অধ্য়ায়-৩

প্রতিরোধ ও বিদ্রোহঃ
বৈশিষ্ট্য় ও বিশ্লেষণ
-------------------------------------------------

TOPIC    আদিবাসী বিদ্রোহ

ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

১. বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব বলতে কী বোঝ?

উত্তরঃ বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব-

ভূমিকা: ইতিহাসের আলোচনায় আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ধারা হল 'বিদ্রোহ', 'অভ্যুত্থান' ও 'বিপ্লব'। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে শোষক ও অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ জনগোষ্ঠী প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। এই প্রতিবাদ বা ক্ষোভের প্রকাশ বিভিন্ন 'বিদ্রোহ' বা 'অভ্যুত্থান' বা 'বিপ্লব'-এর মাধ্যমে হতে পারে। 'বিদ্রোহ', 'অভ্যুত্থান' ও 'বিপ্লব'-এর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। যেমন-

[i] বিদ্রোহ কী?: বিদ্রোহ বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে বিরোধী জনসমষ্টির আন্দোলন।বিদ্রোহ স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। বিদ্রোহ সফল হলে পূর্বতন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন সম্ভব।

[ii] উদাহরণ: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে রংপুর বিদ্রোহ, পাবনা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ প্রভৃতি কৃষকবিদ্রোহ এবং সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) প্রভৃতি হল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। বিদ্রোহের গতি অনেক সময় থেমে যায়। যেমন, রংপুর বিদ্রোহের মতো ঘটনায় আগে প্রচলিত ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আবার নীল বিদ্রোহের পর সরকার নীল কমিশন নিয়োগ করে নীলচাষিদের ওপর অত্যাচার লাঘবের ব্যবস্থা করে।

[2] অভ্যুত্থান

[i] অভ্যুত্থান কী?: অভ্যুত্থান বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের সংগ্রাম। অভ্যুত্থান দীর্ঘমেয়াদী হয় না। অভ্যুত্থান সাধারণত খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। অভ্যুত্থানে বিরোধী গোষ্ঠীর ভূমিকা থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে। তবে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টি 'অভ্যুত্থান'-এ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

[ii] উদাহরণ: [a] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একাংশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ সংঘটিত করে। [৮] ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নৌসেনাদের নৌবিদ্রোহ সম্পন্ন হয়। [c] স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাপতি মহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। এগুলি অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তবে এগুলি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

[3] বিপ্লব

[i] 'বিপ্লব' কী?: 'বিপ্লব' বলতে বোঝায় প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন। 'বিপ্লব' হল 'বিদ্রোহ' এবং 'অভ্যুত্থান'-এর চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক।

[ii] উদাহরণ: [a] অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের দ্বারা ইউরোপের শিল্পব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। [b] ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা ফ্রান্সের পূর্বতন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্রুত ও আমূল পরিবর্তন ঘটে। বিদ্রোহকে আবার বিপ্লবের প্রাথমিক ধাপ বলা যায়।
উপসংহার: 'বিদ্রোহ', 'অভ্যুত্থান' ও 'বিপ্লব'-এই তিনটি বিষয়কে অনেক সময়ই সুস্পষ্টভাবে পৃথক করা মুশকিল হয়ে পড়ে। কারণ, একই গণবিক্ষোভ বা আন্দোলনকে কেউ কেউ 'অভ্যুত্থান' আবার কেউ কেউ 'বিদ্রোহ' হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- [1] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে কেউ কেউ 'বিদ্রোহ', 'আবার কেউ কেউ 'অভ্যুত্থান' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। [2] ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেউ কেউ 'গণবিদ্রোহ' আবার কেউ কেউ 'গণ অভ্যুত্থান' বলে বর্ণনা করে থাকেন।

2. চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ ও প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো। অথবা, চুয়াড় বিদ্রোহের বিবরণ দাও।

উত্তরঃ চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ ও প্রসার

ভূমিকা: ভারতের আদিবাসী চুয়াড় বা চোয়াড় জনগোষ্ঠী বাংলার বর্তম মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ ও বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংস বসবাস করত। তারা কৃষিকাজ ও পশুশিকারের পাশাপাশি স্থানী জমিদারদের অধীনে পাইক বা সৈনিকের কাজ করত। জমিদারের কাজে বিনিময়ে তারা কিছু নিষ্কর জমি ভোগ করত। এই চুয়াড়রা ইংরেজনে শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা চুয়াড় বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

[1] দুটি পর্ব: চুয়াড় বিদ্রোহ অন্তত তিন দশক ধরে চলে। এই বিদ্রেহ দুটি পর্বে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

[i] প্রথম পর্ব: প্রথম পর্বের বিদ্রোহ ১৭৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে শুর হয়।

[ii] দ্বিতীয় পর্ব: দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৯৮-১৯ খ্রিস্টাব্দে।

[2] প্রথম পর্বের বিদ্রোহের কারণ: প্রথম পর্বের চুয়াড় বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল-

[i] জীবিকা সমস্যা: ব্রিটিশ কোম্পানি চুয়াড়দের অধিকাংশ জমিজমা কেড়ে নিলে তাদের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে।

[ii] রাজস্ব বৃদ্ধি: কোম্পানি চুয়াড়দের কৃষিজমির ওপর রাজস্বের হার যথেষ্ট বাড়িয়ে দেয়।

[iii] অত্যাচার: রাজস্ব আদায়কারী ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর চুয়াড়দের ওপর চরম অত্যাচার চালাতে শুরু করে।

[3] প্রথম পর্বের বিদ্রোহ: ঘাটশিলায় ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চুয়াড়রা এই বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয়। শেষপর্যন্ত চুয়াড়রা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এরপর ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে তারা ধাদকার শ্যামগঞ্জনের নেতৃত্বে আবার বিদ্রোহ শুরু করে। কিন্তু এই বিদ্রোহও ব্যর্থ হয়।

[4] দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহের কারণ: দ্বিতীয় পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহের (১৭৯৮-৯৯ খ্রি.) বিভিন্ন কারণ ছিল-

[i] নির্যাতন: ব্রিটিশ সরকার ও তাদের কর্মচারীরা আদিবাসী চুয়াড এবং স্থানীয় জমিদারদের ওপর নির্যাতন শুরু করে।

[ii] জমি থেকে উৎখাত: প্রথম পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে ইংরেজরা দরিদ্র চুয়াড়দের জমির মালিকানা বাতিল করে তাদের জমি থেকে উৎখাত করে।

[iii] পেশা থেকে বিতাড়ন: সরকার বহু চুয়াড়কে তাদের পাইকের পেশা থেকে বিতাড়িত করে।

[iv] রাজস্ব বৃদ্ধি: জমিদারদের ওপর রাজস্বের পরিমাণ যথেষ্ট। বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব কারণে জমিদার। বও চুয়াড় হয়। কৃষকরা ক্ষুষ

[5] দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহ: জঙ্গলমহল-সহ মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে বাঁকুড়ার রায়পুরের জমিদার দুর্জন সিং, মেদিনীপুরের রানি শিরোমণি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাঁরা বিভিন্ন জমিদার ও আদিবাসী চুয়াড়দের বিদ্রোহে শামিল করতে সক্ষম হন। প্রায় ১৫০০ অনুগামী নিয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং চুয়াড়রা প্রায় ৩০টি গ্রামে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্রোহে অসামান্য অবদানের জন্য রানি শিরোমণি 'মেদিনীপুরের লক্ষ্মীবাই' নামে পরিচিত হন।

[6] বিদ্রোহের অবসান: প্রবল বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ পুলিশ ও কর্মচারীরা বিদ্রোহের মূলকেন্দ্র রায়পুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু শীঘ্রই পরিস্থিতি পালটে যায়। সশস্ত্র ব্রিটিশ সেনা এসে বিদ্রোহী জমিদার ও আদিবাসী চুয়াড়দের পরাজিত করে। রানি শিরোমণিকে হত্যা এবং দুর্জন সিংকে গ্রেফতার করা হয়। এর ফলে বিদ্রোহ থেমে যায়।

উপসংহার: চুয়াড় বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল লক্ষ করা যায়। যেমন- [1] ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে পশ্চাৎপদ চুয়াড়রা বিদ্রোহ শুরু করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। [2] এই বিদ্রোহে জমিদার ও কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহে শামিল হয়। [3] চুয়াড়দের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সরকার এখানকার শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটায়। বিষ্ণুপুর শহরটিকে কেন্দ্র করে দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল নামে একটি বিশেষ জেলা গঠন করা হয়।

3. সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তরঃ সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল-

ভূমিকা: ভারতের প্রাচীন বাসিন্দা সাঁওতাল উপজাতি ব্রিটিশ সরকার, তাদের সহযোগী জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) করেও শেষপর্যন্ত পরাজিত হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের ফলাফলগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঐতিহাসিক ড. কালীকিঙ্কর দত্ত বলেন যে, এই বিদ্রোহ বাংলা ও বিহারের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে।

[1] সোচ্চার প্রতিবাদ: এই বিদ্রোহের মাধ্যমে সাঁওতালরা ইংরেজ আশ্রয়পুষ্ট জমিদার ও মহাজনশ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুর করে। তাদের সোচ্চার প্রতিবাদ ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে প্রেরণা দিয়েছিল।

[2] অন্য বর্ণের মানুষের যোগদান: সাঁওতাল বিদ্রোহ কেবল সাঁওতালদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
সাঁওতাল বিদ্রোহে বিভিন্ন নিম্নবর্ণের মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে।

[3] প্রেরণা: সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে চাষিদের বিদ্রোহের আগুন থেমে যায়নি। পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গরিব ও নিম্নবর্ণের সাঁওতালদের এই বিদ্রোহ প্রেরণা জুগিয়েছিল। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজের মতে, “সাঁওতাল বিদ্রোহ আপসহীন গণসংগ্রামের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।"

[4] সরকারি নমনীয়তা: বিদ্রোহের পর সরকার সাঁওতালদের প্রতি কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে। [i] সাঁওতালদের পৃথক 'উপজাতি' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং সাঁওতাল-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামে জেলা গঠন করা হয়। [ii] ঘোষণা করা হয় যে, সাঁওতাল পরগনায় ব্রিটিশ আইন কার্যকর হবে না। [iii] সাঁওতালদের ওপর ঋণের সুদের হার বেঁধে দেওয়া হয়। [iv] সাঁওতাল পরগনায় ইউরোপীয় মিশনারি ছাড়া অন্যদের প্রবেশ এবং বাঙালি মহাজনদের বসবাস নিষিদ্ধ হয়। এভাবে ভারতীয় জনজীবন থেকে সাঁওতালরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

[5] খ্রিস্টধর্মের প্রসার: সাঁওতাল-অধ্যুষিত অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সাঁওতালদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে তাঁদের মনে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্যবোধ জাগরিত করেন।

[6] মহাবিদ্রোহের পদধ্বনি: সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পদধ্বনি। এই বিদ্রোহে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। পরবর্তীকালে সংঘটিত সিপাহি বা মহাবিদ্রোহে তা সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়। সুপ্রকাশ রায় বলেন, "এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিয়াছিল এবং ইহা ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূতস্বরূপ।"

[7] স্বাধীনতা সংগ্রাম: ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, যদি ১৮৫৭- এর মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে মনে করা হয়, তবে সাঁওতালদের এই সুকঠিন সংগ্রামকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত।

[৪] বীরত্ব: সাঁওতাল বিদ্রোহে দরিদ্র কৃষকদের স্বাধীনতা লাভ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা লক্ষ করা যায়। সাঁওতালরা সশস্ত্র ইংরেজ বাহিনীর সামনে তিরধনুক, বর্শা, কুড়ল প্রভৃতি নিয়ে যে বীরত্ব দেখিয়েছিল তা পরবর্তীকালে আন্দোলনকে উৎসাহিত করে। 

উপসংহার: সাঁওতাল বিদ্রোহে ইংরেজরা খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে সাঁওতালরা যাতে আর বিদ্রোহ করতে না পারে, সেজন্য তাদের দুর্বল করে রাখার চেষ্টা করা হয়। উপযুক্ত শিক্ষা, শিল্প ও বাণিজ্যের সুযোগ না দিয়ে সরকার তাদের অনুন্নত করে রাখার ব্যবস্থা করেন। ফলে বিদ্রোহের পরও সাঁওতালদের অসন্তুষ্টি থেকেই যায়।

4 ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রবর্তনে ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য কী ছিল? এই আইন প্রবর্তনের ফলে আদিবাসীদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

উত্তরঃ ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রবর্তনের উদ্দেশ্য-

ভূমিকা: ব্রিটিশ সরকার ভারতের অরণ্যগুলির ওপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে শুরু করে এবং ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে পৃথক দুটি অরণ্য আইন প্রবর্তন করে। এই আইন প্রবর্তনে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল।

[1] আর্থিক সমৃদ্ধি: ব্রিটিশ সরকার দেশীয় আদিবাসীদের অধিকার ধ্বংস করে ভারতের সুবিস্তৃত অরণ্যগুলির কাঠ ও অন্যান্য বনজ সম্পদ একচেটিয়াভাবে হস্তগত করার উদ্যোগ নেয়। এভাবে নিজের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির উদ্দেশ্য সরকার অরণ্য আইন প্রবর্তন করে।

[2] রেলপথ নির্মাণ: ব্রিটিশ সরকার এদেশে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দ্রুত ও ব্যাপক রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। রেলপথ এবং রেলের কামরা নির্মাণের জন্য যে প্রচুর পরিমাণ কাঠের প্রয়োজন ছিল তা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সরকার এদেশের অরণ্যগুলির ওপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।

[3] জাহাজ নির্মাণ: ব্রিটিশ সরকার এদেশে সীমান্ত সুরক্ষা এবং ব্রিটেনের জন্য প্রয়োজনীয় জাহাজ নির্মাণের কর্মসূচি নেয়। জাহাজ নির্মাণের জন্য যে প্রচুর পরিমাণ কাঠের প্রয়োজন ছিল তা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সরকার অরণ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন করে।

[4] বিনোদন: বনাঞ্চলে শিকার করা ছিল এদেশের ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ, রাজকর্মচারী এবং তাদের অনুগত দেশীয় রাজাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। বনাঞ্চলে এই শিকারের বিষয়টি অবাধ করার উদ্দেশ্যে সরকার অরণ্য আইন প্রবর্তনের প্রয়োজন বোধ করে।

আদিবাসীদের প্রতিক্রিয়া

ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের একটি বড়ো অংশই অরণ্যের কাঠ, ফলমূল ও অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ, পশুশিকার প্রভৃতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। ব্রিটিশ সরকার উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে অরণ্য আইন প্রবর্তন করে আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিলে আদিবাসীদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

[1] সম্পর্কের অবনতি: ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার প্রথমদিতে সাম্পানেভাবে আদিবাসীদের সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরোধ ছিল না। কি পরবর্তীকালে সরকার অরণ্যের অধিকার থেকে আদিবাসীসে বঞ্চিত করলে সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

[2] আদিবাসী বসতির পরিবর্তন: ব্রিটিশদের হাতে অরণের অধিকার হারানোর ফলে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকায় ব্যাফায় ঘটে। ফলে তারা অনেকেই অরণ্য অঞ্চল ছেড়ে অন্য কোনো কাজে উদ্দেশ্যে দূরবর্তী নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

[3] সাঁওতাল বিদ্রোহ: সাঁওতাল বিদ্রোহের (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) অন্যা কারণ ছিল আদিবাসী সাঁওতালদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া সরকার সাঁওতালদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিলে তারা সিং কানু, চাঁদ, ভৈরব, বীর সিং, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখে নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে।

[4] মুন্ডা বিদ্রোহ: আদিবাসী মুন্ডা বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও অরণের অধিকার কেড়ে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। অরণ্যের অধিক হারিয়ে মুন্ডারা ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এক শক্তিশালী বিদ্রের শুরু করে যা 'উলঘুলান' নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের প্রধান নেয়া ছিলেন বিরসা মুন্ডা।

উপসংহার: অরণ্য ছাড়া আদিবাসী উপজাতিরা ছিল মাতৃহারা শিশুর মতোই অসহায়। তাই আদিবাসী উপজাতিদের থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিলে তারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল। এসব বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহগুলি নিঃসন্দেহে কোম্পানি সরকারকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলেছিল।

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1 ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে সংঘটিত বিভিন্ন কৃষক ও আদিবাসী বিদ্রোহের প্রধান কারণ কী ছিল?

উত্তরঃ ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে সংঘটিত কৃষক ও আদিবাসী বিদ্রোহের কারণ
ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের কৃষক ও উপজাতি গোষ্ঠীর ওপর সরকার এবং তাদের সহযোগী জমিদার ও মহাজন শ্রেণির শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন ও বিদ্রোহ শুরু হয়। এসব আন্দোলন বা বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল নিম্নরূপ- 

[1] ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃষকদের ওপর ভূমিরাজস্বের বোঝা বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে দিলে কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে যায়।

[2] ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থা: ইংরেজরা ভারতের চিরাচরিত আইনকানুন ও বিচারব্যবস্থা বাতিল করে তাদের নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা চালু করে। ভারতীয় সমাজে এরূপ বিদেশি হস্তক্ষেপে দেশবাসী ক্ষুদ্ধ হয়।

[3] চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ত্রুটি: সরকার প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩ খ্রি.) ফলে কৃষকরা তাদের জমির মালিকানা হারায় এবং জমির মালিকানা চলে যায় একশ্রেণির নতুন জমিদারদের হাতে। তারা নিজের ইচ্ছামতো কৃষকদের ওপর কর বৃদ্ধি করে।

[4] অত্যাচার: জমিদার শ্রেণি কর আদায়ে কৃষকদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন শুরু করে এবং যখনতখন কৃষককে জমি থেকে উৎখাত করতে থাকে।

[5] খাদ্যাভাব: সরকার কৃষকদের ধানের পরিবর্তে নীল, পাট, তুলো প্রভৃতি চাষে বাধ্য করলে কৃষকদের ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়।

[6] ঋণের জাল: মহাজন শ্রেণি দরিদ্র প্রজাদের নানাভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে দেয়। ফলে প্রজাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।

[7] কুটিরশিল্প ধ্বংস: ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব ঘটার পর সেখানকার শিল্পজাত পণ্য ভারতের বাজারগুলি দখল করে নিলে ভারতের কুটিরশিল্প ধ্বংস হয় এবং শিল্পী ও কারিগররা বেকার হয়ে পড়ে।
উপসংহার: সীমাহীন শোষণ-নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতের কৃষক ও আদিবাসী সম্প্রদায় বিদ্রোহী হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। তাদের বিদ্রোহগুলি বহুক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালের বৃহৎ সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।

2. ভারতের আদিবাসী ও উপজাতি সম্প্রদায় কীভাবে অরণ্যের ওপর নির্ভর করে জীবিকানির্বাহ করত এবং ব্রিটিশ সরকার কীভাবে তাদের অরণ্যের অধিকার হরণ করে নেয়?

উত্তরঃ ভারতের আদিবাসী ও উপজাতি সম্প্রদায়ের অরণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা-

ভূমিকা: ভারতের প্রাচীন বাসিন্দা আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়ে মানুষজন ছিল খুবই সরল প্রকৃতির। তারা মূলত অরণ্যের ওপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত।

[1] বাসস্থান: ভারতের উপজাতি বা আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি সাধারণত তথাকথিত সভ্য সমাজ থেকে অনেক দূরে প্রত্যন্ত অরণ্যসংকুল ও পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করত।

[2] অরণ্যসম্পদ সংগ্রহ: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আদিবাসীরা অরণ্যের কাঠ, ফলমূল ও বিভিন্ন বনজ সম্পদ সংগ্রহ, পশুপাখি শিকার প্রভৃতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত।

[3] জীবিকানির্বাহ: আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি অরণ্যের সম্পদ ভোগ এবং বিক্রি দুই-ই করত। তারা কঠোর পরিশ্রম করে বনভূমি পরিষ্কার করে, অনুর্বর পতিত জমি উদ্ধার করে সেখানে চাষবাস শুরু করে।

আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার হরণ-

কিন্তু অষ্টাদশ শতক থেকে ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর সরকার নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেয়। যেমন-

[1] অরণ্যে সরকারি আধিপত্য: ব্রিটিশ সরকার এদেশে নতুন নতুন শহরের নির্মাণকার্য, জাহাজ তৈরি, রেলপথ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি প্রয়োজনে ভারতের অরণ্য সম্পদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।

[2] আদিবাসীদের অধিকারহরণ: সরকার নানা বাধানিষেধের মাধ্যমে আদিবাসীদের অরণ্যের বনজ সম্পদ আহরণের অধিকার কেড়ে নেয়। এ ছাড়া অরণ্য সনদ, বনবিভাগ গঠন, অরণ্য আইন প্রবর্তন প্রভৃতির ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের অরণ্যের অধিকার হারাতে থাকে।

[3] খাজনা আরোপ: আদিবাসীরা নিজ পরিশ্রমে যে কৃষিজমি উদ্ধার করে তার ওপর সরকার খাজনা নির্ধারণ করে। ব্রিটিশ সরকারের এই অরণ্যনীতির ফলে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় ক্ষুদ্ধ হয়।

উপসংহার: সামগ্রিকভাবে অরণ্যই ছিল আদিবাসী ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর জীবনজীবিকার মূল উৎস। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার অরণ্যের ওপর হস্তক্ষেপ করলে এইসব সহজসরল মানুষগুলোর ওপর তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ নেমে আসে। 

3.ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতে অরণ্যের ওপর আধিপত্য বৃদ্ধির পদক্ষেপগুলি উল্লেখ করো।

উত্তরঃ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতে অরণ্যের ওপর আধিপত্য বৃদ্ধির পদক্ষেপ-

ভূমিকা: ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারতের আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেয় বা ধ্বংস করে। যেমন-

[1] অরণ্য সনদ, ১৮৫৫ খ্রি: ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে 'অরণ্য সনদ' পাস করে। এর দ্বারা সরকার অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ ও কাঠের ব্যাবসার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। অরণ্যের শাল, সেগুন প্রভৃতি মূল্যবান কাঠ সরকারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন ও জীবিকায় টান পড়ে।

[2] বনবিভাগ গঠন: ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বনবিভাগ গঠন করে। দিয়েত্রিখ ব্র্যান্ডিস নামে জনৈক জার্মানকে বনবিভাগের ইনস্পেকটর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

[3] প্রথম অরণ্য আইন, ১৮৬৫ খ্রি.: সরকার ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম 'ভারতীয় অরণ্য আইন' পাস করে এদেশের অরণ্য সম্পদের ওপর ভারতীয়দের অধিকার খর্ব করে এবং অরণ্যকে সংরক্ষণের আওতায় এনে সেখানে নিজের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে। সরকার ঘোষণা করে যে, অরণ্যে ঘেরা যে-কোনো ভূমিই হল সরকারি সম্পত্তি।

[4] দ্বিতীয় অরণ্য আইন, ১৮৭৮ খ্রি.: ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় 'অরণ্য আইন'-এর দ্বারা সরকার অরণ্যের ওপর নিজের অধিকার আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করে।

উপসংহার: ব্রিটিশ সরকারের এই সকল পদক্ষেপের ফলে অরণ্যের ওপর নির্ভরশীল ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় তাদের শতসহস্র বছরের অরণ্যের অধিকার হারিয়ে এক চরম দুর্দশার শিকার হয়। ফলে তারা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।

জেনে রাখোছ: ব্রিটিশ সরকার আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নিলে বহু আদিবাসী জীবিকানির্বাহের জন্য চুরি-ডাকাতি শুরু করে বা বসতি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়। সরকার ১৮৭১, ১৯১১ ও ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে পৃথক পৃথক 'ক্রিমিনাল ট্রাইবস্ অ্যাক্ট' পাস করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী আদিবাসীদের শায়েস্তা করতে থাকে।

অরণ্যের অধিকার হারিয়ে ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ সরকারের ওপর প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয় এবং বিদ্রোহে শামিল হয়। এসব বিদ্রোহগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চুয়াড় বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, ভিল বিদ্রোহ প্রভৃতি।

4. কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন?

উত্তরঃ অরণ্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য-

অরণ্য আইন: ঔপনিবেশিক শাসনকালে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে সরকারি বনবিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম অরণ্য আইন ও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় অরণ্য আইন পাস করে ব্রিটিশ সরকার বনভূমির ওপর তাদের অধিকার নিশ্চিত করে।

অরণ্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য: এদেশে অরণ্য আইন প্রণয়নের নানা উদ্দেশ্য ছিল। যেমন- [1] ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দের পর কোম্পানির জাহাজ নির্মাণের জন্য ওক কাঠের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে কোম্পানি ভারতীয় বনজ সম্পদের দিকে নজর দেয়। [2] উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতে রেলপথের নির্মাণ ও তার বিস্তার শুরু হলে রেললাইনের স্লিপার নির্মাণ ও অন্যান্য কাজে কাঠের প্রয়োজন দেখা দেয়, যার ফলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে বনভূমি সংরক্ষণের তাগিদ দেখা দেয়। [3] ভারতের অরণ্যগুলিতে বসবাসকারী উপজাতিরা যাতে যথেচ্ছভাবে গাছ কাটতে না পারে সেদিকেও নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

উপসংহার: উনিশ শতকের শেষের দিকে ঔপনিবেশিক সরকার দ্বারা অরণ্য আইন প্রণয়নের ফলে অরণ্য জীবন অশান্ত হয়ে ওঠে এবং নানা বিদ্রোহ দেখা দেয়।

5. উত্তর ব্রিটিশ সরকার প্রচলিত বিভিন্ন অরণ্য আইন

ভূমিকা: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে অরণ্য সম্পদের ওপর নির্ভর করে এদেশের আদিবাসী বা উপজাতি সম্প্রদায়গুলি জীবিকা নির্বাহ করত। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনকালে একাধিক অরণ্য আইন পাস করে আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

[1] ভারতীয় অরণ্য আইন, ১৮৬৫ খ্রি: ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম 'ভারতীয় অরণ্য আইন' পাস করে। এর দ্বারা- [i] এদেশের অরণ্য সম্পদের ওপর ভারতীয়দের অধিকার খর্ব করা হয়। [ii] সরকার অরণ্যকে সংরক্ষণের আওতায় আনে। [iii] সরকার ঘোষণা করে যে, অরণ্যে ঘেরা যে-কোনো ভূমিই হল সরকারের সম্পত্তি।

[2] ভারতীয় অরণ্য আইন, ১৮৭৮ খ্রি: ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় 'ভারতীয় অরণ্য আইন' পাস করে। এর দ্বারা- [i] ব্রিটিশ সরকার ভারতে অরণ্যের ওপর নিজের অধিকার আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। [ii] অরণ্যের ওপর আদিবাসীদের অধিকার ধ্বংস করা হয়।

[3] ভারতীয় অরণ্য আইন, ১৯২৭ খ্রি: ব্রিটিশ সরকার ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে অপর একটি 'ভারতীয় অরণ্য আইন' পাস করে। এই আইনের দ্বারা অরণ্যকে- [i] সংরক্ষিত অরণ্য, [ii] সুরক্ষিত অরণ্য ও [iii] গ্রামীণ অরণ্য-এই তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। কোন্ কোন্ বিষয়গুলি 'অরণ্য বিষয়ক অপরাধ' অর্থাৎ, অরণ্যের অভ্যন্তরে কোন্ কোন্ কাজ নিষিদ্ধ, অরণ্য আইন লঙ্ঘন করলে কী শাস্তি হবে তা উল্লেখ করা হয়।

উপসংহার: ব্রিটিশ সরকার অরণ্য আইনগুলির মাধ্যমে আদিবাসীদের কাছ থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেয়। ফলে আদিবাসী সম্প্রদায় জীবনজীবিকার উৎস হারিয়ে শেষপর্যন্ত চুরি-ডাকাতি শুরু করে অথবা বসতি ছেড়ে অন্যত্র ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।

6. 'বিদ্রোহ, অভ্যুস্থান ও বিপ্লব'-এর ধারণাটি ব্যাখ্যা করো।

উত্তরঃ ভূমিকা: ইতিহাসের আলোচনায় আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ধারা হল 'বিদ্রোহ', 'অভ্যুত্থান' ও 'বিপ্লব'। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে শোষক ও অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ জনগোষ্ঠী প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। এই প্রতিবাদ বা ক্ষোভের প্রকাশ বিভিন্ন 'বিদ্রোহ' বা 'অভ্যুত্থান' বা 'বিপ্লব'-এর মাধ্যমে হতে পারে। 'বিদ্রোহ', 'অভ্যুত্থান' ও 'বিপ্লব'-এর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। যেমন-

বিদ্রোহ

[1] বিদ্রোহ কী?: বিদ্রোহ বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে বিরোধী জনসমষ্টির আন্দোলন। বিদ্রোহ স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। বিদ্রোহ সফল হলে পূর্বতন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন সম্ভব।

[2] উদাহরণ: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে রংপুর বিদ্রোহ, পাবনা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ প্রভৃতি কৃষকবিদ্রোহ এবং সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) প্রভৃতি হল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

অভ্যুত্থান

[1] অভ্যুত্থান কী?: অভ্যুত্থান বলতে বোঝায় কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের সংগ্রাম। অভ্যুত্থান দীর্ঘমেয়াদী হয় না। অভ্যুত্থান সাধারণত খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। অভ্যুত্থানে বিরোধী গোষ্ঠ ভূমিকা থাকতে পারে, না-ও থাকতে পারে। তবে নিজ গোষ্ঠ একাংশের স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টি 'অভ্যুত্থান'-এ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। 

[2] উদাহরণ: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একাংশ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহ সংঘটিত করে

বিপ্লব 

[1] 'বিপ্লব' কী?: বিপ্লব' বলতে বোঝায় প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাঙ্গ ও আমূল পরিবর্তন। 'বিপ্লব' হল 'বিদ্রোহ' এবং 'অভ্যুত্থান'-এর চো অনেক বেশি ব্যাপক।

[2] উদাহরণ: ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা ফ্রান্সের পূর্বজ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্রুত ও আমা পরিবর্তন ঘটে। বিদ্রোহকে আবার বিপ্লবের প্রাথমিক ধাপ বলা যায়।

 উপসংহার: 'বিদ্রোহ', 'অভ্যুত্থান' ও 'বিপ্লব'-এই তিনটি বিষয়কে অনে সময়ই সুস্পষ্টভাবে পৃথক করা মুশকিল হয়ে পড়ে। কারণ, এই গণবিক্ষোভ বা আন্দোলনকে কেউ কেউ 'অভ্যুত্থান' আবার কেউ শে 'বিদ্রোহ' হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেয়ে পারে-১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে কেউ কেউ 'বিদ্রোহ', 'আক কেউ কেউ 'অভ্যুত্থান' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

7.বিদ্রোহ বলতে কী বোঝায় এবং এর কয়েকটি উদাহরণ দাও।

উত্তরঃ বিদ্রোহ-

ভূমিকা: বিভিন্ন দেশে ক্ষুব্ধ বা অসন্তুষ্ট মানুষজন যে উপায়ে নিজেদে ক্ষোভ বা প্রতিবাদ প্রকাশ করে থাকে সেগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ উপায় বা ধারা হল বিদ্রোহ।

[1] বিদ্রোহ কী? কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে কোনো প্রচলিত ব্যবসা পরিবর্তনের দাবিতে বিরোধী জনগোষ্ঠী সুসংগঠিত অসংগঠিতভাবে যে আন্দোলন গড়ে তোলে তা সাধারণভাবে বিদ্রো নামে পরিচিত।

[2] বৈশিষ্ট্য: বিদ্রোহের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-[i] বিদ্রোহ স্বরব দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। [ii] বিদ্রোহ পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিতভা শুরু হতে পারে। [iii] বিদ্রোহ সফল হলে পূর্বতন ব্যবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে। [iv] বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে পূর্বতন ব্যবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে না।

[3] উদাহরণ: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে রংপুর বিদ্রোহ, পাকা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ প্রভৃতি কৃষকবিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫ খ্রি.) প্রভৃতি হল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। [i] ভারতে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ ছিল স্বল্পকালীন বিদ্রোহ, আবার চিলো তাইপিং বিদ্রোহ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। [ii] নীল বিয়ো পরিকল্পিতভাবে শুরু হলেও সিপাহি বিদ্রোহ অপরিকল্পিতভাবে শ হয়েছিল। [iii] নীল বিদ্রোহ সফল হওয়ায় সরকার নীল কমিশন গঠ করে নীলচাষিদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষার উদ্যোগ নোয় [iv] সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ায় ভারতীয় সিপাহিদের দুর্দশা হয়নি। [v] অনেকসময় বিদ্রোহ এক বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের মা সীমাবদ্ধ থাকে।

উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে বহুবার বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে এগুলি বহুক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও প্রচলিত ব্যবস্থার কিছু-না-কিছু পরিবর্ত ঘটিয়েছে।

8.অভ্যুত্থান বলতে কী বোঝায় এবং এর কয়েকটি উদাহরণ দাও।

উত্তরঃ  অভ্যুত্থান-

ভূমিকা: বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্ধ বা অসন্তুষ্ট মানুষজন যে উপায়ে নিজেদের ক্ষোভ বা প্রতিবাদ প্রকাশ করে থাকে সেগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উপায় বা ধারা হল 'অভ্যুত্থান'।

[1] অভ্যুত্থান কী? অভুত্থান বলতে বোঝায় কোনো দেশ বা সমাজে কিংবা প্রশাসনে কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের সংগ্রাম। এক্ষেত্রে নিজেদের নেতা বা প্রভুদের বিরুদ্ধেই তাদের অধীনস্থ মানুষ সংগ্রাম করে।

[2] বৈশিষ্ট্য: অভ্যুত্থানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-[i] নিজ গোষ্ঠীর ক্ষুব্ধ লোকজন অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পতন বা পরিবর্তন ঘটাতে চায়। [ii] অভ্যুত্থানের দ্বারা শুধু ক্ষমতার কেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। [iii] অভ্যুত্থান সফল বা ব্যর্থ যাই হোক না কেন তাতে সমাজ বা রাষ্ট্রের মূল কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে না।

[3] উদাহরণ: অভ্যুত্থানের প্রধান উদাহরণগুলি হল- [i] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একাংশের উদ্যোগে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ। [ii] ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সেনাদের একাংশের নেতৃত্বে নৌবিদ্রোহ, [iii] বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান সরকারের পতন (১৯৮৫ খ্রি.) ঘটিয়ে তাঁর সেনাপতি এরশাদের ক্ষমতা দখল।

উপসংহার: প্রচলিত ব্যবস্থার বদলের পরিবর্তে ক্ষমতার হস্তান্তরই হয়ে ওঠে অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্যে। তাই বিপ্লব বা বিদ্রোহের মধ্যে যে ব্যাপক আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, ততটা সম্ভাবনা অভ্যুত্থানের মধ্যে থাকে না।

9.বিপ্লব বলতে কী বোঝায় এবং এর কয়েকটি উদাহরণ দাও। 

উত্তরঃ বিপ্লব-

ভূমিকা: বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্ধ বা অসন্তুষ্ট মানুষজন যে উপায়ে নিজেদের ক্ষোভ বা প্রতিবাদ প্রকাশ করে থাকে সেগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উপায় বা ধারা হল বিপ্লব।

[1] বিপ্লব কী? বিপ্লব কথার অর্থ হল কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন। কোনো দেশ বা সমাজে জনগণ প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন ঘটালে তাকে 'বিপ্লব' বলে অভিহিত করা হয়।

[2] বৈশিষ্ট্য: বিপ্লবের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-[i] বিপ্লব হল মানুষের সফল আন্দোলন। [ii] বিপ্লবের দ্বারা দেশ বা সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল হয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু হয়। [iii] বিপ্লবের দ্বারা প্রচলিত ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে।

[3] উদাহরণ: বিপ্লবের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল- [i] অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে সংঘটিত শিল্পবিপ্লব, [ii] ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব। শিল্পবিপ্লবের দ্বারা ইউরোপের শিল্পব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা ফ্রান্সে পূর্বতন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্রুত ও আমূল পরিবর্তন ঘটে।

উপসংহার: সব পরিবর্তনই বিপ্লব নয়। বিপ্লবের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটে, অবশ্যই তাকে ইতিবাচক হতে হয়। অর্থাৎ বিপ্লব হল সেই আমূল পরিবর্তন, যা হবে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, ক্ষুধা থেকে অন্নের দিকে, শূন্যতা থেকে পূর্ণতার দিকে।

10. 'রংপুর বিদ্রোহ' সম্পর্কে কী জান?

উত্তরঃ রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.)-
ভূমিকা: দেবী সিংহ নামে জনৈক ব্যক্তি ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে সরকারের কাছ থেকে দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনা ইজারা নেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেবী সিংহের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে যে কৃষকবিদ্রোহ শুরু হয় তা 'রংপুর বিদ্রোহ' (১৭৮৩ খ্রি.) নামে পরিচিত।

[1] বিদ্রোহের কারণ: রংপুর বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার বিভিন্ন কারণ ছিল-[i] দেবী সিংহ দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনার ইজারা নিয়ে সেখানকার জমিদার ও প্রজাদের ওপর রাজস্বের হার বহুগুণ বৃদ্ধি করেন এবং নানা নতুন কর আরোপ করেন। [ii] রাজস্ব আদায়ে এখানকার জমিদার ও কৃষকদের ওপর চরম অত্যাচার শুরু হয়। রংপুর পরগনায় এই অত্যাচার চরমে ওঠে। কৃষকদের কারাগারে অনাহারে বন্দি রাখা, বেত্রাঘাত প্রভৃতি চলতে থাকে। [iii] কৃষকরা গোরুবাছুর, সম্পত্তি, এমনকি নিজ সন্তানদের বিক্রি করেও দেবী সিংহের শোষণ থেকে মুক্ত হতে পারত না।

[2] বিদ্রোহের সূত্রপাত: দেবী সিংহের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রংপুরের কাজীর হাট, কাকিনা, ফতেপুর, ডিমলা প্রভৃতি স্থানের কৃষকরা ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি তেপা গ্রামে মিলিত হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এটি 'রংপুর বিদ্রোহ' নামে পরিচিত।

[3] স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা: বিদ্রোহীরা একটি 'স্থানীয় স্বাধীন সরকার' গঠন করে। এই সরকারের নবাব বা নেতা হন নুরুলউদ্দিন এবং তাঁর সহকারী নেতা হন দয়ারাম শীল।

[4] বিদ্রোহের প্রসার: বিদ্রোহীরা দেবী সিংহকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে এবং তার রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের বিতাড়িত করে। বহু কর্মচারী নিহত হয়। বিদ্রোহের ব্যয় নির্বাহের জন্য 'ডিং খরচা' নামে চাঁদা ধার্য করা হয়। 

[5] বিদ্রোহ দমন: রংপুরের কালেক্টর গুডল্যান্ড বিদ্রোহ দমনে সুবিশাল ব্রিটিশবাহিনী পাঠান। মোগলহাট ও পাটগ্রামের যুদ্ধে বিদ্রোহীরা সেনাপতি ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশবাহিনীর কাছে পরাজিত হলে বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে। ব্রিটিশবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, অসংখ্য বিদ্রোহীকে হত্যা করে।

উপসংহার: রংপুর বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। জমিদার ও কৃষকদের মিলিত এই বিদ্রোহ যতটা দেবী সিংহের বিরুদ্ধে ছিল, ঠিক ততটাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনাস্থার প্রকাশ।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. কোন্ যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম ভারতে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এবং কোন্ যুদ্ধের মাধ্যমে তারা শাসনক্ষমতা পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠা করে?

উত্তরঃ  ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশির যুদ্ধে (১৭৫৭ খ্রি.) নবাব সিরাজ-উদ্দৌলাকে পরাজিত করে ভারতে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এবং বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪ খ্রি.) নবাব মীরকাশিমকে পরাজিত করে প্রথম বাংলা- বিহার-উড়িষ্যায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতে পাকাপাকিভাবে শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে।

2.ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর সংঘটিত উল্লেখযোগ্য কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলির নাম লেখো।

উত্তরঃ ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর সংঘটিত উল্লেখযোগ্য কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলি হল সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ, ভিল বিদ্রোহ, ফরাজি আন্দোলন, পাগলপন্থী বিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন, কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, পাবনা বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ প্রভৃতি।

3.ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলির প্রধান কারণ কী ছিল?

উত্তরঃ ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল-[1] কৃষক ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের ক্ষেত্রে ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি, [2] বিভিন্ন নতুন কর আরোপ, [3] চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী শোষণ, [4] খাজনা আদায়ে অত্যাচার, [5] নীল, পাট, তুলো প্রভৃতি চাষে চাষিদের বাধ্য করা, [6] মহাজনদের শোষণ, [7] কুটিরশিল্প ধ্বংস প্রভৃতি।

4.ঔপনিবেশিক শাসনকালে জমিদাররা কৃষকদের ওপর কীভাবে অত্যাচার চালাত?

উত্তরঃ ঔপনিবেশিক শাসনকালে জমিদাররা কৃষকদের ওপর- [1] উচ্চহারে ভূমিরাজস্ব আরোপ করত, [2] ভূমিরাজস্ব ছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু নতুন কর আরোপ করত, [3] রাজস্ব ও অন্যান্য কর আদায়ে কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালাত, [4] কর দিতে ব্যর্থ হলে কৃষকদের জমি থেকে উৎখাত করত।

5.ঔপনিবেশিক শাসনকালে মহাজনরা কৃষকদের কীভাবে শোষণ করত?

উত্তরঃ ঔপনিবেশিক শাসনকালে মহাজনরা নানাভাবে কৃষকদের শোষণ করত। যেমন- [1] কৃষকরা নগদে জমিদারদের রাজস্ব পরিশোধের জন্য মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিত। ঋণের জন্য কৃষকরা উচ্চাহারে সুদ দিতে বাধ্য হত। [2] কৃষকরা ঋণের বিপুল পরিমাণ সুদের অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে মহাজন সেই কৃষকের জমিজমা দখল করে নিত।

6.ঔপনিবেশিক শাসনকালে নীলকররা কৃষকদের ওপর কীভাবে শোষণ ও অত্যাচার চালাত?
উত্তরঃ নীলকররা- [1] কৃষকদের খাদ্য উৎপাদনের পরিবর্তে জোর করে নীলচাষে বাধ্য করত। [2] নীলচাষে রাজি না হলে নীলকররা কৃষককে তাদের নীলকুঠিতে আটকে রাখত, শারীরিক নির্যাতন চালাত। [3] কৃষকদে গোরুবাছুর ধরে নিয়ে যেত এবং কৃষক পরিবারের মহিলাদের সম্মানহাই করত। [4] নীলকররা কৃষকের ঘরবাড়িতে আগুনও লাগিয়ে দিত।

7. ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তরঃ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৮৬৫ ও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে অরণ্য আই প্রণয়নের উদ্দেশ্যগুলি ছিল-[1] অরণ্য থেকে অরণ্যবাসী জাতিগোষ্ঠী গুলিকে সুকৌশলে বিচ্ছিন্ন করা। [2] এদেশে নতুন নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করা [3] রেলগাড়ি, রেলপথ, জাহাজ প্রভৃতি তৈরির প্রয়োজনে অরণের কাষ্ঠসম্পদ হস্তগত করার উদ্যোগ নেওয়া। [4] অরণ্যের অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করা।

8.ব্রিটিশ শাসনের আগে অরণ্য কীভাবে আদিবাসীদের জীবিকানির্বায়ে সাহায্য করত?

উত্তরঃ ব্রিটিশ শাসনের আগে অরণ্য আদিবাসীদের জীবিকানির্বাহে নানাভাবে সাহায্য করত। আদিবাসীরা অরণ্যের কাঠ, ফলমূল ও বিভিন্ন বনজ সম্পদ সংগ্রহ, পশুপাখি শিকার প্রভৃতির দ্বারা জীবিকানির্বাহ করত। তার অরণ্যের সম্পদ ভোগ এবং বিক্রি দুই-ই করত।

9.অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ সরকার কী উদ্দেশ্যে অরণ্যের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে?

উত্তরঃ অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ সরকার ভারতে নতুন শহরের নির্মাণকার্য জাহাজ তৈরি, রেলপথ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির প্রয়োজনে অরণ্যের ওপর আধিপত প্রতিষ্ঠা করে।

10. আদিবাসীদের কৃষিজমিতে সরকার রাজস্ব আরোপ করলে আদিবাসীরা ক্ষুব্ধ হয় কেন?

উত্তরঃআদিবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করে বনভূমি পরিষ্কার করে, অনুবা পতিত জমি উদ্ধার করে সেখানে চাষবাস শুরু করে। তাদের পরিশ্রমে উদ্ধার হওয়া এই জমিতে ব্রিটিশ সরকার রাজস্ব আরোপ করলে তারা ক্ষুদ্ধ হয়। 

11.ব্রিটিশ সরকার 'অরণ্য সনদ' (১৮৫৫ খ্রি.)-এর দ্বারা কী পদক্ষেপ নেয়?

উত্তরঃ ব্রিটিশ সরকার 'অরণ্য সনদ' (১৮৫৫ খ্রি.)-এর দ্বারা- [1] ভারতীয় অরণ্যের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে। [2] জনগণ কর্তৃত অরণ্যের কাঠ সংগ্রহ ও কাঠের ব্যাবসার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। [3] অরণ্যের শাল, সেগুন প্রভৃতি মূল্যবান কাঠ সরকারের সম্পত্তিরে পরিণত করে।

12.কবে প্রথম 'ভারতীয় অরণ্য আইন' পাস হয়? এই আইনের দ্বারা ধী পদক্ষেপ নেওয়া হয়?

উত্তরঃ ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম 'ভারতীয় অরণ্য আইন' পাস হয়। [* প্রথম 'ভারতীয় অরণ্য আইন'-এর দ্বারা- [1] ভারতের অরণ্য সম্পদের ওপর ভারতীয়দের অধিকার খর্ব করা হয়। [2] সরকার অরণ্যকে সংরক্ষণের আওতায় এনে নিজের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে। [3] সরকার ঘোষণা করে দে অরণ্যে ঘেরা যে-কোনো ভূমিই হল সরকারের সম্পত্তি।

13. 'কবে দ্বিতীয় 'ভারতীয় অরণ্য আইন' পাস হয়? এই আইনের দ্বারা কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়?

উত্তরঃ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় 'ভারতীয় অরণ্য আইন' পাস হয়।
দ্বিতীয় 'ভারতীয় অরণ্য আইন'-এর দ্বারা- [1] সরকার অরণ্যের ওপর নিজের অধিকার আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করে। [2] আদিবাসীদের কাছ থেকে অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

14. ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে অরণ্য আইনকে কটি স্তরে ভাগ করা হয় এবং ভাগগুলি কী?

উত্তরঃ ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে অরণ্য আইনকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়। এগুলি হল-[1] সংরক্ষিত (Reserved), [2] সুরক্ষিত (Protected) এবং [3] অ-শ্রেণিবিভক্ত (Unclassified)।

15 অরণ্যের অধিকার হারিয়ে জীবিকানির্বাহে ব্যর্থ বহু আদিবাসী কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে?

উত্তরঃঅরণ্যের অধিকার হারিয়ে জীবিকানির্বাহে ব্যর্থ হয়ে-[1] বহু আদিবাসী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। [2] অনেকে চুরি, ডাকাতি শুরু করে। [3] অনেকে বসতি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়।

16. ব্রিটিশ সরকার কবে, কোথায় ইম্পিরিয়াল ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করে? 

উত্তরঃ ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে দেরাদুনে ব্রিটিশ সরকার 'ইম্পিরিয়াল ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট' প্রতিষ্ঠা করে।

17. ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতীয় অরণ্য আইন'এর দ্বারা সরকার কী কী পদক্ষেপ নেয়?

উত্তরঃ ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতীয় অরণ্য আইন'-এর দ্বারা সরকার- [1] অরণ্যকে সংরক্ষিত অরণ্য, সুরক্ষিত অরণ্য ও গ্রামীণ অরণ্য-এই তিন ভাগে বিভক্ত করে। [2] কোন্ কোন্ বিষয়গুলি 'অরণ্য-বিষয়ক অপরাধ', অরণ্যের অভ্যন্তরে কোন্ কোন্ কাজ নিষিদ্ধ, অরণ্য আইন লঙ্ঘন করলে কী শাস্তি হবে তা ঘোষণা করে।

18. সরকার কোন্ কোন্ বছর ক্রিমিনাল ট্রাইবস্ অ্যাক্ট পাস করে? কী উদ্দেশ্যে এই আইন পাস হয়?

উত্তরঃ সরকার ১৮৭১, ১৯১১ ও ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে পৃথক পৃথক ক্রিমিনাল ট্রাইবস্ অ্যাক্ট পাস করে।
ক্রমিনাল ট্রাইবস্ অ্যাক্ট পাসের উদ্দেশ্য ছিল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী আদিবাসীদের শায়েস্তা করা।

19.বিদ্রোহ কাকে বলে? বিদ্রোহের একটি উদাহরণ দাও।

উত্তরঃ কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে বিরোধী জনগোষ্ঠীর আন্দোলন সাধারণভাবে বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

বিদ্রোহের একটি উদাহরণ হল নীলকরদের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকদের পরিচালনায় ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত 'নীল বিদ্রোহ'।

20.অভ্যুত্থান বলতে কী বোঝ? অভ্যুত্থানের একটি উদাহরণ দাও।

উত্তরঃ কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজ গোষ্ঠীর একাংশের সংগ্রাম সাধারণভাবে অভ্যুত্থান নামে পরিচিত। অভ্যুত্থানের একটি উদাহরণ হল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে সরকারের বিরুদ্ধে সেনাদের একাংশের বিদ্রোহ ঘোষণা।

21.বিপ্লব বলতে কী বোঝায়?

উত্তরঃ কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তনকে বিপ্লব বলা হয়। বিপ্লবের একটি উদাহরণ হল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব। কেন-না, এই বিপ্লবের দ্বারা ফরাসি সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার দ্রুত, ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন ঘটে।

22. 'বাংলায় ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত কয়েকটি কৃষকবিদ্রোহের নাম লেখো।

উত্তরঃ বাংলায় ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত কয়েকটি কৃষকবিদ্রোহ হল-[1] চুয়াড বিদ্রোহ (১৭৬৭ ও ১৭৯৮-৯৯ খ্রি.) [2] রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.) [3] ভিল বিদ্রোহ (১৮১৯ খ্রি.) [4] কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২ খ্রি.) [5] সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) (6) নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬০ খ্রি.) [7] মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০ খ্রি.) প্রভৃতি।

23. ঔপনিবেশিক বাংলায় কয়েকটি উপজাতি কৃষকবিদ্রোহের নাম লেখো।

উত্তরঃঔপনিবেশিক বাংলায় উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপজাতি বিদ্রোহ হল-[1] চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৬৭ ও ১৭৯৮-৯৯ খ্রি.) [2] ভিল বিদ্রোহ (১৮১৯ খ্রি.) [3] কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২ খ্রি.) [4] সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) [5] মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০ খ্রি.) প্রভৃতি।

24.ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো। 

উত্তরঃ ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল [1] এই বিদ্রোহগুলি ছিল মূলত উপজাতি বিদ্রোহ, [2] বিদ্রোহীরা অরণ্যের ওপর তাদের চিরাচরিত অধিকার রক্ষা করতে প্রাণপাত করে। [3] বিদ্রোহে ব্রিটিশ-বিরোধিতা ছিল স্পষ্ট ও তীব্র। [4] বিদ্রোহগুলি অধিকাংশ সময়ই ছিল সশস্ত্র।

25. বনাঞ্চলগুলির ওপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধির দুটি কারণ উল্লেখ করো।

উত্তরঃ বনাঞ্চলগুলির ওপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব বৃদ্ধির দুটি কারণ হল- [1] সরকার ভারতে নতুন নতুন শহরের নির্মাণকার্য করতে গিয়ে বনাঞ্চলের কাঠের প্রয়োজন বোধ করে। [2] জাহাজ তৈরি, রেলপথ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি প্রয়োজনে সরকার বনাঞ্চলের কাঠের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

26. দেবী সিংহ কে ছিলেন?

উত্তরঃ দেবী সিংহ ছিলেন দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনার একজন ইজারাদার। তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলের ইজারা নিয়ে এখানকার জমিদার ও প্রজাদের ওপর রাজস্বের হার বহুগুণ বৃদ্ধি করলে তাঁর বিরুদ্ধে রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.) শুরু হয়।

27.দেবী সিংহ জমিদার ও কৃষকদের ওপর কী ধরনের অত্যাচার চালাতেন?

উত্তরঃ দিনাজপুর, রংপুর জেলা এবং এদ্রাকপুর পরগনার ইজারাদার দেবী সিংহ সেই অঞ্চলের জমিদার ও প্রজাদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালান। [1] তিনি তাদের ওপর রাজস্বের হার বহুগুণ বৃদ্ধি করেন। [2] বিভিন্ন নতুন কর আরোপ করেন। [3] এই অর্থ আদায়ে তাদের ওপর চরম অত্যাচার চালানো হয়। কৃষকদের কারাগারে অনাহারে বন্দি রাখা, বেত্রাঘাত প্রভৃতি চলতে থাকে।

28. "রংপুরের কৃষকদের ওপর কীরূপ শোষণ চলত? অথবা, রংপুর বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

উত্তরঃ রংপুরের কৃষকদের ওপর নানাভাবে শোষণ চলত- [1] ইজারাদার দেবী সিংহ রংপুরের ভূমিরাজস্বের পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। [2] তাদের ওপর বিভিন্ন নতুন কর বসানো হয়। [3] এসব অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে কৃষকদের কারাগারে অনাহারে বন্দি রাখা, বেত্রাঘাত প্রভৃতি চলতে থাকে। [4] কৃষকরা রাজস্ব পরিশোধের নগদ অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে তীব্র ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। [5] ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় কৃষককে ঘরবাড়ি ও জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এসব কারণে শেষপর্যন্ত রংপুর বিদ্রোহ শুরু হয়।

29. রংপুর বিদ্রোহের স্বাধীন সরকার সম্পর্কে কী জান?

উত্তরঃ ইজারাদার দেবী সিংহ ও ব্রিটিশ কোম্পানির বিরুদ্ধে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে রংপুর বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা একটি 'স্থানীয় স্বাধীন সরকার' গঠন করে নুরুলউদ্দিন-কে নেতা বা নবাব এবং দয়ারাম শীলকে সহকারী নেতা বলে ঘোষণা করে।

30. রংপুর বিদ্রোহে বিদ্রোহীরা কী কী পদক্ষেপ নেয়?

উত্তরঃ রংপুর বিদ্রোহে- [1] বিদ্রোহী কৃষকরা একটি 'স্থানীয় স্বাধীন সরকার' গঠন করে। [2] এই সরকারের প্রধান নেতা বা নবাব হন নুরুলউদ্দিন এবং তাঁর সহকারী হন দয়ারাম শীল। [3] বিদ্রোহী কৃষকরা দেবী সিংহকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে। [4] তারা রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের বিতাড়িত করে। [5] বহু কর্মচারী বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়।

ঠিক বা ভুল নির্ধারণ করো

1. ভারতীয় উপজাতিগুলিকে অরণ্যের অধিকার দানের উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রণীত হয়।

উত্তরঃ ভুল ।

2. সরকার আদিবাসীদের সমভূমিতে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের অরণ্যের সম্পদ সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত করে।

উত্তরঃভুল ।

3. বিপ্লবের একটি উদাহরণ হল ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.)।

উত্তরঃ ঠিক ।

4. দেবী সিংহের নেতৃত্বে রংপুরের কৃষকরা জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকরেছিল।

উত্তরঃ ভুল ।

5. রংপুর বিদ্রোহের নেতা হলেন টিপু শাহ।

উত্তরঃ ভুল ।

6. জঙ্গলমহল-সহ মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দ্বিতীয় পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

উত্তরঃ ঠিক ।

7. চুয়াড় বিদ্রোহের পর ইংরেজরা বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর শহরটিকে কেন্দ্র করে দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে জঙ্গলমহল নামে একটি জেলা গঠন করে। 

উত্তরঃ ঠিক ।

৪. 'হুল' নামে ভিল বিদ্রোহ পরিচিত ছিল।

উত্তরঃভুল ।

9. ঝিন্দরাই, সুই মুন্ডা প্রমুখ সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা ছিলেন।

উত্তরঃভুল ।

10. 'দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি'-তে ব্রিটিশ আইনকানুনের পরিবর্তে কোলদের নিজস্ব আইনকানুন চালু করা হয়।

উত্তরঃ ঠিক ।

11. ক্যাপটেন উইলকিনসনের নেতৃত্বাধীন ইংরেজবাহিনী কোল বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত হয়েছিল।

উত্তরঃ ঠিক ।

12. নীলকর সাহেবরা সাঁওতাল কৃষকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নীলচাষে বাধ্য করত।

উত্তরঃ ঠিক ।

13. কেনারাম ছিল কম ওজনের এবং বেচারাম ছিল বেশি ওজনের বাটখারা।

উত্তরঃ ভুল ।

14. সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন বীর সিং ও কালো প্রামাণিক।

উত্তরঃ ভুল ।

15. চাঁদ ও ভৈরব ছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহের দুই নেতা।

উত্তরঃ ঠিক ।

16. সাঁওতাল বিদ্রোহ 'উলঘুলান' নামে পরিচিত ছিল।

উত্তরঃ ভুল ।

17. সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতীক ছিল শালগাছ।

উত্তরঃ ঠিক ।
18. মুন্ডা সমাজে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার নাম ছিল 'খুঁৎকাঠি' প্রথা।

উত্তরঃ ভুল ।

19. মুন্ডা বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে মহাশ্বেতা দেবী রচনা করেন 'অরণ্যের অধিকার'।

উত্তরঃ ঠিক ।

20. 'ধরতি আবা' কথার অর্থ হল মুন্ডাদের পিতা।

উত্তরঃ ভুল ।

21. 'দামিন-ই-কোহ্' কথার অর্থ হল সাঁওতালগণের বিচরণভূমি।

উত্তরঃ ভুল ।

22. সাঁওতালদের বাসভূমি ছিল 'দামিন-ই-কোহ'।

উত্তরঃ ঠিক ।

23. দিয়েত্রিখ ব্র্যান্ডিস ছিলেন একজন আমেরিকান উদ্ভিদবিদ।

উত্তরঃ ভুল ।

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে_____এর দ্বারা ভারতীয় অরণ্যের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে।

উত্তরঃ অরণ্য সনদ ।

2. ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে_____গঠন করে।

উত্তরঃ বন বিভাগ ।

3. ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের গণ আন্দোলন হল_____-এর একটি উদাহরণ।

উত্তরঃ বিপ্লব ।

4. ঘাটশিলার ধলভূমের রাজা ছিলেন______।

উত্তরঃ জগন্নাথ সিংহ।

5. ফরাজি বা ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল একটি _____-এর উদাহরণ।

উত্তরঃ বিদ্রোহ।

6. রংপুর বিদ্রোহ প্রথম শুরু হয়েছিল____গ্রামে।

উত্তরঃ তোপা।

7. চুয়াড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল_____বিরুদ্ধে।

উত্তরঃ ব্রিটিশদের 

৪. মহারাষ্ট্রের খান্দেশ অঞ্চলে বাস করত_____উপজাতি।

উত্তরঃ ভিল ।

9. ইংরেজ কোম্পানি কোলদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের খাদ্যশস্যের পরিবর্তে_____চাষে বাধ্য করত।

উত্তরঃ আফিম ।

10. কোল বিদ্রোহ দমনে নেতৃত্ব দেন ক্যাপটেন_____।

উত্তরঃ  উইলকিনসন।

11. কেনারাম ও বেচারাম নামে বাটখারা ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা____ঠকাত।

উত্তরঃ সাঁওতালদের 

12. নীলকর সাহেবরা_____কৃষকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নীলচাষে বাধ্য করত।

উত্তরঃ সাঁওতাল ।

13. বিদ্রোহের আগে সাঁওতালদের______ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা  চলত। 

উত্তরঃ খ্রিস্ট 

14. সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা ছিলেন_____। 

উত্তরঃ বীর সিং ।

15. _____মাঠের জমায়েতে সিধু ও কানু স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন।

উত্তরঃ ভাগনাডিহির।

16. ১০ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে জড়ো হয়েছিল ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের____জুন।

উত্তরঃ ৩০
 
17. সাঁওতাল বিদ্রোহে অত্যাচারী দারোগা______নিহত হন।

উত্তরঃ মহেন্দ্রলাল দত্ত।

18. ব্রিটিশরা_____হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

উত্তরঃ ২৩

19. পাকুড়ের রাজবাড়ি দখল করে_____।

উত্তরঃ সাঁওতালরা।

20. সাঁওতালরা বহিরাগত জমিদার ও মহাজনদের বলত_____।

উত্তরঃ দিকু।

21. _____ছিলেন মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান নেতা।

উত্তরঃ বিরসা মুন্ড।

22. বিরসা মুন্ডা প্রথমে এক নতুন_____প্রচারের দ্বারা মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ করেন। 

উত্তরঃ ধর্ম ।

23. প্রথম স্বাধীন মুন্ডারাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন_____ মুন্ডা।

উত্তরঃ বিরসা।

24 বিরসা মুন্দা নিজেকে_____বলে ঘোষণা করেন।

উত্তরঃ ধরতি আবা।

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ

সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো

1. সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিলেন-


(a) রানি কর্ণাবতী

(b) রানি শিরোমণি

(c ) দেবী চৌধুরানি

(d) রানি দুর্গাবতী                  


উত্তরঃ(c ) দেবী চৌধুরানি


2. ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে ভারতে সংঘটিত প্রথম কৃষকবিদ্রোহ হল-


(a) রংপুর বিদ্রোহ

(b) পাবনা বিদ্রোহ

(c ) নীল বিদ্রোহ

(d) সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ


উত্তরঃ(d) সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ


3. সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতা ছিলেন-


(a) তিতুমির

(b) হাজি শরিয়ত উল্লাহ

(c ) ভবানী পাঠক

(d) নোয়া মিঞা


উত্তরঃ(c ) ভবানী পাঠক


4. সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের প্রথম শুরু হয়-


(a) ঢাকায়

(b) রংপুরে

(c ) ময়মনসিংহে

(d)ফরিদপুরে


উত্তরঃ(a) ঢাকায়


5. 'সন্ন্যাসী বিদ্রোহ' কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন-


(a) ভিনসেন্ট স্মিথ

(b) জেমস মিল

(c ) ওয়ারেন হেস্টিংস

(d) লর্ড কর্নওয়ালিশ              


উত্তরঃ(b) জেমস মিল


6. সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের সময় রংপুরের যুদ্ধে যে ইংরেজ সেনাপতি নিহত হন তিনি হলেন-


(a) এডওয়ার্ড

(b) সেনাপতি হ্যাভল

(c ) সেনাপতি টমাস

(d) সেনাপতি নেলসন


উত্তরঃ(c ) সেনাপতি টমাস


7. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'আনন্দমঠ' উপন্যাস রচনা করেন-


(a) পাগলপন্থী বিদ্রোহের পটভূমিতে

(b) সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিতে

(c ) চুয়াড় বিদ্রোহের পটভূমিতে

(d)নীল বিদ্রোহের পটভূমিতে


উত্তরঃ(b) সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিতে


8. 'দেবী চৌধুরানি' রচনা করেন।


(a) বিদ্যাসাগর

(b) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

(c ) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

(d)রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


উত্তরঃ(c ) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


9. ভারতে প্রথম ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রসার ঘটান-


(a) সৈয়দ আহমেদ

(b) আবদুল ওয়াহাব

(c ) তিতুমির

(d) গোলাম মাসুম


উত্তরঃ(a) সৈয়দ আহমেদ


10. তিতুমিরের প্রকৃত নাম ছিল-


(a) চিরাগ আলি

(b) হায়দর আলি

(c ) মির নিসার আলি

(d) তোরাপ আলি              


উত্তরঃ(c ) মির নিসার আলি


11. মির নিশার আলি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন-


(a) বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন

(b) ফরাজি আন্দোলন

(c ) সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ

(d) নীল বিদ্রোহ             


উত্তরঃ(a) বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন


12. তিতুমির কর্তৃক ঘোষিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন-


(a) তিতুমির

(b) গোলাম মাসুম

(c ) সৈয়াম আহমেদ

(d) মৈনুদ্দিন


উত্তরঃ(d) মৈনুদ্দিন


13. 'জমি আল্লাহ-র দান'- কথাটি বলেছিলেন?


(a) তিতুমির

(b) শরিয়ত উল্লাহ

(c ) মইনউদ্দিন

(d) মহম্মদ মহসিন


উত্তরঃ (d) মহম্মদ মহসিন


14. বাঁশের কেল্লা তৈরি হয়েছিল-


(a) চৌগাছা গ্রামে

(b) নারকেলবেড়িয়া গ্রামে

(c ) বসিরহাটে

(d) দিনাজপুরে


উত্তরঃ(b) নারকেলবেড়িয়া গ্রামে


15. তিতুমির কর্তৃক ঘোষিত সরকারের সেনাপতি ছিলেন-


(a) তিতুমির

(b) মৈনুদ্দিন

(c ) গোলাম মাসুম

(d) সৈয়দ আহমেদ


উত্তরঃ(c ) গোলাম মাসুম


16. বাংলায় তরিকা-ই-মহম্মদীয়ার ভাবধারা প্রচার করেন-


(a) টিপু শাহ

(b) তিতুমির

(c ) হাজি শরিয়ত উল্লাহ

(d) দুদু মিঞা


উত্তরঃ(b) তিতুমির


17. 'তারিকা-ই-মহম্মদীয়া' কথার অর্থ হল-


(a) মহম্মদের ধর্ম

(b) মহম্মদের নির্দেশ

(c ) মহম্মদের বাণী

(d) মহম্মদের পথ


উত্তরঃ(d) মহম্মদের পথ


18. বারাসাত বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন-


(a) দুদু মিঞা

(b) দিগম্বর বিশ্বাস

(c ) তিতুমির

(d) বিরসা মুন্ডা 


উত্তরঃ(c ) তিতুমির


19. পাগলপন্থী বিদ্রোহের নেতা ছিলেন


(a) সুই মুন্ডা

(b) ঝিন্দরাই মানকি

(c ) করিম শাহ

(d) কানু


উত্তরঃ(c ) করিম শাহ


20. পাগলপন্থী বিদ্রোহ হয়েছিল-


(a) ময়মনসিংহ অঞ্চলে

(b) ছোটোনাগপুর অঞ্চলে

(c ) খান্দেশ অঞ্চলে

(d) ফরিদপুরে


উত্তরঃ(a) ময়মনসিংহ অঞ্চলে


TOPIC (B)  ধর্ম-প্রভাবিত বিদ্রোহ

ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1 ঔপনিবেশিক ভারতে আদিবাসী ও কৃষকবিদ্রোহগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ ঔপনিবেশিক ভারতে আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহ-

ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে ঔপনিবেশিক শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদে বেশ কয়েকটি আদিবাসী ও কৃষকবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় নীচে উল্লেখ করা হল-

[1] সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ: উত্তর ভারত থেকে আসা সন্ন্যাসী ও ফকিররা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্রোহ চালায়। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ভবানী পাঠক, চিরাগ আলি, মজনু শাহ প্রমুখ।

[2] চুয়াড় বিদ্রোহ: মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার কিছু অংশে আদিবাসী চুয়াড় সম্প্রদায় বসবাস করত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের স্থানীয় জমিদারদের ওপর অত্যাচার চালালে জমিদারদের পক্ষ নিয়ে এই চুয়াড় সম্প্রদায়ের লোকেরা বিদ্রোহ করে। এটি ইতিহাসে 'চুয়াড় বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ প্রথম পর্যায়ে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়।

[3] সন্দীপ বিদ্রোহ: বঙ্গোপসাগরের বুকে কয়েকটি ছোটোবড়ো দ্বীপ নিয়ে সন্দীপ অঞ্চলটি গড়ে উঠেছিল। এখানে দরিদ্র জনগণ ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগী গোকুল ঘোষালের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা সন্দীপ বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

[4] বারাণসী বিদ্রোহ: অযোধ্যার নবারের অধীনস্থ বারাণসীর জায়গিরদার ছিলেন বলবন্ত সিং। বলবন্তের পুত্র চৈত্য সিংহের আমলে এখানকার নির্যাতিত কৃষকরা ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যা বারাণসী বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

[5] রংপুর বিদ্রোহ: দেবী সিংহ নামে জনৈক ব্যক্তি ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে সরকারের কাছ থেকে দিনাজপুর, রংপুর ও এদ্রাকপুর পরগনার ইজারা নেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেবী সিংহ কৃষকদের ওপর ভয়ানক। শোষণ ও অত্যাচার শুরু করলে তার বিরুদ্ধে কৃষকরা ১৭৮৩ খ্রিস্টায়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এটি রংপুর বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

[6] পলিগার বিদ্রোহ: পলিগার জাতি দক্ষিণ ভারতে বেলারি, কুর্ণল কুডাপ্পা, অনন্তপুর প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করত। পলিগাররা ব্রিটিশ কোম্পানি ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ শুরু করে জ পলিগার বিদ্রোহ (১৭৮৩-১৮০৫ খ্রি.) নামে পরিচিত।

[7] পাইক বিদ্রোহ: বাংলা ও উড়িষ্যার পাইকরা ছিল জমিদারদের অস্ত্রবাহক ও শান্তিরক্ষক। তারা বিদ্যাধর মহাপাত্রের নেতৃত্বে, ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা পাইর বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

[৪] ভিল বিদ্রোহ: গুজরাট, মহারাষ্ট্র-সহ পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিল উপজাতির কৃষকদের ওপর ব্রিটিশ কোম্পানি শোষণ ও অত্যাচার চালালে তারা ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শক্তিশালী বিদ্রোহ সংগঠিত করে। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ভিলরা ১৮২৫, ১৮৩৬ ও ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে আবার বিদ্রোহ করে।

[9] ফরাজি আন্দোলন: ফরিদপুর জেলার হাজি শরিয়ত উল্লাহ ইসলাম ধর্মসংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে 'ফরাজি' নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। এই আন্দোলন ক্রমে ইংরেজ কোম্পানি ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়ে ফরিদপুর, ঢাকা, খুলনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। হাজি শরিয়ত উল্লাহের পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞা এবং পরে দুদু মিঞার পুত্র নোয়া মিঞা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। 

[10] পাগলপন্থী বিদ্রোহ: ময়মনসিংহ জেলার শেরপুরের রাজবংশী, হাজং, হাত্রি, দালু এবং মুসলমান-সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৮২৫-২৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ শুরু করে। এতে নেতৃত্ব দেন ফকির করিম শাহের পুত্র টিপু শাহ।

11] ওয়াহাবি আন্দোলন ও বারাসাত বিদ্রোহ: তিতুমিরের নেতৃত্বে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ২৪ পরগনা, নদিয়া, যশোহর, ঢাকা, রাজশাহি, মালদহ প্রভৃতি জেলায় শক্তিশালী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে যা ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। তিতুমির এই সময় বারাসাতে এক বাঁশের কেল্লা তৈরি করে সেখান থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি, জমিদার ও মহাজনদের মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রাণ দেন। এটি বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

[12] কোল বিদ্রোহ: ছোটোনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী কোলদের ওপর ব্রিটিশ কোম্পানির অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ ও অত্যাচার নেমে আসে। এর বিরুদ্ধে কোলরা ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা কোল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

[13 ] সাঁওতাল বিদ্রোহ: ছোটোনাগপুর, পালামৌ, সিংভূম, মানভূম, বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী সাঁওতালরা ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্রিটিশ কোম্পানি, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এটি সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, বীর সিং, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখের নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে।

[14] নীল বিদ্রোহ: নীলকর সাহেবরা নদিয়া, যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর, মুরশিদাবাদ, রাজশাহি, মালদহ, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলার চাষিদের নীলচাষে বাধ্য করলে এবং তাদের ওপর চরম নির্যাতন চালালে চাষিরা ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তীব্র আন্দোলন সংগঠিত করে। এটি নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন দিগম্বর বিশ্বাস, বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস, মেঘাই সর্দার, বিশ্বনাথ সর্দার প্রমুখ।

[15] মোপালা বিদ্রোহ: দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূল অঞ্চলে বসবাসকারী কৃষিজীবী মোপালারা জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ সংগঠিত করে তা মোপালা বিদ্রোহ (১৮৭৩-৯৬ খ্রি.) নামে পরিচিত।

[16] মুন্ডা বিদ্রোহ: ছোটোনাগপুর অঞ্চলের মুন্ডা কৃষকদের ওপর ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের সহযোগী জমিদার ও মহাজনরা উৎপীড়ন চালালে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায় বিদ্রোহ করে। এটি মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৯-১৯০০ খ্রি.) নামে পরিচিত।

উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে সংগঠিত বিভিন্ন কৃষক ও উপজাতি বিদ্রোহগুলির অধিকাংশই ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ-[1] বিদ্রোহগুলি ছিল আঞ্চলিকভাবে সীমাবদ্ধ। [2] বিদ্রোহ সফল করে তোলার কোনো সঠিক পরিকল্পনা বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ করতে পারেননি। [3] বিভিন্ন স্থানের বিদ্রোহীদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। [4] জাতীয় বিদ্রোহের সঙ্গে এসব বিদ্রোহের সংযোগ ঘটেনি। [5] বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিভেদ বিদ্রোহগুলিকে দুর্বল করে দেয়।

2. সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ঐতিহাসিক তাৎপর্য কী ছিল? এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হল কেন?                   
উত্তরঃ সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের ঐতিহাসিক তাৎপর্য-

ঔপনিবেশিক ভারতে প্রথম দিকে যেসব বিদ্রোহ শুরু হয় সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ। বাংলা ও বিহারে ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই বিদ্রোহ চলে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের বিভিন্ন ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল, যেমন-

[1] বিদ্রোহীদের পরাজয়: ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ভবানী পাঠকের মৃত্যুর পর বিদ্রোহ দুর্বল হতে শুরু করে এবং চূড়ান্ত পর্বে ব্রিটিশ শক্তির কাছে বিদ্রোহীদের পরাজয় ঘটে।

[2] ব্রিটিশদের পদক্ষেপ: ব্রিটিশ শক্তি বিদ্রোহীদের পরাজিত করলেও সন্ন্যাসী ও ফকিরদের উপর অত্যাচার এবং লাগাম ছাড়া করারো পেরাশ টানতে ব্রিটিশরা বাধ্য হয়েছিল।

[3] কৃষক আন্দোলনের প্রেরণা: এই বিদ্রোহ পরবর্তীকালে কৃষক আন্দোলনগুলির প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।

[4] 'আনন্দমঠ' রচনা: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'আনন্দমঠ' উপন্যাসটি রচনা করেন। আনন্দমঠের 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি পরবর্তীকালে বিপ্লবীদের মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে।

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার কারণ-

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখালেও শেষপর্যন্ত এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার বিভিন্ন কারণ ছিল-

[1] নেতৃত্বের অভাব: বিদ্রোহের সাফল্যের জন্য যে সুযোগ্য নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজন ছিল সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহে তার যথেষ্ট অভাব ছিল।

2] উদ্দেশ্যহীনতা: বিদ্রোহের মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কী তা অনেক বিদ্রোহীরই জানা ছিল না।

[3] আধুনিক কৌশলের অভাব: বিদ্রোহীদের অস্ত্রশস্ত্র ও রণকৌশল ব্রিটিশ কোম্পানির সেনাদের তুলনায় যথেষ্ট পশ্চাদ্গামী ছিল।

[4] অন্তর্বিরোধ: বিদ্রোহী সন্ন্যাসী ও ফকিরদের মধ্যে যথেষ্ট অন্তর্বিরোধ ছিল, যা বিদ্রোহকে দুর্বল করেছিল।

মূল্যায়ন: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত করে। লেস্টার হ্যাচিনসন মনে করেন, সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ বিংশ শতকে বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রদূত ছিল।

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1 'সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ-

ভূমিকা: মুঘল আমলে উত্তর ভারতের হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বহু সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলা ও বিহারে তীর্থভ্রমণে আসত। তাদের অনেকেই এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসও শুরু করে। ব্রিটিশ আমলে কোম্পানি ও তাদের সহযোগী জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা যে বিদ্রোহ করে তা 'সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ' নামে পরিচিত।

[1] বিদ্রোহের কারণ: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি ছিল-[i] কৃষিজীবী সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর রাজস্বের বোঝা চাপানো হলে তারা অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়। [ii] তারা ইজারাদার, পত্তনিদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীর শোষণ ও অত্যাচারে ক্রমশ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। [iii] কোম্পানি তাদের তীর্থযাত্রার ওপর কর বসায়। [iv] কোম্পানি বিভিন্ন সময়ে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বাংলার মধ্যে প্রবেশের জন্য নানা বাধার সৃষ্টি করে। [v] কোম্পানি সন্ন্যাসী ও ফকিরদের দরগায় যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

[2] বিদ্রোহের প্রসার: ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলায় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহ ধীরে ধীরে ঢাকা, নাটোর, রংপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালদহ, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহ অন্তত ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে।

[3] নেতৃত্ব: প্রথমদিকে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানি প্রমুখ। বিদ্রোহের শেষদিকে মজনু শাহ, মুশা শাহ, চিরাগ আলি প্রমুখ নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।

[4] বিদ্রোহের অবসান: বিদ্রোহীরা প্রথমদিকে ব্রিটিশবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছুটা সাফল্য পেলেও পরবর্তীকালে তারা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশবাহিনী নিষ্ঠুর দমননীতির দ্বারা বিদ্রোহের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। ফলে বিদ্রোহ থেমে যায়।

উপসংহার: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রথম কৃষকবিদ্রোহ। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় শুরু হয়ে এই বিদ্রোহ বিক্ষিপ্তভাবে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।

2. সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

উত্তরঃ সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের কারণ-

ভূমিকা: ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার ঢাকা, নাটোর, রংপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল-

[1] দান হ্রাস: ব্রিটিশ সরকার বাংলার জমিদার ও কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত রাজস্বের বোঝা চাপালে সন্ন্যাসী ও ফকিররা জমিদারদের কাছ থেকে দানের পরিমাণ কম পেতে থাকে।

[2] বাংলায় প্রবেশে বাধা: সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বাংলায় প্রবেশ করতে এবং ধর্মচর্চা করতে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করা হয়। কোম্পানি দরগায় ফকিরদের যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

[3] ভূমিরাজস্ব ও কর : যেসব সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলায় স্থায়ীভারে বসবাস ও কৃষিকাজ করতে শুরু করেন তাদের ওপর সরকার। জমিদাররা ভূমিরাজস্বের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেন। ভূমিরাজ ছাড়াও তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করা হয়।

[4] রেশম ব্যাবসা: সন্ন্যাসী ও ফকিরদের অনেকেই রেশম ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের কাছ থেকে প্রায়ই কাঁচা রেশম ও রেশমি পণ্য জোর করে ছিনিয়ে নিত।

[5] শোষণ ও অত্যাচার: কোম্পানির কর্মচারী ও জমিদাররা সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর নানাভাবে শোষণ এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য যথেষ্ট উৎপীড়ন চালাত।

[6] তীর্থকর: সন্ন্যাসী ও ফকিরদের তীর্থযাত্রার ওপর সরকার কর বসায় এবং তাদের ধর্মাচরণে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করে।

[7] নির্যাতন: সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানে হয়। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে অন্তত ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয়।

[৪] মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ: ইজারাদার, পত্তনিদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীরা সন্ন্যাসী ও ফকিরদের নানাভাবে শোষণ করতে থাকে। 

উপসংহার: সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর ঘটে চলা এইসব অন্যায়ের ফলেই ক্ষুদ্ধ সন্ন্যাসী ও ফকিররা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। এই বিদ্রোহ পরবর্তী কৃষকবিদ্রোহগুলির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।

3.সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তরঃ সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের প্রসার-

ভূমিকা: ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকরা সর্বপ্রথম যে আন্দোলন গড়ে তোলে তা 'সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। ১৭৬৩ থেকে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর ধরে চলা এই বিদ্রোহ বাংলায় এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

[1] বিদ্রোহের সূচনা: ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা জেলায় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়। বিদ্রোহ শীঘ্রই নাটোর, রংপুর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, কোচবিহার, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।

[2] আক্রমণ: বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ কোম্পানির কুঠি, রাজস্ব দপ্তর, জমিদারদের বসতবাড়ি, গোলাঘর প্রভৃতি আক্রমণ করে। সাধারণ মানুষের ওপর বিদ্রোহীরা কোনো আক্রমণ চালায়নি।

[3] বিদ্রোহীদের সাফল্যঃ বিদ্রোহীদের দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। সেনাবাহিনীর প্রতিরোধে বিদ্রোহীরা বীরত্বের পরিচয় দেয়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশবাহিনী বিদ্রোহীদের কাছে পরাজিত হয়। ইংরেজ সেনাপতি ক্যাপটেন টমাস নিহত হন। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহীদের আক্রমণে ক্যাপটেন এডওয়ার্ডস নিহত হন এবং তাঁর বাহিনী বিধ্বস্ত হয়।

[4] বিদ্রোহীদের পরাজয়: ব্রিটিশবাহিনীর চরম দমনপীড়নের ফলে বিদ্রোহীরা ক্রমে পিছু হঠতে থাকে। সাংগঠনিক দুর্বলতা, অনৈকা

প্রভৃতির ফলে বিদ্রোহীরা শেষপর্যন্ত পরাজিত হয় এবং ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিদ্রোহ থেমে যায়।

উপসংহার: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বিদ্রোহ বহু ক্ষেত্রেই সংঘাতের রূপ নিয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্রোহীরা সাফল্যও পেয়েছিল। তবে প্রচণ্ড দমন-পীড়নের ফলে এই বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত সাফল্যের মুখ = দেখতে পারেনি।

4.সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

উত্তরঃ সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য-

ভূমিকা: ব্রিটিশ কোম্পানি, জমিদার ও বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীর শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন জেলার সন্ন্যাসী ও ফকিররা বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন-

[1] দীর্ঘস্থায়িত্ব: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় ৪০ বছর ধরে (১৭৬৩-১৮০২ খ্রি.) এই বিদ্রোহ চলে।

[2] কৃষকদের বিদ্রোহ: বিদ্রোহী সন্ন্যাসী ও ফকিররা একদিকে ধর্মচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিল, অন্যদিকে কৃষিকাজ করে তারা জীবিকানির্বাহ করত।

[3] হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য লক্ষ করা যায়। বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী এবং নেতৃত্বদানকারী উভয়ের মধ্যেই হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ ছিল।

[4] ব্রিটিশের বিরোধিতা: ব্রিটিশ বিরোধিতাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য। বিদ্রোহীরা ইংরেজ কোম্পানির কুঠি, রাজস্ব দপ্তর প্রভৃতি আক্রমণ করে।

[5] জমিদারের বিরোধিতা: বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগী জমিদারদের বিরুদ্ধেও তাদের বিদ্রোহ পরিচালিত করে। বিদ্রোহীরা জমিদারদের বাসভবন, গোলাঘর প্রভৃতিতে আক্রমণ চালায়।
উপসংহার: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ব্রিটিশ প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনেও ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। সমকালীন সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, মালদহ প্রভৃতি অঞ্চলের অধিবাসীরা সন্ন্যাসীদের ভয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত।

5 .সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

উত্তরঃ সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি-

ভূমিকা: ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ছিল বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন। বিভিন্ন পণ্ডিত এই বিদ্রোহের বিভিন্ন চরিত্র বা প্রকৃতি উল্লেখ করে থাকেন।

[1] সন্ত্রাসবাদী চরিত্র: লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী চরিত্র লক্ষ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই বিদ্রোহ ছিল 'হিন্দুস্থানের যাযাবর' ও 'পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব'। বি তবে হেস্টিংসের মত গ্রহণযোগ্য নয়।

[2] কৃষকবিদ্রোহ: কারও কারও মতে, এই বিদ্রোহ ছিল মূলত একটি কৃষকবিদ্রোহ। সন্ন্যাসী ও ফকিররা ধর্মচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কৃষিকাজই ছিল তাদের প্রধান পেশা। উইলিয়াম হান্টার, এডওয়ার্ড ও গ্যারাট একে 'কৃষকবিদ্রোহ' বলে অভিহিত করেছেন।

[3] স্বাধীনতার সংগ্রাম: কেউ কেউ মনে করেন, এই বিদ্রোহ ছিল বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। লেস্টার হ্যাচিনসন মনে করেন, বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বিদেশিদের হাত থেকে নিজ দেশ ও ধর্মকে রক্ষা করা।

[4] দুর্বলতা: সন্ন্যাসী ও ফকিরদের আন্তরিকতা থাকলেও তাদের সঙ্গে সমাজের বৃহত্তর অংশের সাধারণ মানুষ বিদ্রোহে শামিল হয়নি। এজন্য বিদ্রোহ কখনোই তীব্র হয়ে উঠতে পারেনি।

উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়, অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের বিদ্রোহ নিঃসন্দেহে জোরদার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতার অভাব, উন্নত যোগাযোগের অভাব, ধর্মীয় ভেদাভেদ প্রভৃতি কারণে এই বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়।

6.উনিশ শতকে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ কী ছিল?

উত্তরঃ উনিশ শতকে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ ভূমিকা: আঠারো শতকে আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-৯২ খ্রি.) নামে এক ব্যক্তি আরব দেশে ইসলাম ধর্মে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তা 'ওয়াহাবি আন্দোলন' নামে পরিচিত। আরবের অনুকরণে উনিশ শতকে বাংলায় তিতুমির ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের বিভিন্ন কারণ ছিল।

[1] ইসলামের শুদ্ধিকরণ: তিতুমির মনে করতেন, বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামধর্মে বহু কুসংস্কার প্রবেশ করেছে। এজন্য ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটিয়ে পবিত্র কোরানের নির্দেশ অনুসারে ইসলামকে পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিতুমির শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু করেন।

[2] খাজনা আদায়ে অত্যাচার: প্রথম জীবনে তিতুমির বিভিন্ন জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীতে কাজ করতেন। এই সময় তিনি খাজনা আদায়ের জন্য দরিদ্র কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখেন।

[3] সংগঠন প্রতিষ্ঠা: তিতুমির জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র মুসলিমদের নিয়ে একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। এর ফলে জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ বেধে যায়।

[4] কৃয়দেব রায়ের অত্যাচার: পুড়ার জমিদার কৃয়দেব রায় ঘোষণা করেন যে, কেউ তিতুমিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে এবং দাড়ি রাখলে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে এবং যারা তিতুমিরকে বাড়িতে স্থান দেবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে। এতে তিতুমিরের অনুগামীরা অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়।

উপসংহার: ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ইংরেজ ও তার পৃষ্ঠপোষক জমিদারদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ মুসলিমদের সশস্ত্র প্রতিবাদ। তাদের সঙ্গে হিন্দু কৃষকরা যোগ দিলে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে।

7.বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বিবরণ দাও।
অথবা, বারাসাত বিদ্রোহ সম্পর্কে কী জান? 
অথবা, টীকা লেখো: তিতমিরের বিদ্রোহ। 
অথবা, বারাসাত বিদ্রোহের বিবরণ দাও।

উত্তরঃ বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন

ভূমিকা: 'ওয়াহাবি' কথার অর্থ হল 'নবজাগরণ'। তিতুমির মক্কায় গিয়ে সৈয়দ আহমেদের কাছ থেকে ওয়াহাবি আদর্শ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি বাংলায় এসে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করেন।

[1] তিতুমিরের নেতৃত্ব: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন মির নিসার আলি বা তিতমির (১৭৮২-১৮৩১ খ্রি.)। তিনি জমিদার ও নীলকরদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র মুসলমানদের নিয়ে একটি বিরাট বাহিনী গড়ে তোলেন। এতে জমিদার ও নীলকররা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।

[2] ওয়াহাবিদের ওপর অত্যাচার: জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তিতুমিরের সংঘর্ষ শুর হলে ব্রিটিশবাহিনীও তিতুমিরের বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নেমে পড়ে। পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ঘোষণা করেন যে, কেউ তিতুমিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে বা দাড়ি রাখলে তাকে জরিমানা দিতে হবে, কেউ তিতুমিরকে বাড়িতে আশ্রয় দিলে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।

[3] কৃয়দেব রায়ের সঙ্গে সংঘর্ষ: বিভিন্ন কারণে তিতুর বাহিনীর সঙ্গে কৃষ্ণদেব রায়ের সংঘর্ষ বাধে। তিতুমির ৩০০ জন অনুগামী-সহ কৃয়দেব রায়ের বাড়ি আক্রমণ করলে সংঘর্ষে হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয় এবং বহু পুরোহিত নিহত হন।

[4] নিজেকে 'বাদশাহ' ঘোষণা: তিতুমির বারাসাত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজেকে 'বাদশাহ' বলে ঘোষণা করেন। তাঁর শাসনের প্রধানমন্ত্রী হন মৈনুদ্দিন এবং সেনাপতি হন গোলাম মাসুম। তিনি নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা তৈরি করে সেখানে তাঁর সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন স্থানের জমিদারদের কাছে কর দাবি করেন। এই ঘটনা 'বারাসাত বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। ২৪ পরগনা, নদিয়া, ঢাকা, খুলনা, যশোহর, রাজশাহি, মালদহ-সহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় তিতুমিরের আন্দোলন প্রসারিত হয়।

[5] পরাজয়: জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ কোম্পানির মিলিত বাহিনী ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিতুমিরের বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং কামানের আঘাতে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা ধ্বংস করে দেয়। তিতুমির ও তাঁর কয়েকজন অনুগামী যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো মৃত্যু বরণ করেন (১৯ নভেম্বর, ১৮৩১ খ্রি.)।

উপসংহার: তিতুমিরের নেতৃত্বাধীন ওয়াহাবি আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘর্ষে তিতুমিরের মৃত্যু হয়। তাঁর অসংখ্য অনুগামী ইংরেজদের হাতে বন্দি হয়। এর ফলে বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

'ওয়াহাবি' কথার অর্থ হল 'নবজাগরণ'। আবদুল জেনে রাখো ওয়াহাব (১৭০৩-৯২ খ্রি.) নামে জনৈক ব্যক্তি আঠারো শতকে আরব দেশে ইসলাম ধর্মে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তা 'ওয়াহাবি আন্দোলন' নামে পরিচিত। ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির বাসিন্দা সৈয়দ আহমেদ (১৭৮৬-১৮৩১ খ্রি.)।

8.বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

উত্তরঃ বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য-

ভূমিকা: উনিশ শতকে তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় মুসলিমদের মধ্যে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় তা ওয়াহাবি আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যেমন-

[1] শুদ্ধিকরণ: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছি মুদিলার্মের কুসংস্কারগুলি দুর করা এবং পবিত্র কোরান-নির্দেশিত প ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটানো।

[2] জমিদার-বিরোধিতা: ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল অত্যাচারী জমিদার নীলকর ও মহাজনদের আধিপত্য ধ্বংস করা।

[3] ব্রিটিশবিরোধিতা: ইংরেজ কোম্পানি যেহেতু বাজে অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের রক্ষাকর্তা ছি সেহেতু ওয়াহাবি আন্দোলন শীঘ্রই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পরিচ্ছ হয়।

[4] স্বাধীনতা: ওয়াহাবি আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বিদেশি ব্রিটি শাসন ও দেশীয় জমিদারদের আধিপত্য ধ্বংস করে স্বাধীনতা এক নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা।

উপসংহার: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের শুরু থেকেই এই আন্দোলনে মুসলিম প্রাধান্য ছিল। কারণ ইসলামের আদর্শের ভিত্তিতেই ওয়াহসি আন্দোলন শুরু হয়। তথাপি বহু নির্যাতিত ও দরিদ্র নিম্নবর্ণের হিন্দুর মুসলিমদের সঙ্গে এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।

9.উনিশ শতকে বাংলা দেশে ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল? অথবা, তিতুমিরের নেতৃত্বে বারাসাত বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ছিল? 

উত্তরঃ উনিশ শতকে বাংলা দেশে ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব-

ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমিরের নেতৃত্বে একইসঙ্গে বিদেশি ইংরেজ শাসন এবং দেশীয় জমিদারদের বিরূদে লড়াই শুরু হয়। ড. শশীভূষণ চৌধুরীর মতে, "এই আন্দোলন ছিল জমিদার বিরোধী ও ব্রিটিশ সরকার-বিরোধী গণসংগ্রাম।'

[1] জমিদার-বিরোধিতা: বারাসাত বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল পুড়ার জমিদার কৃয়দেব রায়ের সঙ্গে তিতুমিরের বাহিনীর সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। তিতুমির হিন্দু-মুসলিম উভয় শ্রেণির জমিদারদের বিরুদ্ধে তাঁর অনুগামীদের ঐক্যবদ্ধ করেন। তাই ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন "তিতুমিরের সংগ্রাম ছিল জমিদারের বিরুদ্ধে।"

[2] ব্রিটিশবিরোধিতা: বারাসাত বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে শুর হলেও শেষপর্যন্ত তা ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহে পরিণত হয়। বারাসাত বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা করে তিতুমির নিজেকে 'বাদশাহ' বলে ঘোষণা করেন। ড. শশীভূষ চৌধুরী বলেছেন যে, “এই আন্দোলন ছিল প্রবলভাবে ব্রিটিশবিরোধী।"

[3] কৃষক ঐক্য: ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল কৃষক ঐক্যের একটি মূর্ত প্রতীক। মুসলিম কৃষকরা ছিল এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি। ড বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন, "এই বিদ্রোহ হল ধর্মীয় আদশে অনুপ্রাণিত এক কৃষকবিদ্রোহ।”

[4] নিম্নবর্গের শ্রেণিসংগ্রাম: তিতুমিরের ডাকে সমাজের নিম্নবর্ণের দরিদ্র মানুষ বারাসাত বিদ্রোহে শামিল হয়। বহু দরিদ্র হিন্দু কৃষকর এই আন্দোলনকে সমর্থন করে।

উপসংহার: ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিতুমির দরিদ্র, সাধারণ কৃষকদের রাজনৈতিক সংগ্রামের আঙিনায় আনতে সক্ষম হন। ড. রণজিৎ গুহও মনে করেন যে, ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল নিম্নবর্গের মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই।
 
সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1.বাংলায় ধর্মের ছত্রছায়ায় সংঘটিত কয়েকটি কৃষক-বিদ্রোহর নাম লেখো।

উত্তরঃ বাংলায় ধর্মের ছত্রছায়ায় সংঘটিত কয়েকটি কৃষকবিদ্রোহ হল- [1] সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০ খ্রি.), [2] ওয়াহাবি আন্দোলন (১৮৩১ খ্রি.) [3] ফরাজি আন্দোলন (১৮২০-৬২ খ্রি.) [4] পাগলপন্থী আন্দোলন (১৮২৫-৩৩ খ্রি.) প্রভৃতি।

2 .সন্ন্যাসী ও ফকিরদের পরিচয় দাও।

উত্তরঃ  মুঘল আমলে উত্তর ভারতের হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বহু ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন অংশে তীর্থভ্রমণে আসতেন। তাঁদের অনেকেই বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং কৃষিকাজের দ্বারা জীবিকানির্বাহ করেন। ব্রিটিশদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ শুরু করেন।

3 .সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থ হল কেন?

উত্তরঃ সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০ খ্রি.) ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণগুলি ছিল [1] এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকেই বাংলার বাইরে থেকে এসেছিলেন। তাই বাংলায় তাদের জনভিত্তি ছিল দুর্বল। [2] এই বিদ্রোহ শুরু থেকেই ক্ষুদ্র অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। [3] সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এই বিদ্রোহ জনপ্রিয় হতে পারেনি। শুরু থেকেই তা দুর্বল ছিল।

4. কোন্ প্রেক্ষাপটে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ঘটেছিল?

উত্তরঃ মুঘল আমল থেকে উত্তর ভারতে তীর্থ করতে আসা বহু সন্ন্যাসী ও ফকির বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস এবং কৃষিকাজ শুরু করেছিলেন। তাদের ওপর ইংরেজ কোম্পানি এবং তাদের সহযোগী জমিদাররা শোষণ ও নির্যাতন শুরু করে। এর বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ঘটেছিল।

5. কোন্ আন্দোলন 'ওয়াহাবি আন্দোলন' নামে পরিচিত?

উত্তরঃ আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-৯২ খ্রি.) নামে জনৈক ব্যক্তি অষ্টাদশ শতকে আরব দেশে ইসলাম ধর্মে যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তা সাধারণভাবে 'ওয়াহাবি আন্দোলন' নামে পরিচিত।

6. কী উদ্দেশ্যে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয়েছিল?

উত্তরঃ [ [1] ইসলাম ধর্মের সংস্কারসাধন, [2] জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া প্রভৃতি উদ্দেশ্যে অষ্টাদশ শতকে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয়।

7.তিতুমির স্মরণীয় কেন?

উত্তরঃ তিতুমির ছিলেন বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা। তিনি দরিদ্র ও নির্যাতিত মুসলিমদের নিয়ে অত্যাচারী জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন এবং বারাসাত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা করেন। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি নিহত হন।

8.তিতুমিরের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতির নাম কী?

উত্তরঃ তিতুমিরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাঁর বিশিষ্ট অনুগামী মৈনুদ্দিন। আর তিতুমিরের সেনাপতি ছিলেন গোলাম মাসুম।

9. তিতুমিরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন কতদূর প্রসারিত হয়? 

উত্তরঃ তিতুমিরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন ২৪ পরগনা, নদিয়া, যশোহর, মালদহ, রাজশাহি, ঢাকা প্রভৃতি জেলায় প্রসারিত হয়।

10. কৃয়দেব রায় তিতুমিরের অনুগামীদের ওপর কীভাবে অত্যাচার চালান? এর পরিণতি কী হয়েছিল?
অথবা, জমিদার কৃয়দেব রায় সম্পর্কে কী জান?

উত্তরঃ পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ঘোষণা করেন যে, কেউ তিতুমিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলে এবং দাড়ি রাখলে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে। যারা তিতুমিরকে বাড়িতে স্থান দেবে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।

কৃষ্ণদেবের অত্যাচারে ক্ষুদ্ধ হয়ে তিতুমির ৩০০ জন অনুগামী নিয়ে কৃয়দেব রায়ের বাড়ি আক্রমণ করেন। সংঘর্ষে বেশ কিছু মানুষ হতাহত হন, মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং ঘরবাড়ি লুণ্ঠিত হয়।

11. কোন্ ঘটনা 'বারাসাত বিদ্রোহ' নামে পরিচিত?
অথবা তিতুমিরের স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কী জান?

উত্তরঃ ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা তিতুমির বারাসাত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘোষণা করেন। তিনি নিজেকে বাদশাহ' ঘোষণা করেন এবং মৈনুদ্দিন-কে প্রধানমন্ত্রী ও গোলাম মাসুম-কে সেনাপতি নিয়োগ করেন। তিনি নারকেলবেড়িয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা তৈরি করে তাঁর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন স্থানের জমিদারদের কাছে কর ত দাবি করেন। এই ঘটনা বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

12. কোন্ ব্রিটিশ শাসক কবে তিতুমিরের বিরুদ্ধে অভিযান করেন? এর ফল কী হয়েছিল?
উত্তরঃ ভারতের ব্রিটিশ বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিতুমিরের বিরুদ্ধে অভিযান করেন।

ব্রিটিশ ও জমিদারদের মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিতুমিরের বাহিনী পরাজিত হয়। ইংরেজদের কামানের আঘাতে তাঁর বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয় এবং তিতুমির যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যান।

13. ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তিতুমিরের যুদ্ধের কী পরিণাম হয়?

উত্তরঃ ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে-[1] তিতুমিরের বাহিনী পরাজিত হয়। [2] তিতুমির ও তাঁর কয়েকজন অনুগামী প্রকাশ্য যুদ্ধে প্রাণ দেন (১৮৩১ খ্রি.)। [3] তাঁর বাঁশের কেল্লা কামানের গোলার আঘাতে ধ্বংস হয়। [4] বহু বিদ্রোহীর ফাঁসি বা দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড হয়।

14.তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল? 

উত্তরঃ তিতুমিরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল-[1] হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নেয়। [2] বিদ্রোহের তীব্রতায় জমিদার ও মহাজনরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। [3] আন্দোলনে পবিত্র কোরানের আদর্শে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলে হিন্দুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

15 হাজি শরিয়ত উল্লাহর ধর্মীয় আদর্শ কী ছিল?

উত্তরঃ হাজি শরিয়ত উল্লাহর ধর্মীয় আদর্শ ছিল-[1] ইসলাম-বিরোধী বিভিন্ন কুসংস্কার ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করে ধর্মকে অপবিত্র করেছে। [2] একেশ্বরবাদ, সামাজিক সাম্য-সহ কোরানের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করে ধর্মকে পবিত্র করতে হবে।

16. পাগলপন্থী কাদের বলা হয়?

উত্তরঃ উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ফকির করিম শাহ (বা চাঁদ গাজী) ময়মনসিংহ জেলার সুসঙ্গপুর-শেরপুর অঞ্চলে গারোদের মধ্যে এক নতুন ধর্মমত প্রচার করেন। এই ধর্মের অনুরাগীরা 'পাগলপন্থী' নামে পরিচিত।

17.পাগলপন্থী বিদ্রোহের কারণ কী ছিল?

উত্তরঃ পাগলপন্থী বিদ্রোহের কারণ ছিল-[1] ময়মনসিংহ জেলার গারোদের ওপর রাজস্ববৃদ্ধি, [2] কোম্পানি কর্তৃক ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের ব্যয়ের অর্থ আদায়ের জন্য গারোদের ওপর করের বোঝা বৃদ্ধি, [3] জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার প্রভৃতি।

18. কারা ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন এবং কারা এই আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন?

উত্তরঃ দিল্লির মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩-৬২ খ্রি.) এবং তাঁর পুত্র আজিজ ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন। সৈয়দ আহমেদ ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

19 .সৈয়দ আহমেদের আদর্শ কী ছিল?

উত্তরঃ সৈয়দ আহমেদ ব্রিটিশ শাসিত ভারতকে 'দার-উল-হারব' অর্থাৎ 'বিধর্মীর দেশ' বলে অভিহিত করেন। তিনি তাঁর অনুগামীদের ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে এদেশকে 'দার-উল-ইসলাম' বা পবিত্র ইসলামের দেশে পরিণত করার নির্দেশ দেন।

20. বালাকোটের যুদ্ধ কবে, কাদের মধ্যে হয়েছিল? এই যুদ্ধের কী পরিণতি হয়?

উত্তরঃ ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের শিখ জাতি ও ওয়াহাবি আন্দোলনে নেতা সৈয়দ আহমেদের মধ্যে বালাকোটের যুদ্ধ হয়েছিল।

বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহমেদ পরাজিত ও নিহত হন।

21. ফরাজি ও ওয়াহাবি কথার অর্থ কী?

উত্তরঃ 'ফরাজি' কথার অর্থ হল 'ইসলাম নির্ধারিত বাধ্যতামূলক কর্তব 'আল্লাহর আদেশ'।

'ওয়াহাবি' কথার অর্থ হল 'নবজাগরণ'।

22. ফরাজি আন্দোলন কি ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আন্দোলন?

উত্তরঃ বাংলায় ইসলামের শুদ্ধিকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হওয়া ফরাজি আন্দোলনে মুসলিমদেরই সর্বাধিক অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। তাই একে মুসলিমদের ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আন্দোলন বলে উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে আন্দোলনে জমিদার, নীলকর ও ইংরেজদের বিরোধিতার বিষয়ট আন্দোলনের রাজনৈতিক রূপটিকেও স্পষ্ট করে তোলে।

23. ফরাজি আন্দোলন কি নিছক ধর্মীয় আন্দোলন ছিল?

উত্তরঃ ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি শুধুই ধর্মীয় ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন যে, এটি নিছকই হিন্দুবিরোধী এবং ধর্মীয় আন্দোলন ছিল। তবে নরহরি কবিরাজ, অভিজিত দত্ত প্রমুখ ইতিহাসবিদ ধর্মীয় আন্দোলনের পাশাপাশি ফরাজি আন্দোলনে কৃষকশ্রেণির ব্যাপক অংশগ্রহণ, তীব্র ব্রিটিশ বিরোধিতা প্রভৃতিও লক্ষ করেছেন।

24. ফরাজি আন্দোলনের সূত্রপাত কার উদ্যোগে, কেন হয়েছিল?

উত্তরঃ ফরাজি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল হাজি শরিয়তের উদ্যোগে। ফরাজি আন্দোলন শুরু হওয়ার কারণ হল আন্দোলনকারীরা- [1] ব্রিটিশ- ভারতকে 'দার-উল-হারব' বা 'বিধর্মীর দেশ' থেকে 'দার-উল-ইসলাম' বা 'ইসলামের পবিত্রভূমি'-তে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। [2] জমিদার ও নীলকরদের শোষণের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল।

25. ফরাজি আন্দোলনে শরিয়ত উল্লাহর মতাদর্শ কী ছিল? 

উত্তরঃ ফরাজি আন্দোলনে শরিয়ত উল্লাহর মতাদর্শ ছিল-[1] ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারত 'দার-উল-হারব' বা বিধর্মীর দেশে পরিণত হয়েছে। এই দেশ মুসলিমদের বাসযোগ্য নয়। [2] তিনি ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম আদর্শগুলি মেনে চলার জন্য আহ্বান জানান। [3] তিনি নির্দেশ দেন কোরানের একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে কলমা, রোজা, হজ প্রভৃতি পালন করতে।
 
 ঠিক বা ভুল নির্ধারণ করো

1. উত্তর ভারত থেকে বাংলায় আসা সন্ন্যাসী ও ফকিররা ফিরে যাওয়ার সময় জমিদার-ভূস্বামীদের কাছ থেকে অনুদান লাভ করতেন।

উত্তরঃ ঠিক।

2. তিতুমিরের ওয়াহাবি আন্দোলনে কোনো হিন্দু শামিল হয়নি।

উত্তরঃ ভুল ।

3. বাঁশের কেল্লা পাবনা বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

উত্তরঃ ভুল ।

4. শরিয়ত উল্লাহ ভারতবর্ষকে 'দার-উল-ইসলাম' বা 'ইসলামের দেশ' হিসেবে ঘোষণা করেন।

উত্তরঃ ভুল ।

5. তরিকা-ই-মহম্মদীয়া ছিল একটি মুসলিম পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন।

নির্ধারণ করো
উত্তরঃ ঠিক।

6. পাগলপন্থী বিদ্রোহের প্রতিষ্ঠাতা হলেন টিপু। 

উত্তরঃ ঠিক।

7. পাগলপন্থী বিদ্রোহের নেতা ছিলেন করিম শাহ। 

উত্তরঃ ঠিক।

৪. পাগলপন্থী আন্দোলন প্রথম পর্বে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয় পর্বে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়।

উত্তরঃ ঠিক।

9. আবদুল ওয়াহাব বাংলা দেশে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন। 

উত্তরঃ ভুল ।

10. ফরাজি আন্দোলনের চরিত্র একমাত্র ধর্মীয়।

উত্তরঃ ভুল ।

11. ফরাজি একটি প্রাচীন উপজাতির নাম।

উত্তরঃ ভুল ।

12. ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম ছিল 'তারিকা-ই-মহম্মদীয়া'।

উত্তরঃ ঠিক।

13. ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলন বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত ছিল।

উত্তরঃ ভুল ।

14. মির নিসার আলি বাঁশের কেল্লা বানিয়েছিলেন।

উত্তরঃ ঠিক।

শূন্যস্থান পূরণ করো

1. ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে অন্তত ১৫০ জন____হত্যা করা হয়।

উত্তরঃ ফকিরকে ।

2. চিরাগ আলি ও মজনু শাহ যুক্ত ছিলেন____বিদ্রোহের সঙ্গে।

উত্তরঃ সন্ন্য়াসী ও ফকির।
 
3. পুঁড়ার জমিদার_____তিতুমিরের অনুগামীদের দাড়ির ওপর কর ধার্য করেন।

উত্তরঃ কৃষ্নদেব বায়।

4. তিতুমির নিজেকে_____বলে ঘোষণা করেন।

উত্তরঃ বাদশাহ।

5._____এর মৃত্যুর পর ফরাজি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন দুদু মিঞা।

উত্তরঃ হাজি শরিয়ত উল্লাহ ।

6._____পঞ্চায়েত গঠনের মাধ্যমে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।

উত্তরঃ দুদু মিঞা।

7. সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের একজন নেতা ছিলেন_____।

উত্তরঃ ভবানী পাঠক ।

8. ফকির করিম শাহ (বা চাঁদ গাজী) _____প্রচার করেন। মধ্যে এক নতুন ধর্মম।

উত্তরঃ গারোদের।

9. করিম শাহের মৃত্যুর পর পাগলপন্থী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন____।

উত্তরঃ টিপু শাহ।

10. পাগলপন্থী বিদ্রোহীরা_____'স্বাধীন সুলতান' বলে ঘোষণা করে।

উত্তরঃ টিপুকে।

11. বালাকোটের যুদ্ধে নিহত হন_____।

উত্তরঃ সৈয়দ আহমেদ।

12. 'ওয়াহাবি' বলতে বোঝায়______।

উত্তরঃ নবজাগরণ ।


    👉Paid Answer (for Membership User)


Editing By:- Lipi Medhi



1. উত্তরহীন প্রশ্ন ও উত্তর সেখানে দেখা যাবে

2 বিনামূল্যে উত্তর পান থেকে এটি প্রয়োগ করুন 

3. এটি পণ্য কোড (Product Code) ব্যবহার করুন :  DAM000059