উত্তর: বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রধান ধারাসমূহ
ভূমিকা: বাংলা ছিল ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের পীঠস্থান। ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতির শক্তি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ অর্থাৎ বাংলা প্রদেশ দ্বিখণ্ডিত করলে এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা ছিল। যেমন-
[1] বয়কট: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে বিলাতি সামগ্রী বর্জন ও বিদেশি সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা শুরু হয়। এই ধারা 'বয়কট' আন্দোলন নামে পরিচিত।
[2] স্বদেশি: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে বিলাতি পণ্য বর্জন করে তার পরিবর্তে স্বদেশি পণ্য ব্যবহার ও প্রসার, স্বদেশি শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই ধারা স্বদেশি আন্দোলন নামেপরিচিত।
[3] জাতীয় শিক্ষা: আন্দোলনকারীরা ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা- প্রতিষ্ঠানগুলি ত্যাগ করতে শুরু করে। পাশাপাশি, সম্পূর্ণ দেশীয় উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
[4] বিপ্লবী কার্যকলাপ: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে গুপ্ত-বিপ্লবী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের শেষপর্বে আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, “প্রকাশ্যে কংগ্রেসের মাধ্যমে এবং গোপনে বিপ্লবীদের মাধ্যমে অরবিন্দ যুগপৎ আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন। তার অনুসারীরা পুরোপুরি সন্ত্রাসবাদে ঝুঁকে পড়ে।
2. অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০ খ্রি.) সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তর: অহিংস অসহযোগ আন্দোলন
ভূমিকা: নানা পরিস্থিতিতে কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ-বিরোধী অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।
[1] কারণ: অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পিছনে প্রধান কারণগুলি ছিল-[i] প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন লাভে ব্যর্থতা, [ii] দেশজুড়ে মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, খাদ্যাভাব, [iii] দমনমূলক রাওলাট আইন পাস, [iv] জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, [v] ব্রিটিশ শক্তি কর্তৃক তুরস্কের ব্যবচ্ছেদ ও তুরস্কের সুলতানের (খলিফা) ক্ষমতা হ্রাস প্রভৃতি।
[2] আন্দোলনের সূচনা: ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। গান্ধিজি 'স্বরাজ' অর্জনকে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপরই সারা দেশে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
3] আন্দোলনের প্রসার: অসহযোগ আন্দোলনে ইতিবাচক অর্থাৎ গঠনমূলক এবং নেতিবাচক অর্থাৎ ধ্বংসাত্মক উভয় ধরনের কর্মপন্থা গ্রহণ করা হয়। একদিকে বিলিতি পণ্য, সরকারি স্কুলকলেজ, আদালত, আইনসভা প্রভৃতি বর্জন শুরু হয়, অন্যদিকে দেশীয় পণ্যের প্রসার, দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়, হিন্দু- মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেওয়া হয়।
[4]নেতৃত্ব: চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু, বিঠলভাই প্যাটেল, বল্লভভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, সীতারামাইয়া প্রমুখ অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলেন।
[5] আন্দোলন প্রত্যাহার: ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা গ্রামে উত্তেজিত জনতা থানায় আগুন লাগিয়ে ২২ জন পুলিশকে হত্যা করলে অহিংস মতাদর্শে বিশ্বাসী গান্ধিজি আন্দোলন প্রত্যাহার (২৫ ফেব্রুয়ারি) করে নেন।
উপসংহার: গান্ধিজি চৌরিচৌরার ঘটনার ফলে আন্দোলন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। কেউ কেউ একে 'জাতীয় বিপর্যয়', 'পর্বতপ্রমাণ ভুল' প্রভৃতি বলে অভিহিত করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতি গান্ধিজির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে।
3. বিশ শতকে কংগ্রেসের আন্দোলনের সঙ্গে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলনের সম্পর্ক উল্লেখ করো।
উত্তর: কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক
ভূমিকা: বিশ শতকের শুরুর দিকে ভারতে কৃষক, শ্রমিক এবং বামপন্থী আন্দোলনেরও প্রসার ঘটে।
[1] আন্দোলনে কংগ্রেসের নেতৃত্ব: বিশ শতকে ভারতে
[i] বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন (১৯০৫ খ্রি.) [ii] অহিংস অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০ খ্রি.) [iii] আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০ খ্রি.) [iv] ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২ খ্রি.)- এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে কংগ্রেস সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
[2] কৃষক আন্দোলন: বিশ শতকে ভারতের জাতীয় আন্দোলনগুলিতে কৃষক সম্প্রদায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তারা সরকারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে। কংগ্রেস দলও কৃষকদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করে।
3] শ্রমিক আন্দোলন: কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন আন্দোলনে দেশের শ্রমিকরা অংশগ্রহণ করে কংগ্রেসের আন্দোলনকে জোরালো করে তোলে। কংগ্রেসি আন্দোলনের বাইরেও শ্রমিকরা ধর্মঘট, বিক্ষোভ, হরতাল প্রভৃতিতে যুক্ত হয়। কংগ্রেস এসব আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়।
4] বামপন্থী আন্দোলন: বিশ শতকের দুইয়ের দশক থেকে ভারতে বামপন্থী ও কমিউনিস্ট ভাবধারা এবং আন্দোলনের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। দেশের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির ওপর কমিউনিস্ট দলের সর্বাধিক প্রভাব ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু প্রমুখের উদ্যোগে কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও বামপন্থী ভাবধারা জনপ্রিয় হয়।
5] কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি: বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে মতভেদ লক্ষ করা যায়।
4.*টীকা লেখো: মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা।
উত্তর : মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২১-৩৩ খ্রি.)
ভূমিকা: ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পর ভারতে দ্রুতগতিতে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রসার ঘটতে থাকে।
[1] কমিউনিস্টদের প্রসার: ১৯২০-এর দশকের শুরু থেকে ভারতের কমিউনিস্টরা দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্বে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক যোগ দেয় এবং পূর্ণ স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়।
[2] সরকারের উদ্বেগ: কমিউনিস্ট ভাবধারা ও কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের দ্রুত প্রসারে সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টদের দমন ও শ্রমিক আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতাকে জড়িয়ে দেয়।
3] মামলার রায়: ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায় প্রকাশিত হয়। মামলায় ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে অভিযুক্ত করা হয়। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফফর আহমেদ, শিবনাথ ব্যানার্জি, ধরণী গোস্বামী, এস এ ডাঙ্গে, পি সি জোশী, ফিলিপ স্প্যাট, গঙ্গাধর অধিকারী প্রমুখ। মামলার রায়ে কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্টদের যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ হয়।