদেশের সকল পণ্ডিত ও শিক্ষার্থীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যা সাধনার সুযোগ পায়, রবীন্দ্রনাথ তা নিশ্চিন্ত করতে চেয়েছিলেন।
[3] পাঠক্রমের বৈচিত্র্য: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে বৈচিত্র্য আনার পক্ষপাতী ছিলেন। এজন্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি ভবন, চিনা ভবন, কৃষি অর্থনৈতিক গবেষণাকেন্দ্র, পল্লি শিক্ষাভবন প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা হয়। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে দেশবিদেশের বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত এখানে শিক্ষকতা করতে আসেন।
[4] মানবসত্তার বিকাশ: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে মানুষের মানবসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে তাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা।'
উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ নিজে এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা পোষণ করতেন যেখানে মুক্তচিন্তা, সত্যানুসন্ধান, স্বাধীনতা প্রভৃতির দ্বারা মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠবে। তাঁর এই ভাবনা বাস্তবায়িত হয়ে উঠেছিল তাঁর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে।
Editing By:- Lipi Medhi