অধ্য়ায়-৪ 

সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথাঃ বৈশিষ্ট্য় ও বিশ্লেষণ
---------------------------------------------------------

 TOPIC (A) ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ 

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণগুলি কী ছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণ-

ভূমিকা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন-

[1] স্বত্ববিলোপ নীতি: লর্ড ডালহৌসি তাঁর স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা একে একে ঝাঁসি, সাতারা, নাগপুর, সম্বলপুর-সহ বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য দখল করেন। ফলে ওইসব রাজ্যের শাসকরা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

[2] রাজপ্রাসাদ লুন্ঠন: ব্রিটিশরা কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা ও নাগপুরের রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন করে। এর ফলে এসব রাজ্যের শাসকরা ক্ষুদ্ধ হয়।

 [3] ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের অত্যাচার: উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ রাজকর্মচারীরা তাদের অধস্তন ভারতীয় কর্মচারীদের ঘৃণা ও অবজ্ঞা করত। ভারতীয় কর্মচারীরা কারণে-অকারণে ব্রিটিশ কর্মচারীদের কাছে হেনস্থার শিকার হত। অত্যাচারিত এই ভারতীয়দের মনে এভাবে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

[4] ব্রিটিশ-আশ্রিত রাজ্যে ক্ষোভ: ব্রিটিশ সরকার ত্রিবাঙ্কুর-সহ ব্রিটিশ আশ্রিত কয়েকটি রাজ্যের সেনাদের ভাতা কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে তারা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়।
উপসংহার: এতে সন্দেহ নেই যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল রাজনৈতিক। রাজনৈতিক অধিকারচ্যুত বিভিন্ন ভারতীয় শাসক ও তাঁদের অধীনস্থ জনগণের ক্ষোভ এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।

2. ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণগুলি কী ছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণ- 

ভূমিকা: ড. এ আর দেশাই বলেছেন যে, "১৮৫৭-র বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনে নির্যাতিত বিভিন্ন শ্রেণির অসন্তোষের ফল।" এই বিদ্রোহের প্রধান অর্থনৈতিক কারণগুলি ছিল নিম্নরূপ-

[1] অর্থ-সম্পদ লুন্ঠন: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অর্থ ও সম্পদ একনাগাড়ে লুণ্ঠন করলে দেশীয় রাজ্যগুলির রাজকোশ শূন্য হয়ে পড়ে। দেশের আর্থিক দুর্দশা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

[2] অবশিল্পায়ন: ব্রিটিশ কোম্পানির শোষণমূলক শিল্প ও বাণিজ্যনীতির ফলে ভারতে অবশিল্পায়ন ঘটে। ব্রিটিশ শিল্পজাত পণ্য বিনাশুল্কে ভারতে ঢুকলে দেশীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

[3] বেকারত্ব বৃদ্ধি: ভারতের বস্ত্রশিল্প-সহ বিভিন্ন কুটিরশিল্প ধ্বংস হলে এসব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক ও কারিগরদের একটি বড়ো অংশ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। আবার ব্রিটিশদের একচেটিয়া বাণিজ্যের ফলে দেশীয় ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট ক্ষতির শিকার হয়।

[4] রাজস্ব বৃদ্ধি: ব্রিটিশরা ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার প্রজাদের ওপর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব চাপিয়ে দেয়।

[5] ব্রিটিশ সহযোগীদের শোষণ: ব্রিটিশ কোম্পানির সহযোগী দেশীয় জমিদার, মহাজন প্রমুখও প্রজাদের ওপর নানাভাবে শোষণ চালায়। ফলে প্রজাদের ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

উপসংহার: ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ সাধারণ ভারতবাসীকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। অধ্যাপক শশীভূষণ চৌধুরীর মতে, অর্থনৈতিক ক্ষোভের প্রকোপই সাধারণ মানুষকে সংগ্রামমুখী করেছিল।

3. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সামাজিক কারণগুলি কী ছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সামাজিক কারণ-

ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসন ভারতীয় সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মনে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করলে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। এই বিদ্রোহের সামাজিক কারণগুলি ছিল নিম্নরূপ-

[1] শাসক-শাসিত সম্পর্ক: ঔপনিবেশিক ভারতে ইংরেজ শাসক ও শাসিতের মধ্যে ব্যবধান ও বৈষম্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং ভারতীয়রা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে পড়ে।

[2] ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সর্বত্র ইংরেজরা ভারতীয়দের ঘৃণার চোখে দেখত। বহু ইউরোপীয় ক্লাবের দরজায় লেখা থাকত, "কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।" ওয়ারেন হেস্টিংস বলেছেন, "কয়েক বছর আগে পর্যন্ত অধিকাংশ ইংরেজ ভারতীয়দের প্রায় বর্বর মনে করত।"

[3] ভারতীয়দের রক্ষণশীল মনোভাব: ভারতীয়রা এদেশে বিদেশি শ্বেতাঙ্গ শাসন কখনোই মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। মুঘল শাসনের পতন ঘটানোর জন্য মুসলিমরা ব্রিটিশদের ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিল। আবার সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করা, বিধবাবিবাহের প্রচলন প্রভৃতির জন্যও রক্ষণশীল হিন্দুরা ব্রিটিশদের ওপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ছিল।

[4] ব্রিটিশ কর্মচারীদের অত্যাচার: ব্রিটিশ প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের অত্যাচার ও ব্যভিচার ভারতীয়দের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। কোল, ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়গুলিও চরম অত্যাচার আর নির্যাতনের শিকার হত। এই কারণে ভারতবাসী ব্রিটিশদের ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিল।

উপসংহার: ভারতবাসীর প্রতি তীব্র অত্যাচার, ঘৃণা, অবমাননা, লাঞ্ছনা প্রভৃতির মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতীয় সমাজকে বাবুদের স্তূপে পরিণত করে। এই স্তূপে যথা সময়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সংযোগ ঘটিয়ে ব্যারাকপুরের মিপতি মঙ্গল পান্ডে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সূচনা করেন।

4.মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?

উত্তরঃ মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ- 

ভূমিকা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেল-এর ব্যবহারকে কেন্দ্র করে সিপাহিরা ক্ষুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ শুরু করে। এই রাইফেলের ব্যবহারই বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ সৃষ্টি করে।

ধর্মচ্য়ুতির আশঙ্কা ও বিদ্রোহের সূচনা-

ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেল নামে এক সূচনা  এক বিশেষ ধরনের বন্দুকের ব্যবহার শুরু করে। এই রাইফেলে ব্যবহৃত কার্তুজ বা টোটার খোলসটি দাঁত দিয়ে কেটে রাইফেলে ভরতে হত।

সেনাবাহিনীতে গুজব ছড়ায় যে, এনফিল্ড রাইফেলের টোটার খোলসা গোরু ও শূকরের চর্বি দিয়ে তৈরি। ফলে হিন্দু ও মুসলিম সিপাহিরা ধর্মড়ায় মহাবিে হওয়ার ভয়ে এই টোটা ব্যবহারে অসম্মত হয়।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহারের জন্য ভারতীয় সেনাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে সেনারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়। ব্যারাকপুর সেনানিবাসের সিপাহি মঙ্গল পান্ডে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৯ মার্চ প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

উপসংহার: এনফিল্ড রাইফেল-এর কার্তুজের ঘটনাকে অনেকে মহাবিদ্রোহের প্রকৃত কারণ বলে মনে করলেও ঐতিহাসিক সি বল এই কাতুর্জের ঘটনাকে বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ বলে মনে করেন না। তিনি দেখিয়েছেন যে, বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী সিপাহিরা এই কার্তুজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেন।

5. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে কোথায়, কারা নেতৃত্ব দেন?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের নেতৃত্ব-

ভূমিকা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুর সেনানিবাসের সিপাহি মঙ্গল পান্ডে প্রথম ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। ক্রমে এই বিদ্রোহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ব্যক্তির নেতৃত্বে ছড়িয়ে পড়ে।

[1] দিল্লি: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে বিদ্রোহী সিপাহিরা দিল্লি দখল করে নেয় এবং সিংহাসনচ্যুত মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (১৭৭৫-১৮৬২ খ্রি.)-কে বিদ্রোহের নেতা বলে ঘোষণা করে। মুঘল শাসনের উত্তরাধিকারী এবং অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রতীক হিসেবে তাঁর নামে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ৮০ বছর বয়সের বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ ছিলেন নামসর্বস্ব নেতা মাত্র।

[2] কানপুর: কানপুরে মহাবিদ্রোহের নেতা ছিলেন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও-এর দত্তক পুত্র নানা সাহেব (প্রকৃত নাম গোবিন্দ ধন্দু পন্থ)। তিনি কানপুর থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে নিজেকে 'পেশোয়া' বলে ঘোষণা করেন। তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর তাঁতিয়া টোপি (প্রকৃত নাম রামচন্দ্র পান্ডুরঙ্গ টোপি) এবং হাকিম আজিমুল্লা-ও এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।

[3] অযোধ্যা: অযোধ্যার বিদ্রোহের অন্যতম নেত্রী ছিলেন বেগম হজরত মহল। তিনি লখনউয়ের সিপাহি এবং অযোধ্যার জমিদার ও কৃষকদের সহায়তায় এক সর্বাত্মক বিদ্রোহী সংগঠন গড়ে তোলেন।

[4] ঝাঁসি: ঝাঁসিতে সিপাহি বিদ্রোহের নেত্রী ছিলেন বিধবা রানি লক্ষ্মীবাই। ইংরেজ সেনাপতি হিউ রোজ ঝাঁসি আক্রমণ করলে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। শেষপর্যন্ত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে কাল্লির যুদ্ধে তিনি নিহত হন। তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ নেতৃত্ব পরবর্তীকালে ভারতবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা দিয়েছিল।

(5) বিহার: বিহারে সিপাহি বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ও সংগঠক ছিলেন রাজপুত বীর কুনওয়ার সিং। ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি গুরুতর আহত হন এবং এর পরে মারা যান।

[6] ফৈজাবাদ: ফৈজাবাদের মৌলবি আহম্মদুল্লা সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। অবশেষে তিনি ইংরেজদের অনুগত এক রাজার হাতে নিহত হন।

উপসংহার: ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানের নেতৃবর্গ মহাবিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলে সারা দেশে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ সর্বভারতীয় চরিত্র নেয়।

6. ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায়?

উত্তরঃ 3 নং ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নের উত্তরটি দ্যাখো।

7. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের কীরূপ মনোভাব ছিল?
অথবা, শিক্ষিত বাঙালি সমাজ কেন ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব-

ভূমিকা: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ঘটে এবং এই শিক্ষা গ্রহণ করে একদল শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি এই শ্রেণির মনোভাব সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল-

[1] ব্রিটিশ শাসনের ওপর আস্থা: শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তদের একটি বড়ো অংশ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনের ওপর অগাধ আস্থা রাখত। তারা ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের পক্ষে কল্যাণকর বলে মনে করত এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহেরও বিরোধী ছিল।

[2] সিপাহিদের সাফল্যে অবিশ্বাস: বিদ্রোহের মাধ্যমে ইংরেজদের বিতাড়নের পর কেউ ভারতে জাতীয় রাষ্ট্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে কি না এই বিষয়ে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ সন্দিহান ছিল। তাই তারা ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি।

[3] খ্যাতনামা বাঙালিদের অভিমত: [i] হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকায় বিদ্রোহীদের নৃশংস, বর্বর এবং নরহত্যাকারী দস্যু বলে অভিহিত করেন। [ii] রাজনারায়ণ বসু ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে 'নৈরাজ্যবাদী' এবং নানা সাহেব, আজিমউল্লার মতো বিদ্রোহী নেতাদের 'অন্যায়কারী দানব' বলে অভিহিত করেন। [iii] সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে, এই বিদ্রোহে জনগণের সমর্থন ছিল না।

[4] বাংলায় বিদ্রোহের দুর্বলতা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অত্যন্ত তীব্র হলেও শিক্ষিত বাঙালি সমাজের সমর্থনের অভাবে এই বিদ্রোহ বাংলায় খুব একটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি।

[5] পরিণাম: শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিরা প্রথমদিকে বিদ্রোহকে সমর্থন না করলেও বিদ্রোহ দমনে সরকার যে নিষ্ঠুর দমননীতির আশ্রয় নেয় তা শিক্ষিতদের চোখ খুলে দেয়। তারা উপলব্ধি করে যে, ব্রিটিশ শাসন কখনও ভারতীয়দের কল্যাণ করবে না। এই চেতনা পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করে।

উপসংহার: সব শিক্ষিত বাঙালিই মহাবিদ্রোহের বিরুদ্ধে ছিল এবং ইংরেজদের সমর্থন বা সহযোগিতা করেছিল-এ কথা বলা ভুল হবে। এই যুগে বিদ্যাসাগরের মতো কিছু ব্যতিক্রমী চরিত্র অবশ্যই ছিল।

৪. টীকা লেখো: মহারানির ঘোষণাপত্র।

উত্তরঃ মহারানির ঘোষণাপত্র-

ভূমিকা: মহাবিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেয়।

[1] ভারত শাসন আইন: মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 'ভারত শাসন আইন' (১৮৫৮ খ্রি.)-এর দ্বারা ভারতে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটায় এবং মহারানি ভিক্টোরিয়া নিজের হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন।

[2] ঘোষণাপত্র প্রকাশ: মহারানি ভিক্টোরিয়া ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর এক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় নতুন নীতি ও আদর্শের কথা প্রকাশ করেন।

[3] ঘোষণাপত্রের বক্তব্য: মহারানির ঘোষণাপত্রের দ্বারা জানানো হয় যে-[i] ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না। [ii] স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করা হবে। [iii] দেশীয় রাজাদের দত্তক গ্রহণের অধিকার দেওয়া হবে। [iv] ব্রিটিশরা ভারতে আর সাম্রাজ্য বিস্তার করবে না। [v] জাতিধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রতিটি যোগ্য ভারতীয়কে সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার প্রদান করা হবে। [vi] সরকার দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সম্বিগুলি মেনে চলবে।

উপসংহার: মহারানির ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত প্রতিশ্রুতিগুলি ঘোষণাপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই ক্রমশ ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর ক্ষোভ, হতাশা, ঘৃণা বাড়তেই থাকে।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1.উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের ভারতবাসীর ক্ষোভের কারণ কী ছিল?

উত্তরঃ উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের ভারতবাসীর ক্ষোভের প্রধান কারণগুলি ছিল-[1] ভারতীয়দের ওপর তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ, [2] কৃষকদের চরম দুর্দশা, [3] ভারতের শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস, [4] শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা ভারতীয় সমাজ-সভ্যতা ও ধর্মকে ঘৃণা করা প্রভৃতি।

2.এনফিল্ড রাইফেলের টোটার ঘটনাটি কী? অথবা, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের (সিপাহি বিদ্রোহের) প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশবাহিনীতে 'এনফিল্ড রাইফেল' নামে এক রাইফেলের প্রচলন হয়। এতে ব্যবহৃত টোটার খোলসটি দাঁত দিয়ে কেটে রাইফেলে ভরতে হত। সেনাবাহিনীতে গুজব ছড়ায় যে, খোলসটি গোরু ও শূকরের চর্বি দিয়ে তৈরি। ফলে হিন্দু ও মুসলিম সিপাহিরা ধর্মচ্যুত হওয়ার ভয়ে এই টোটা ব্যবহারে অসম্মত হয় এবং ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

3.ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লোকেরা কেন এনফিল্ড রাইফেল-এর টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করে?

উত্তরঃ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে গুজব ছড়ায় যে, এনফিল্ড রাইফেল-এর টোটার খোলসটি গোরু ও শূকরের চর্বি দিয়ে তৈরি। ফলে হিন্দু ও মুসলিম সিপাহিরা ধর্মচ্যুত হওয়ার ভয়ে এই টোটা ব্যবহারে অসম্মত হয়।

4.মঙ্গল পান্ডে কে ছিলেন? 

উত্তরঃ মঙ্গল পান্ডে ছিলেন ব্যারাকপুর সেনানিবাসের ৩৪ নং নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির একজন সিপাহি। তিনি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এর ফলে সরকার মঙ্গল পান্ডেকে গ্রেপ্তার করে। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।

5.১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা, কেন 'সিপাহি বিদ্রোহ' বা সামরিক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন?

উত্তরঃ ইংরেজ ঐতিহাসিক স্যার জন লরেন্স, জন সিলি, চার্লস রেকস প্রমুখ ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে 'সামরিক বিদ্রোহ' এবং অক্ষয়কুমার দত্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দাদাভাই নওরোজি প্রমুখ ভারতীয় একে 'সিপাহি বিদ্রোহ' বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, ১৮৫৭-এর বিদ্রোহে ভারতের সর্বস্তরের মানুষ এই বিদ্রোহে শামিল হয়নি। সৈনিক বা সিপাহিরা প্রথম এই বিদ্রোহ শুরু করে। এজন্য তাঁরা একে 'সিপাহি বিদ্রোহ' বলে অভিহিত করেছেন।

6.১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা, কেন 'গণবিদ্রোহ' বলে অভিহিত করেছেন?

উত্তরঃ ব্রিটিশ ঐতিহাসিক নর্টন, ম্যালেসন, বল, জন কে প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে 'গণবিদ্রোহ' বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, এই বিদ্রোহ ভারতের এক সীমাবদ্ধ অঞ্চলে বা শুধু সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ ছিল না। দিল্লি, অযোধ্যা, লখনউ, কানপুর, বেরিলী, ঝাঁসি, বিহার- ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষ এই বিদ্রোহে অংশ নেয়। এছা তাঁরা একে 'গণবিদ্রোহ' বলে উল্লেখ করেছেন।

7.১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা, কেন 'জাতীয় বিদ্রোহ' বলে অভিহিত করেছেন?

উত্তরঃ ঐতিহাসিক আউট্রাম, ডাফ, রবার্টসন, টোরি দলের নেয় ডিসরেলি, সমাজতন্ত্রবিদ কার্ল মার্কস প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহয়ে 'জাতীয় বিদ্রোহ' বলে অভিহিত করেছেন। মুজাফফরনগর, বিহার। উত্তরপ্রদেশে সিপাহিদের সঙ্গে সংযোগ ছাড়াই অসামরিক লোকজন ও জমিদারশ্রেণি এই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এজন্য তাঁর একে 'জাতীয় বিদ্রোহ' বলে অভিহিত করেছেন।

৪.১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা, কেন 'সামন্ততন্ত্র-বিরোধ কৃষক অভ্যুত্থান' বলে অভিহিত করেছেন?

উত্তরঃ সুপ্রকাশ রায়, প্রমোদ সেনগুপ্ত প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহবে 'সামন্ততন্ত্র-বিরোধী কৃষক অভ্যুত্থান' বলে অভিহিত করেছেন। ১৮৫৭- বিদ্রোহে সারা দেশে কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ করে তাঁরা এরূণ মন্তব্য করেছেন।

 9.১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা, কেন 'ভারতের প্রথ স্বাধীনতা সংগ্রাম' বলে অভিহিত করেছেন?

উত্তরঃ বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে 'ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম' বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুশোভন সরকার প্রমুখর এই অভিমতকে সমর্থন করেছেন। তাঁদের মতে, ভারতবাসী জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়। এজন্য তাঁরা একে 'ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম' বলে মনে করেন। 

10.১৮৫৭-র বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোভাব কী ছিল?
অথবা, শিক্ষিত বাঙালি সমাজের একটি অংশ কেন মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) বিরোধিতা করেছিল?
অথবা, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে শিক্ষিত সমাজ দূরে ছিল কেন? 

উত্তরঃ শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড়ো অংশ ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের পক্ষে কল্যাণকর বলে মনে করত। এজন্য তারা ১৮৫৭-র ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি। কেননা, এই বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিস শাসনের অবসান ঘটানোর পর কেউ ভারতে জাতীয় রাষ্ট্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে কি না এ বিষয়ে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি সন্দিহান ছিল।

11.১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল বা গুরুত্বগুলি উল্লেখ করো।

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রধান ফলাফল বা গুরুত্বগুলি ছিল- [1] বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 'ভারত শাসন আইন' (১৮৫৮ খ্রি.) পাস করে। [2] ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটেস [3] মহারানি ভিক্টোরিয়া নিজের হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন।

12. কীভাবে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের অবসান ঘটে?

উত্তরঃ ব্রিটিশ সরকার তীব্র দমননীতির মাধ্যমে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। [1] বহু বিদ্রোহী নেতাকে হত্যা করা হয়। [2] ব্রিটিশবাহিনী ২২ সেপ্টেম্বর (১৮৫৭ খ্রি.) দিল্লি দখল করে। [3] বাহাদুর শাহকে বন্দি করে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়া হয়। এরূপ তীব্র দমননীতির ফলে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি বিদ্রোহ থেমে যায়।

13. মহারানির ঘোষণাপত্র কী?

উত্তরঃ ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। তিনি ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর এক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় নতুন নীতি ও আদর্শের কথা প্রকাশ করেন। এটি 'মহারানির ঘোষণাপত্র' নামে পরিচিত।

14.মহারানি ভিক্টোরিয়া কর্তৃক নিজ হাতে ভারতের শাসনভার গ্রহণ সম্পর্কে কী জান?

উত্তরঃ 'ভারত শাসন আইন' (১৮৫৮ খ্রি.)-এর দ্বারা-[1] মহারানি ভিক্টোরিয়া নিজের হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন। [2] রানির প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নর-জেনারেল ভারতের শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পান। [3] গভর্নর-জেনারেলের উপাধি হয় ভাইসরয়। [4] ভারতের প্রথম ভাইসরয় নিযুক্ত হন লর্ড ক্যানিং।

15.কে ভাইসরয় উপাধি লাভ করেন?

উত্তরঃ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মহারানি ভিক্টোরিয়া নিজের হাতে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন। রানির প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নর-জেনারেল ভারতের শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পান। তাঁর উপাধি হয় ভাইসরয়।

16. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহারানির ঘোষণাপত্রে দেশীয় রাজাদের প্রতি কী কী ঘোষণা করা হয়েছিল? 

উত্তরঃ মহারানির ঘোষণাপত্রে দেশীয় রাজাদের বলা হয় যে- [1] স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করা হবে। [2] দেশীয় রাজাদের দত্তক গ্রহণের অধিকার দেওয়া হবে। [3] ব্রিটিশরা ভারতে আর সাম্রাজ্য বিস্তার করবে না। [4] দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সন্ধিগুলি সরকার মেনে চলবে।

17.মহারানির ঘোষণাপত্র ঘোষণাপত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে করা হয় কেন?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী মহারানি ভিক্টোরিয়া ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর এক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে জানান যে-[1] ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। [2] স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করে দেশীয় রাজাদের দত্তক গ্রহণের অধিকার দেওয়া হবে। [3] ব্রিটিশরা ভারতে আর সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটাবে না। [4] সরকার যোগ্য ভারতীয়দের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করবে। [5] দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলি সরকার মেনে চলবে। মহারানির ঘোষণায় এসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা মোটেই কার্যকর করা হয়নি। এজন্য বলা হয় যে, মহারানির ঘোষণাপত্র ঘোষণাপত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল।

18. 'মহারানির ঘোষণাপত্র'-এর (১৮৫৮) মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? [Madhyamik 2018] 
অথবা, মহারানির ঘোষণাপত্রের (১৮৫৮) প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল? [Madhyamik 2023]

উত্তরঃ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের 'মহারানির ঘোষণাপত্র'-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটানো এবং ভারতীয়দের নিজ শাসনাধীনে এনে তাদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দান। তবে এই সবই ছিল রাজনৈতিক চমক মাত্র। এর ফলে ভারতীয়রা প্রকৃতভাবে লাভবান হয়নি।

অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

 একটি বাক্যে উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি 

1. কোন্ সময় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতে জাতীয় স্তরে আন্দোলন শুরু | হয়?

>> ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতে জাতীয় স্তরে আন্দোলন শুরু হয়।

2. কোন্ সিপাহি প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন?

>> ব্যারাকপুর সেনানিবাসের সিপাহি মঙ্গল পান্ডে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা (২৯ মার্চ, ১৮৫৭ খ্রি.) করেন।

3. মঙ্গল পান্ডে কবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন?

>> মঙ্গল পান্ডে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

4. মিরাটে কবে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়?

>> ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১০মে মিরাটে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়।

5. দিল্লিতে কবে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়?

» ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে দিল্লিতে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়।

6. প্রথম কবে সিপাহিরা বিক্ষোভ শুরু করে?

>> প্রথম ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি বহরমপুরের সেনা ছাউনির ১৯ নং নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সিপাহিরা বিক্ষোভ শুরু করে।

7. কার আমলে কবে সিপাহি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়?

>> বড়োলাট লর্ড ক্যানিং-এর আমলে (১৮৫৬-৬২ খ্রি.) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।

8. ভারতের প্রথম ভাইসরয় কে ছিলেন?

>> ভারতের প্রথম ভাইসরয় ছিলেন লর্ড ক্যানিং।

9. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?

» ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেল-এর টোটার প্রচলন।

10. কে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে দেশের জনগণের সমর্থনহীন, সহানুভূতিবিহীন একটি নিছক সামরিক বিদ্রোহ বলে বর্ণনা করেছিলেন?

>> সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে দেশের জনগণের সমর্থনহীন, সহানুভূতিবিহীন একটি নিছক সামরিক বিদ্রোহ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

11. কারা মনে করেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে স্থানীয় কৃষকদের প্রতিরোধ, জাতীয় প্রতিরোধ প্রভৃতি বিভিন্ন ধারা-উপধারার সংমিশ্রণ ঘটেছিল?

>> অধ্যাপক এরিখ স্টোক্স, বেইলি প্রমুখ মনে করেন যে, ১৮৫৭-এর বিদ্রোহে স্থানীয় কৃষকদের প্রতিরোধ, জাতীয় প্রতিরোধ প্রভৃতি বিভিন্ন ধারা-উপধারার সংমিশ্রণ ঘটেছিল।

12. ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে সামরিক বিদ্রোহ বলে মনে করেন এমন তিনজন ইংরেজ ঐতিহাসিকের নাম লেখো।

>> ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে সামরিক বিদ্রোহ বলে মনে করেন এমন তিনজন ইংরেজ ঐতিহাসিক হলেন স্যার জন লরেন্স, জন সিলি/চার্লস রেকস প্রমুখ।

13. ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে 'সিপাহি বিদ্রোহ' বলে উল্লেখ করেছেন এমন চারজন ভারতীয় মনীষীর নাম লেখো।

>> ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে 'সিপাহি বিদ্রোহ' বলে উল্লেখ করেছেন এমন চারজন ভারতীয় মনীষী হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দাদাভাই নওরোজি প্রমুখ।

14. ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে 'গণবিদ্রোহ' বলে মনে করেন এমন তিনজন ঐতিহাসিকের নাম উল্লেখ করো।

>> ইংরেজ ঐতিহাসিক নর্টন, ম্যালেসন, বল, জন কে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে 'গণবিদ্রোহ' বলে মনে করেন।

15. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে যাঁরা 'সামন্তশ্রেণির বিদ্রোহ' বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন তাঁদের তিনজনের নাম উল্লেখ করো।

>> ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন, রজনীপাম দত্ত প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সামন্তশ্রেণির বিদ্রোহ বলে প্রমাণ করছে চেষ্টা করেছেন।

16. নানা সাহেবের আসল নাম কী ছিল?

>> নানা সাহেবের আসল নাম গোবিন্দ ধন্দু পন্থ।

17. তাঁতিয়া টোপির আসল নাম কী ছিল?

>> তাঁতিয়া টোপির আসল নাম রামচন্দ্র পান্ডুরঙ্গ টোপি।

18. কোন্ আইনের দ্বারা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসন ঘটে?

» 'ভারত শাসন আইন' (১৮৫৮ খ্রি.)-এর দ্বারা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয় কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে।

19. ১৮৫৭-এর বিদ্রোহ কোন্ কোন্ অঞ্চলে বিস্তারলাভ করেছিল?

» ১৮৫৭-এর বিদ্রোহ দিল্লি, অযোধ্যা, লখনউ, কানপুর, বেরিলী ঝাঁসি, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে।

20. মহারানি ভিক্টোরিয়া কোন্ আইনের দ্বারা ভারতের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন?

>> মহারানি ভিক্টোরিয়া ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে 'ভারত শাসন আইন' দ্বারা ভারতের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন।

ঠিক বা ভুল নি

1. ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেলের টোটার প্রচলন হয়।

উত্তরঃ ঠিক।

2. বিচারে ব্যারাকপুর সেনানিবাসের সিপাহি মঙ্গল পান্ডের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

উত্তরঃভুল ।

3. বিদ্রোহী সিপাহিরা দিল্লি দখল করে নেয় এবং সিংহাসনচ্যুত মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে 'ভারতের সম্রাট' বলে ঘোষণা করে।

উত্তরঃঠিক।

4. অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুশোভন সরকার প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে 'ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ' ও 'জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম' বলে অভিহিত করেছেন।

উত্তরঃ ভুল ।

5. ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন তাঁর 'Eighteen Fifty Seven' গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অপরিহার্য উপাদানগুলি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে ছিল।

উত্তরঃভুল ।

6. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি সমাজের একটি অংশ ব্রিটিশ শাসনকে ভারতের পক্ষে কল্যাণকর বলে মনে করত।

উত্তরঃঠিক।

7. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ব্যর্থতায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ হতাশ হয়েছিল।

উত্তরঃ ভুল ।

৪. 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সিপাহি বিদ্রোহের সমর্থক ছিলেন।

উত্তরঃ ভুল ।

শূন্য়স্থান পূরণ করো

1. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সেনা বিক্ষোভ শুরু হয়____।

উত্তরঃ বহরমপুরে 

2. প্রথম সিপাহি বিদ্রোহ ঘোষিত হয়____।

উত্তরঃ ব্য়ারাকপুরে।

3. লরেন্স, সিলি প্রমুখ ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে____বলে অভিহিত করেছেন।

উত্তরঃ সামরিক বিদ্রোহ ।

4. অক্ষয়কুমার দত্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দাদাভাই নওরোজি প্রমুখ ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে_____বলে অভিহিত করেছেন। 

উত্তরঃ সিপাহি বিদ্রোহ।

5. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহীরা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে_____বলে ঘোষণা করে।

উত্তরঃ    ভারতের সম্রাট ।

6. নর্টন, ম্যালসন, বল, জন কে প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রিস্টব্দের বিদ্রোহকে_____বলে মনে করেন।

উত্তরঃ গণবিদ্রোহ ।

7. আউট্রাম, ডাফ, রবার্টসন প্রমুখ ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে_____ বলে অভিহিত করেছেন। 

উত্তরঃ জাতীয় বিদ্রোহ ।

৪. নানা সাহেব, আজিমউল্লার মতো সিপাহি বিদ্রোহের নেতাদের 'অন্যায়কারী দানব' বলেছিলেন____।
উত্তরঃ রাজনারায়ণ বসু ।

9. ব্রিটিশরা_____স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করার কথা জানায়।

উত্তরঃ মহারানির ঘোষণাপত্রে ।

10. ______উনিশ শতককে 'সভাসমিতির যুগ' বলে অভিহিত করেছেন।

উত্তরঃ অনিল শীল । 

11. গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য_____সভাপতি ছিলেন।

উত্তরঃ বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার ।

12.______ছিল 'জমিদার সভা'র অগ্রদূত।

উত্তরঃ বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ।

13._____এর উদ্যোগে জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়।

উত্তরঃ দ্বারাকানাথ ঠাকুর। 

14.______ছিলেন হিন্দুমেলার প্রথম সম্পাদক।

উত্তরঃ জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

15.______১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুমেলার বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করেন।

উত্তরঃ রাজনারায়ণ বসু ।

16. রাজনারায়ণ বসু______উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন। [পর্ষদ নমুনা প্রশ্ন]

উত্তরঃ ভারতসভা ।

17. সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়______প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।

উত্তরঃ হিন্দুমেলায়।

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ

সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো

1. 'বেঙ্গল আর্মি'র সদস্য ছিলেন-

(a) তাঁতিয়া টোপি
(b) মঙ্গল পান্ডে
(c ) নানা সাহেব
(d) মৌলবি আহমদউল্লা

উত্তরঃ (b) মঙ্গল পান্ডে

2. সিপাহি বিদ্রোহের প্রথম সূচনা হয়েছিল-

(a) ব্যারাকপুরে
(b) মিরাটে
(c ) দিল্লিতে
(d) লখনউতে

উত্তরঃ (a) ব্যারাকপুরে

3. সিপাহি বিদ্রোহের প্রথম শহিদ ছিলেন-

(a) নানাসাহেব
(b) তাঁতিয়া টোপি
(c ) রানি লক্ষ্মীবাই
(d) মঙ্গল পান্ডে

উত্তরঃ(d) মঙ্গল পান্ডে

4. ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় স্তরে প্রথম বিদ্রোহ হল-

(a) সিপাহি বিদ্রোহ
(b) নীল বিদ্রোহ
(c ) ইলবার্ট বিল-বিরোধী আন্দোলন
(d) স্বদেশি আন্দোলন

উত্তরঃ(a) সিপাহি বিদ্রোহ

5. লক্ষ্মীবাই সিপাহি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন-

(a) বাংলায়
(b) কানপুরে
(c ) ঝাঁসিতে
(d) বিহারে

উত্তরঃ (c ) ঝাঁসিতে

6. সিপাহি বিদ্রোহে নানা সাহেব ও তাঁতিয়া টোপি কোথাকার নেতা ছিলেন?

(a) বিহারের
(b) কানপুরের
(c )মিরাটের
(d) ফৈজাবাদের

উত্তরঃ(b) কানপুরের

7. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের সময় মোঘল সম্রাট ছিলেন-

(a) বাবর
(b) আকবর
(c ) শাহজাহান
(d) দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ

উত্তরঃ (d) দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ

৪. বিহারে সিপাহি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন-

(a) কুনওয়ার সিং
(b) নানা সাহেব
(c ) তাঁতিয়া টোপি
(d) মঙ্গল পান্ডে

উত্তরঃ(a) কুনওয়ার সিং

9. অযোধ্যায় সিপাহি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন-

(a) নানা সাহেব
(b) হজরত মহল
(c ) কুনওয়ার সিং
(d) বাবা রামচন্দ্র

উত্তরঃ(b) হজরত মহল

10. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে প্রথম সিপাহি বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন-

(a) লর্ড ক্যানিং
(b) আর্ল স্ট্যানলি
(c ) মহারানি ভিক্টোরিয়া
(d) ডিসরেলি

উত্তরঃ(b) আর্ল স্ট্যানলি

11. ভারতের মধ্যে মহাবিদ্রোহে যোগ দেয়নি-

(a) বিহার
(b) উত্তরপ্রদেশ
(c ) মধ্যপ্রদেশ
(d) পাঞ্জাব

উত্তরঃ (d) পাঞ্জাব

12. এদের মধ্যে কে মহাবিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলেননি?

(a) ডিসরেলি
(b) রবার্টসন
(c ) কার্ল মার্কস
(d) সাভারকর

উত্তরঃ(a) ডিসরেলি

13. ইংল্যান্ডের টোরি দলের নেতা ডিসরেলি ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহদে উল্লেখ করেছেন-

(a) সিপাহি বিদ্রোহরূপে
(b) জাতীয় বিদ্রোহরূপে
(c ) প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধরূপে
(d) সামন্তশ্রেণির ক্ষমতা দখলের প্রয়াসরূপে

উত্তরঃ(a) সিপাহি বিদ্রোহরূপে

14 . মহাবিদ্রোহকে (১৮৫৭) যে ব্রিটিশ লেখক 'সিপাহি বিদ্রোহ' আখ্য দিয়েছেন-

(a) চার্লস রেইকস্
(b) নর্টন
(c ) ম্যালেসন
(d) ডিজরেলি  

উত্তরঃ(a) চার্লস রেইকস্

15. সমাজতন্ত্রবিদ কার্ল মার্কস ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে বলেছেন-

(a) সিপাহি বিদ্রোহ
(b) সামন্ড বিদ্রোহ
(c ) ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ
(d) জাতীয় বিদ্রোহ

উত্তরঃ(d) জাতীয় বিদ্রোহ

16. মহাবিদ্রোহকে সামন্ত বিদ্রোহ বলেছেন-

(a) বিপান চন্দ্র
(b) ইরফান হাবিব
(c ) রোমিলা থাপার
(d) রজনীপাম দত্ত

উত্তরঃ(d) রজনীপাম দত্ত

17. মহাবিদ্রোহকে (১৮৫৭) 'কৃষক বিদ্রোহ' আখ্যা দিয়েছেন-

(a) সুরেন্দ্রনাথ সেন
(b) রমেশচন্দ্র মজুমদার
(c ) শশীভূষণ চৌধুরি
(d) বিনায়ক দামোদর সাভারকর   
      
উত্তরঃ(c ) শশীভূষণ চৌধুরি

18. ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ বলেছিলেন-

(a) সুভাষচন্দ্র বসু
(b)জওহরলাল নেহরু
(c ) ভি ডি সাভারকর
(d) রাসবিহারী বসু 

উত্তরঃ(c ) ভি ডি সাভারকর

19. "১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম-প্রথম নয়, জাতীয় নয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়।”- এটি কার উক্তি?

(a) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের
(b) ড. সুরেন্দ্রনাথ সেনের
(c ) সুশোভন সরকারের
(d) হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের

উত্তরঃ(a) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের

20. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে 'মুসলমানদের ষড়যন্ত্র' বলেছেন- 

(a) নর্টন
(b) ডিজরেলি 
(c ) আউট্রাম 
(d) নিকলসন

উত্তরঃ(c ) আউট্রাম 

21. "১৮৫৭-এর বিদ্রোহ ছিল অভিজাততন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের মৃত্যুকালীন আর্তনাদ"-এ কথা কে বলেছেন?

(a) ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন
(b) সুশোভন সরকার
(c ) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার
(d) সুমিত সরকার

উত্তরঃ(c ) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার

22. "The Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857' গ্রন্থটির লেখক হলেন-

(a) ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন
(c ) রজনীপাম দত্ত
(b) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার
(d) অধ্যাপক রণজিৎ গুহ 

উত্তরঃ(b) ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার

23. ১৮৫৭-এর বিদ্রোহকে 'নৈরাজ্যবাদী' বলে অভিহিত করেছেন-

(a) সুরেন্দ্রনাথ সেন
(b) রমেশচন্দ্র মজুমদার
(c ) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
(d) রাজনারায়ণ বসু

উত্তরঃ(b) রমেশচন্দ্র মজুমদার

24. 'Eighteen Fifty Seven' গ্রন্থের লেখক হলেন-

(a) ভি ডি সাভারকর
(b) রমেশচন্দ্র মজুমদার
(c ) ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন
(d) শশীভূষণ চৌধুরী

উত্তরঃ(c )ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন

25. মহাবিদ্রোহের পর ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন-

(a) মহারানি ভিক্টোরিয়া
(b) লর্ড ক্যানিং
(c )ভারত সচিব
(d) ভাইসরয়

উত্তরঃ(a) মহারানি ভিক্টোরিয়া

26. মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়-

(a)  কলকাতা থেকে
(b) মুম্বই থেকে
(c ) মাদ্রাজ থেকে
(d) এলাহাবাদ থেকে

উত্তরঃ(d) এলাহাবাদ থেকে

27. মহারানির ঘোষণাপত্রের (১৮৫৮) প্রধান উদ্দেশ্য ছিল-

(a) ভারতবাসীর আনুগত্য অর্জন
(b) ভারতে ব্রিটিশদের একচেটিয়া ব্যাবসার অধিকার লাভ
(c ) ভারতীয় প্রজাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদান
(d) মহাবিদ্রোহে (১৮৫৭) বন্দি ভারতীয়দের মুক্তিদান 

উত্তরঃ(a) ভারতবাসীর আনুগত্য অর্জন

28. কবে ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে মহারানি ভিক্টোরিয়া নিজের হাতে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন?

(a) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে
(c ) ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে

উত্তরঃ(b) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে

29. মহারানির ঘোষণাপত্র (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়-

(a) ১ জানুয়ারি
(b) ২৬ জানুয়ারি
(c ) ২ অক্টোবর
(d) ১ নভেম্বর

উত্তরঃ(d) ১ নভেম্বর

30. মহারানি ভিক্টোরিয়া কর্তৃক ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন-

(a) লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক
(b) লর্ড ডালহৌসি
(c ) লর্ড ক্যানিং
(d) লর্ড কার্জন

উত্তরঃ(c ) লর্ড ক্যানিং

31. "An Act for the Better Government of India" আইন বলে যে পদের সৃষ্টি হয়-

(a) ভারতীয় কাউন্সিল
(b) ভারত সচিব
(c ) গভর্নর-জেনারেল
(d) কোনোটিই নয়

উত্তরঃ(b) ভারত সচিব

32. ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসান ঘটে-

(a) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে
(c ) ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে  

উত্তরঃ(b) ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে

33. মহারানির ঘোষণাপত্র (১৮৫৮) অনুযায়ী ভারতের 'রাজপ্রতিনিধি' হিসেবে প্রথম নিযুক্ত হন-

(a) লর্ড ডালহৌসি
(b) লর্ড ক্যানিং
(c ) .র্ড বেন্টিঙ্ক
(d) লর্ড মাউন্টব্যাটন
 উত্তরঃ(b) লর্ড ক্যানিং

TOPIC  (B) সভাসমিতির যুগ 

ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1. বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা এবং ভারতসভার গঠন ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করো। 

উত্তরঃ বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা-

১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল ভারতের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন।
[1] বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার গঠন: উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার প্রসারের ফলে ভারতীয়দের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। 'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' হল এই সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম।

[i] প্রতিষ্ঠা: টাকির জমিদার কালীনাথ রায় চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং রাজা রামমোহন রায়ের বেশ কয়েকজন অনুগামীর উদ্যোগে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। যোগেশচন্দ্র বাগল- এর মতে, এটিই ছিল বাঙালি তথা ভারতীয়দের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।

[ii] সভাপতি: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রথম অধিবেশন বসে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর। সাংবাদিক ও লেখক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য (১৭৯৯-১৮৫৯ খ্রি.) এই সভায় সভাপতিত্ব করেন।

[2] বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার উদ্দেশ্য:

[i] সরকারের সমালোচনা: ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অপশাসনের সমালোচনা করা ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার অন্যতম উদ্দেশ্য।

[ii] শোষণের প্রতিবাদ: সরকার এক আইনের দ্বারা নিষ্কর জমির ওপর কর আরোপ করে। এই কর প্রতিহত করা ছিল বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।

[iii] জনস্বার্থ রক্ষা: ভারতের সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষর উদ্দেশ্যে সরকারের কাছে বিভিন্ন আবেদনপত্র জমা দেওয়া বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

[iv] পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার: এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে কলকাতার প্রগতিশীল সমাজের একাংশ উদ্যোগী ছিলেন। তারা বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার মাধ্যমে সেই উদ্যোগ সফল করার চেষ্টা করেন।

ভারতসডা

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়।

[1] ভারতসভার গঠন: উনিশ শতকে ভারতে গড়ে-ওঠা বিভির রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল 'ভারতসভা' বা 'ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন'।

[i] প্রতিষ্ঠা: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বস শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। নানা কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতসভার প্রাণপুরুষ হয়ে ওঠেন।

[ii] প্রথম অধিবেশন: ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভার প্রথম অধিবেশন বসে।

[2] ভারতসভার উদ্দেশ্য: ভারতসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি ছিল নিম্নরূপ-

[i] জনকল্যাণ: ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষা এবং সার্বিক কল্যাণসাধন করা ভারতসভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ ছিল।

[ii] জনমত গঠন: ধারাবাহিক প্রচারের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত গঠন ছিল ভারতসভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।

[iii] ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা:
ভারতে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ ও অনৈক্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করতে পারে। এই বিভেদ দূর করে ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ভারতসভার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

[iv] রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা: দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা ছিল ভারতসভা প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।

(v) রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করা: দেশবাসীর মধ্যে প্রচার চালিয়ে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তুলতে ভারতসভা উদ্যোগী হয়েছিল।

[vi] গণ আন্দোলন গড়ে তোলা: ব্রিটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধে এদেশে শক্তিশালী গণ আন্দোলন গড়ে তোলাও ছিল ভারতসভা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।

2. জমিদার সভা সম্পর্কে আলোচনা করো। 

উত্তরঃ জমিদার সভা-

ভূমিকা: উনিশ শতকের মধ্যভাগে ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এজন্য ড. অনিল শীল এই যুগকে 'রাজনৈতিক সভাসমিতির যুগ' বলে অভিহিত করেছেন। এই সময় প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল জমিদার সভা। এটিই ছিল ভারতের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সংগঠন।

[1] প্রতিষ্ঠা: ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে (১৯ মার্চ) দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এবং রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে কলকাতায় জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদার সভা প্রতিষ্ঠার পর 'ভূমিমালিক সমিতি' নামে এটি অধিক পরিচিতি লাভ করে।

[2] সদস্য: জমিদার সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন জমিদার এবং ধনী ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা রাধকান্ত দেব, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজকমল সেন, ভবানীচরণ মিত্র প্রমুখ বড়ো বড়ো ভূস্বামী। বাংলার ব্যাবসাবাণিজ্যে নিযুক্ত বেসরকারি ব্রিটিশরাও জমিদার সভার সদস্য হতে পারত। তবে সাধারণ মানুষ জমিদার সভার সদস্য হওয়ার বিশেষ সুযোগ পেত না।

[3] উদ্দেশ্য: জমিদার সভার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জমিদার শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করা। এই উদ্দেশ্যে সভার সদস্যরা কলকাতার ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা চালায়। তারা লন্ডনের ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং সোসাইটির সভাপতি জর্জ থম্পসনকে লন্ডনে ভূমিমালিক সমিতির প্রতিনিধি নিয়োগ করে।


[4] কর্মসূচি: জমিদার সভা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে- [i] জমিদারদের স্বার্থরক্ষার জন্য তারা সরকারের কাছে দাবি জানায়। [ii] তারা ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করে। [iii] তারা ভারতের সর্বত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ঘটানোর দাবি জানায়। [iv] তারা নিষ্কর জমি ভোগদখলের অধিকার পুনঃপ্রবর্তন বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। [v] শাসনসংস্কারের জন্য তারা সরকারের কাছে দাবি জানায়। [vi] তারা সরকারের কাছে পুলিশবিভাগ, বিচারবিভাগ ও রাজস্ববিভাগের সংস্কারের দাবি জানায়।

[5] অবদান: জমিদার সভা ভারতে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারার সূচনা করে। এই সভার আবেদনে সরকার ১০ বিঘা পর্যন্ত ব্রশ্নোত্তর জমির খাজনা মকুব করে। ড. রাজেন্দ্রলাল মিত্র মনে করেন যে, জমিদার সভাই ছিল ভারতের স্বাধীনতার অগ্রদূত।

[6] বিলুপ্তি: বাংলার বাইরে জমিদার সভা তাদের প্রভাব বিস্তারে সফল হয়নি। তা ছাড়া ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জমিদার সভা ক্রমে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তবে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এর অস্তিত্ব কোনোরকমে টিকে ছিল। পরবর্তীকালে এর স্থান দখল করে নেয় বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি।

উপসংহার: জমিদার সভা ছিল একান্তভাবেই জমিদার ও বানিয়াদের একটি সংগঠন। এর সদস্যরা এর আভিজাত্য রক্ষায় সর্বদা যত্নবান থাকতেন। ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনেও তারা সচেষ্ট থাকতেন। তবে এই সংগঠন ভারতে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই সংগঠনের অনুকরণে পরবর্তীকালে ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। ফলে এদেশে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

3. সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভার বিভিন্ন প্রতিবাদ আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তরঃ ভারতসভার প্রতিবাদ আন্দোলন-

ভূমিকা: উনিশ শতকে ভারতে যেসব রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে সেগুলির মধ্যে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বা 'ভারতসভা' বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ভারতসভা বিভিন্ন কার্যাবলি বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

[1] প্রতিষ্ঠা: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ভারতসভার প্রথম অধিবেশন বসে।

[2] সুরেন্দ্রনাথের উদ্যোগ: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতসভাকে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেন এবং সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনমত গঠনের উদ্যোগ নেন। তাঁর সক্রিয় উদ্যোগ ও প্রচারের ফলে লখনউ, মিরাট, লাহোর, সিন্ধু প্রভৃতি অঞ্চলে শীঘ্রই ভারতসভার শাখা স্থাপিত হয়।

[3] কর্মসূচি: ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ভারতসভা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এগুলি হল- [i] ভারতীয়দের জনমত গঠন করা, [ii] রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা, [iii] হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করা, [iv] স্বল্প শিক্ষিত ও সাধারণ ভারতীয়দের রাজনৈতিক গণ আন্দোলনে শামিল করা ইত্যাদি।

[4] আই সি এস পরীক্ষার বয়স নিয়ে আন্দোলন: ব্রিটিশ সরকার আই সি এস বা ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের ঊর্ধ্বতম বয়স ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৯ বছর করে। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একইসঙ্গে ইংল্যান্ড ও ভারতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণ এবং এই পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ২২ বছর করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

[5] লিটনের দমনমূলক আইনের বিরোধিতা: ভারতসভা চরম স্বৈরাচারী ব্রিটিশ শাসন লর্ড লিটনের তীব্র দমনমূলক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। যেমন- [i] লিটন দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন (১৮৭৮ খ্রি.) দ্বারা দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেন। ভারতসভা এর তীব্র প্রতিবাদ করে। [ii] লিটন অস্ত্র আইন (১৮৭৮ খ্রি.) প্রণয়ন করে সরকারের অনুমতি ছাড়া ভারতীয়দের আগ্নেয়াস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ করেন। এর বিরুদ্ধে ভারতসভা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললে পরবর্তী বড়োলাট লর্ড রিপন এই আইন প্রত্যাহার (১৮৮১ খ্রি.) করেন।

[6 ] ইলবার্ট বিল আন্দোলন: লর্ড রিপন-এর(১৮৮০-৮৪ এদেশে কোনো ভারতীয় বিচারক কোনো ইংরেজের বিচার কর অধিকারী ছিল না। রিপন ইলবার্ট বিল-এর দ্বারা ভারতীয় বিচারকদের এই অধিকার দিলে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা এই বিলের বিরুদ্ধে হাঁট আন্দোলন শুরু করে। বিলের সমর্থনে সুরেন্দ্রনাথের নেতৃতে ভারতসভাও তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। 

[7 ] অন্যান্য আন্দোলন: কৃষকদের ওপর সরকার ও জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার, শোষণমূলক আমদানি ও শুল্ক আইন, সম্পদে নিষ্ক্রমণ, আসামের চা-বাগানের কুলিদের ওপর অত্যাচার প্রভৃতি বিরুদ্ধে ভারতসভা আন্দোলন চালায়। ভারতসভা প্রতিনিধিত্বমূলক বিরুদ্ধে পরিষদ গঠন, স্বায়ত্ত্বশাসন প্রবর্তন, প্রজাস্বত্ব আইন প্রণাম মদ্যপান নিবারণ প্রভৃতির দাবিতেও আন্দোলন সংগঠিত করে।

উপসংহার: ভারতসভার নেতৃবৃন্দের সহায়তায় এবং সুরেন্দ্রনাথের সক্রিয় উদ্যোগে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন বাবল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কনফারেন্স নামে মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। ড. অমলেন ত্রিপাঠী সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনকে 'জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া' বলে অভিহিত করেছেন। কেন-না, এই সম্মেলনের প্রেরণায় অ্যালান অক্টেভিয়ায় হিউম ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন বসলে সুরেন্দ্রনাথ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে অধিবেশনে যোগ দেন। এর ফলে কংগ্রেস অত্যা শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি 

1. উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে 'সভাসমিতির যুগ' বলা হয় কেন?
অথবা, সভাসমিতির যুগ বলতে কী বোঝায়?  

উত্তরঃ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, জাতীয়তাবাদের উন্মেষ প্রভৃতির ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এজন্য এই সময়কালকে 'সভাসমিতির যুগ' বলা হয়। ড. অনিল শীল ঊনবিংশ শতককে 'সভাসমিতির যুগ' বলে অভিহিত করেছেন।

2.উনিশ শতকে ভারতে গড়ে-ওঠা সভাসমিতি বা রাজনৈতিক সংগঠনগুলির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।

উত্তরঃ  উনিশ শতকে ভারতে গড়ে-ওঠা সভাসমিতিগুলির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল-[1] সর্বপ্রথম বাংলায় এই সংগঠনগুলির প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। [2] বাংলার অনুকরণে পরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও সংগঠন গড়ে ওঠে। [3] ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষার জন্য ব্রিটিশদের কাছে দাবিদাওয়া জানানো এসব সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল। [4] সাধারণত সমাজের শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তরাই এসব সংগঠনের সদস্য ছিল। [5] সাধারণ দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষদের মধ্যে সংগঠনগুলির বিশেষ প্রভাব পড়েনি।

3 .জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে প্রতিষ্ঠিত বাংলার উল্লেখযোগ্য সভাসমিতি বা সংগঠনগুলির নাম লেখো।

উত্তরঃ জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে প্রতিষ্ঠিত বাংলার উল্লেখযোগ্য সভাসমিতি বা সংগঠনগুলি হল- [1] বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা (১৮৩৬ খ্রি.), [2] জমিদার সভা (১৮৩৮ খ্রি.), [3] হিন্দুমেলা (১৮৬৭ খ্রি.), [4] ভারতসভা (১৮৭৬ খ্রি.) প্রভৃতি।

4. বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার দুটি উল্লেখযোগ্য কার্যাবলি উল্লেখ করো।

উত্তরঃ বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার দুটি উল্লেখযোগ্য কার্যাবলি হল- 1] ব্রিটিশ শাসকদের যেসব কার্যাবলির সঙ্গে ভারতীয়দের স্বার্থ জড়িত ছিল সেসব বিষয়ে এই সভায় আলোচনা চলত। [2] ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের এক আইনের দ্বারা নিষ্কর জমির ওপর কর আরোপ করা হলে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা নভা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

5.বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার সীমাবদ্ধতা কী ছিল?

উত্তরঃ  বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার সীমাবদ্ধতা ছিল-এই সভা সারা দেশে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কলে প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরই বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার অস্তিত্ব লুপ্ত হয়।

6. 'বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি' কবে এবং কী উদ্দেশ্যে প্রতিচ্ছ হয়?

উত্তরঃ ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল জর্জ টমসনের নেতৃত্বে 'বেক ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি' প্রতিষ্ঠিত হয়।

⇒'বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি'র উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল [1] একর সুনাগরিকের আদর্শ গুণাবলি ভারতীয় জনগণের মধ্যে গড়ে তোল [2] 'ন্যায্য অধিকার' সম্পর্কে ভারতীয়দের সচেতন করে তোল [3] ইংল্যান্ডের সার্বভৌম শাসকের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে ওইস 'ন্যায্য অধিকার' আইনের দ্বারা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে আদায় করা।

7. জমিদার সভা ও ভারতসভার মধ্যে দুটি পার্থক্য লেখো।

উত্তরঃ উনিশ শতকে গড়ে ওঠা জমিদার সভা ও ভারতসভার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল- [1] জমিদার সভা ছিল মূলত জমিদার ও ধাঁ ব্যবসায়ীদের সংগঠন। অন্যদিকে, ভারতসভা সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ো গণসংগঠন গড়ে তুলেছিল। [2] জমিদার সভার প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংল বিহার ও উড়িষ্যার জমিদারদের স্বার্থ রক্ষা করা। অন্যদিকে, ভারতস্যা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের সার্বিক কল্যাণসাধন ও স্বার্থরক্ষা।

৪.হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করো। অথবা, হিন্দুমেন কেন চৈত্রমেলা নামে পরিচিত হয়?

উত্তরঃ রাজনারায়ণ বসু ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় ঐক্য সহায়ক সমি প্রতিষ্ঠা করে ভারতীয় ভাষা শিক্ষা, জাতীয় ভাবধারার প্রসার ও সংস্থা শিক্ষার আদর্শ প্রচার করেন। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং সহযোগিত পেয়ে নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে চৈত্র সংক্রান্তির দিন হিন্দুমেলর প্রতিষ্ঠা করেন। এজন্য সংগঠনটি চৈত্রমেলা নামেও পরিচিত ছিল।

9. হিন্দুমেলার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম লেখো।

উত্তরঃ হিন্দুমেলার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রমান ঠাকুর, নবগোপাল মিত্র, রাজা কমলকৃয় বাহাদুর, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রমনার ঠাকুর, পিয়ারি চরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণদা পাল প্রমুখ।

10. নবগোপাল মিত্র কে ছিলেন?

উত্তরঃ  বাংলার অন্যতম জাতীয়তাবাদী তথা প্রসিদ্ধ লেখক ছিলে নবগোপাল মিত্র। তিনি জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ অব্যাহত রাখার উদ্রে হিন্দুমেলার সূচনা করেন। এর পূর্বনাম ছিল চৈত্রমেলা। ১৮৬৭ খ্রিস্টার তিনি জাতীয় সভাও প্রতিষ্ঠা করেন।

11. হিন্দুমেলার ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের বার্ষিক সভা সম্পর্কে কী জান?

উত্তরঃ হিন্দুমেলার ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করেন সেই সময়ের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব রাজনারায়ণ বসু। এই সভায় ১৪ বছর বয়স্ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের লেখা 'হিন্দুমেলার উপহার' কবিতাটি আবৃত্তি করেন। 

12. হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল?

উত্তরঃ  হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল-[1] সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে হিন্দুধর্মের অতীত গৌরবগাথা ছড়িয়ে দেওয়া, [2] দেশীয় ভাষা চর্চা করা, [3] জাতীয় প্রতীকগুলিকে মর্যাদা দেওয়া প্রভৃতি।

13 .দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদের বিকাশে হিন্দুমেলা কী ধরনের উদ্যোগ নেয়?

উত্তরঃ দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদের বিকাশে হিন্দুমেলা- [1] হিন্দুধর্মের অতীত গৌরবগাথা প্রচার, [2] দেশীয় ভাষা চর্চা, [3] জাতীয় প্রতীকগুলিকে মর্যাদা দান, [4] দেশের জয়গান, [5] দেশাত্মবোধক কবিতাচর্চা, [6] দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠা, [7] দেশীয় শরীরচর্চা প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করে।

14.হিন্দুমেলার সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল? অথবা, হিন্দুমেলা কেন জনপ্রিয়তা হারায়?

উত্তরঃ হিন্দুমেলার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ছিল-[1] নতুন প্রজন্মের বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি এই সংস্থাকে সমর্থন করেনি। [2] শিক্ষিত যুবকরা হিন্দুমেলার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক চিন্তায় আকৃষ্ট হয়নি। [3] হিন্দুমেলা দেশাত্মবোধের প্রচারে গুরুত্ব দিলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।

15. 'ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি' কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তরঃ ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি প্রতিষ্ঠার (১৮৩৮ খ্রি.) প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল-[1] চিরস্থায়ী ভূমিব্যবস্থার মধ্যে জমিদারদের নিজেদের স্বার্থরক্ষা করা। [2] খাজনা-মুক্ত ভূমিব্যবস্থা প্রণয়নের সরকারি উদ্যোগ প্রতিহত করা। [3] ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটানো।

16.কবে, কাদের উদ্যোগে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তরঃ ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতসভা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখ।

17.ভারতসভা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল?

উত্তরঃ ভারতসভা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল-[1] ভারতীয়দের সার্বিক কল্যাণসাধন ও স্বার্থরক্ষা। [2] শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটানো। [3] ভারতীয়দের দাবিদাওয়া আদায়ে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রভৃতি।

18.বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে ভারতসভার কী ভূমিকা ছিল?

উত্তরঃ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে ভারতসভা একটি জাতীয় ভাণ্ডার গড়ে তোলে। 

19.দেশবাসীর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ভারতসভা কী কর্মসূচি গ্রহণ করে? 

উত্তরঃ দেশবাসীর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ভারতসভা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে, যেমন- [1] ভারতীয়দের জনমত গঠন করা, [2] রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের. ঐক্যবদ্ধ করা, [3] হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করা, [4] স্বল্প শিক্ষিত ও সাধারণ ভারতীয়দের রাজনৈতিক গণ আন্দোলনে শামিল করা প্রভৃতি।

20.ভারতসভা ভারতীয়দের স্বার্থে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে?

উত্তরঃ ভারতসভা ভারতীয়দের স্বার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যেমন- [1] ভারতীয়দের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ১৯ থেকে বাড়িয়ে ২২ বছর করা, [2] লর্ড লিটনের 'দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন' ও 'অস্ত্র আইন' (১৮৭৮ খ্রি.) বাতিল, [3] বিচারব্যবস্থায় বর্ণবৈষম্যের অবসানকল্পে ভারতসভা-র ইলবার্ট বিলকে সমর্থন, [4] কৃষকদের ওপর শোষণের বিরুদ্ধে এবং দেশে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন-পরিষদ গঠনের দাবিতেও ভারতসভা আন্দোলন সংগঠিত করে।

21.সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কেন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসার বয়স বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করেন? 

অথবা, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের বয়স-সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতসভার আন্দোলনের পরিচয় দাও।

উত্তরঃ ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের ঊর্ধ্বতম বয়স ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করে। ফলে ১৯ বছর বয়সে ভারতীয় ছাত্রের পক্ষে বিলেতে গিয়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড ও ভারতে একইসঙ্গে এই পরীক্ষা গ্রহণ এবং পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স বাড়িয়ে ২২ বছর করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

22.'দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন' (১৮৭৮ খ্রি.)-এর বিরুদ্ধে ভারতসভার আন্দোলনের পরিচয় দাও।

উত্তরঃ বড়োলাট লর্ড লিটন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে 'দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন' প্রণয়ন করে দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেন। এর বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা আন্দোলন সংগঠিত করে।

23.'অস্ত্র আইন' (১৮৭৮ খ্রি.)-এর বিরুদ্ধে ভারতসভার আন্দোলনের পরিচয় দাও।

উত্তরঃ বড়োলাট লর্ড লিটন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে 'দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন' প্রণয়ন করে সরকারের অনুমতি ছাড়া ভারতীয়দের আগ্নেয়াস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ করেন। এর বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা আন্দোলন গড়ে তোলে।

24.'ইলবার্ট বিল' কী?

উত্তরঃ লর্ড রিপনের (১৮৮০-৮৪ খ্রি.) আগে এদেশে কোনো ভারতীয় বিচারক কোনো ইংরেজের বিচার করার অধিকারী ছিল না। এই বর্ণবৈষম্য দূর করার উদ্দেশ্যে রিপনের পরামর্শে তাঁর আইন সচিব ইলবার্ট একটি বিল রচনা করেন। এতে ভারতীয় বিচারকরা শ্বেতাঙ্গ ইংরেজদের বিচার করারও অধিকার পায়। এটি 'ইলবার্ট বিল' নামে পরিচিত।

25.ইলবার্ট বিলের সপক্ষে ভারতসভার আন্দোলন উল্লেখ করো।

উত্তরঃ লর্ড রিপন ইলবার্ট বিলের মাধ্যমে ভারতের কৃয়াঙ্গ বিচারকদের শ্বেতাঙ্গদের বিচার করার অধিকার দিলে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। ফলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা ইলবার্ট বিলের সমর্থনে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।

বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি

1.ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে স্বামী বিবেকানন্দের 'বর্তমান ভারত' গ্রন্থটির কী ভূমিকা ছিল?

উত্তরঃ ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে 'বর্তমান ভারত'-এর ভূমিকা-

ভূমিকা: স্বামী বিবেকানন্দের 'বর্তমান ভারত' (১৯০৫ খ্রি.) গ্রন্থটি ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ বলেছেন, "বিবেকানন্দই আমাদের জাতীয় জীবনের গঠনকর্তা।”

[1] গৌরবোজ্জ্বল অতীতের বর্ণনা: স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর 'বর্তমান ভারত' গ্রন্থে বৈদিক যুগ থেকে ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেছেন।

[2] ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা: বিবেকানন্দ উপলব্ধি করতেন যে, পরাধীন ভারতের মুক্তির জন্য প্রয়োজন ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা। তিনি ভারতীয় সমাজের বর্ণবৈষম্য ও দলিত বা শূদ্রদের প্রতি বঞ্চনার তীব্র নিন্দা করে সকল ভারতীয়ের ঐক্যের কথা বলেছেন।

[3] শূদ্র জাগরণের প্রত্যাশা: বিবেকানন্দ বলেছেন যে, বৈদিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত শূদ্রদের দমিয়ে রাখা হয়েছে। তাই এবার ভারতে শূদ্র জাগরণ ঘটবে এবং শূদ্র-সহ সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এভাবে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেই প্রকৃত স্বাধীনতার মূল্য থাকবে।

[4] দেশপ্রেমের আদর্শ: বিবেকানন্দ তাঁর গ্রন্থে ভারতবাসীকে স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। তিনি বলেন- “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, .... ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।" তাঁর আকুল আহ্বানে যুবসমাজের মনে স্বদেশপ্রেমের ঝড় বয়ে যায়।

[5] দেশমাতার মুক্তি: 'বর্তমান ভারত' গ্রন্থে বিবেকানন্দ বলেছেন যে, মানুষ জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ছেড়ে তিনি ভারতমাতার মুক্তির জন্য দেশবাসীকে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান। দেশমাতার কাছে তিনি আবেদন জানান, "আমায় মানুষ করো।"

উপসংহার: বিবেকানন্দ তাঁর 'বর্তমান ভারত' গ্রন্থে স্বদেশপ্রেমের যে আদর্শ ও বিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন তা ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে অন্য মাত্রা এনেছিল।

2.ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গোরা' উপন্যাসের কী ভূমিকা ছিল? 
অথবা, 'গোরা' উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার পরিচয় পাওয়া যায় তা বিশ্লেষণ করো।

উত্তরঃ ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে 'গোরা' উপন্যাসের ভূমিকা-

ভূমিকা: ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশপ্রেমের ভাবধারা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'গোরা' (১৯১০ খ্রি.) উপন্যাসটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

[1] প্রকৃত ভারতের রূপ: 'গোরা' উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গোরা বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের সুখ-দুঃখের খোঁজখবর নিতে গিয়ে ভারতবর্ষের সত্যিকারের রূপটি চিনতে পারে।

[2] গোরার উদ্যোগ: গোরা উপলব্ধি করে, শহরের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের চেয়ে পল্লিগ্রামের মানুষ অনেক বেশি সহজসরল। কিন্তু যথাযথ শিক্ষার প্রসার না-ঘটার ফলে এদের মধ্যে অনেকেই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এরা প্রয়োজনে মানুষকে সহায়তা বা বিপদে ভরসা না দিয়ে বরং সামাজিক আচারবিচারের কথা বলে মানুষে-মানুষে বিভাজন তৈরি করে। গোরা এরূপ সমাজের ওপর তীব্র আঘাত হেনে তাকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছে।

[3] ধর্মীয় পরিচয়ের গুরুত্বহীনতা: ভারতীয় সভ্যতার প্রতি ব্রিটিশদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ লক্ষ করে গোরা একসময় উগ্র হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু পরে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং সে উপলব্ধি করে, ধর্মীয় পরিচয় একমাত্র বা সবচেয়ে বড়ো পরিচয় নয়।

[4] ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা: রবীন্দ্রনাথের গোরা সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়। সে সংকল্প করে, স্বদেশের প্রতি স্বদেশবাসীর শ্রদ্ধা সে ফিরিয়ে আনবেই, তারপর অন্য কাজ। হিন্দুসভ্যতার বিরোধী জনৈক মিশনারির বিরুদ্ধে সে সম্মুখ বিতর্কে অংশগ্রহণেরও সিদ্ধান্ত নেয়।

[5] দেশাত্মবোধের প্রচার: মহিম বা কৃষ্ণদয়ালের মতো দু-একজন স্বার্থপর ব্যক্তি ছাড়া 'গোরা' উপন্যাসে উল্লেখিত ব্রাহ্মসমাজের অধিকাংশ সদস্যই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। "মা, তুমিই আমার মা", "আমি ভারতীয়" গোরার এসব উক্তি ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে।

উপসংহার: রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' উপন্যাসের গোরা হলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক। মূলত তার মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ভারতবাসীর মধ্যে প্রকৃত স্বদেশপ্রেমের আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছেন।

3. ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা 'ভারতমাতা' চিত্রটির কী অবদান ছিল?

 অথবা, জাতীয়তাবাদের প্রসারে 'ভারতমাতা' চিত্রের গুরুত্ব আলোচনা করো।

উত্তরঃ ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে 'ভারতমাতা' চিত্রের অবদান-

ভূমিকা: উনিশ শতকে 'লেখা' অর্থাৎ বিভিন্ন রচনা এবং 'রেখা' অর্থাৎ বিভিন্ন আঁকা ছবি ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা 'ভারতমাতা' (১৯০৫ খ্রি.) ছবিটি শিক্ষিত ও প্রগতিশীল ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

 [1] প্রেক্ষাপট: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের ব্রিটিশ-বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের সমান্তরাল সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই উদ্দেশ্যে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের (১৯০৫ খ্রি.) সময় হিন্দুদের ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর অনুকরণে তিনি 'ভারতমাতা' চিত্রটি অঙ্কন করেন।

[2] স্বদেশিয়ানার বিকাশ: অবনীন্দ্রনাথের চতুর্ভুজা 'ভারতমাতা'র চার হাতে রয়েছে বেদ, ধানের শিষ, জপের মালা ও শ্বেতবস্ত্র। এগুলি মূলত ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এগুলির দ্বারা শিল্পী স্বদেশি আন্দোলনের যুগে দেশবাসীর মনে স্বদেশিয়ানাও জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন।

[3] শান্তির প্রতীক হিসেবে গুরুত্বঃ হাতে কোনো অস্ত্র নেই। এর দ্বারা অবনীন্দ্রনাথ তাঁর স্বদেশি ভাবনাস সশস্ত্র আন্দোলনকে দূরে রেখেছেন।

[4] জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার: বিশ শতকের ব্রিটিশবিরে জাতীয় আন্দোলনে মিছিলের সামনে 'ভারতমাতা' চিত্রটি রাখা হত নবজাগ্রত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বারে আন্দোলনই ছিল 'ভারতমাতা' অঙ্কনের অনুপ্রেরণা।

[5] বিতর্ক: 'ভারতমাতা'-র চিত্রটির মধ্যে কেউ কেউ হিয় স্বাদেশিকতার প্রভাব খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অবনীন্দ্রনা বাস্তবে হিন্দু স্বাদেশিকতার উগ্র সমর্থক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া বয় না। ভগিনী নিবেদিতা 'ভারতমাতা' চিত্রটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছে।

উপসংহার: 'ভারতমাতা' চিত্রটি ছিল ব্রিটিশ-বিরোধী স্বদেশপ্রেমের মা প্রতীক। এই চিত্রটির মধ্য দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ভারতবাসীর সামনে অহিসে জাতীয়তাবাদের প্রতিচ্ছবিটি তুলে ধরেছেন।

বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলি বা MCQ

সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করো

1. 'আনন্দমঠ' উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়-

(a) ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে
(c )  ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে

উত্তরঃ (b) ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে

2. "বন্দেমাতরম্” সংগীতটি রচিত হয়-

(a) ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে
(c ) ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে

উত্তরঃ (c ) ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে

3. 'বন্দেমাতরম' সংগীতটি রচনা করেন-

(a) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(b) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c ) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(d) স্বামী বিবেকানন্দ        

উত্তরঃ (c ) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

4. জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে বন্দেমাতরম গানটি পরিবেশন করা হয়-

(a) ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে
(c ) ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে

উত্তরঃ (c ) ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে

5. 'বর্তমান ভারত' গ্রন্থটি রচনা করেন-

(a) অক্ষয়কুমার দত্ত
(b) রাজনারায়ণ বসু
(c ) স্বামী বিবেকানন্দ
(d) রমেশচন্দ্র মজুমদার

উত্তরঃ (c ) স্বামী বিবেকানন্দ

6. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'গোরা' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়-

(a) ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে
(b) ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে
(c ) ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে
(d) ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে

উত্তরঃ (a) ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে

7. 'ভারতমাতা' চিত্রটি আঁকেন-

(a) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(b) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c )নন্দলাল বসু
(d) গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর  

উত্তরঃ(a) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
৪. আধুনিক ভারতে প্রথম ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল-

(a) সোম প্রকাশ পত্রিকায়
(b) বামাবোধিনী পত্রিকায়
(c ) হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায়
(d) অমৃতবাজার পত্রিকায়

উত্তরঃ (d) অমৃতবাজার পত্রিকায়

9. নব্যবঙ্গ চিত্রকলার পথিকৃৎ ছিলেন-

(a) গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(b) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(c )অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(d) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর 

উত্তরঃ (c )অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

10. এখানে আলাদা গোত্রের উপাদানটি হল-

(a) ভারতমাতা
(b) গোরা
(c ) আনন্দমঠ
(d)  বর্তমান ভারত

উত্তরঃ (a) ভারতমাতা

11.গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন-

(a) সংগীত শিল্পী
(b) নাট্যকার
(c ) কবি
(d) ব্যঙ্গ চিত্রশিল্পী

উত্তরঃ (d) ব্যঙ্গ চিত্রশিল্পী

12. ‘খলব্রাহ্মণ’ চিত্রটি এঁকেছেন-

(a)অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(b) নন্দলাল বসু
(c )  সরলাদেবী চৌধুরানি
(d) গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

উত্তরঃ (d) গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থীদের জন্য় প্রশ্নোত্তর

1. তুমি কি মনে করো সাঁওতাল বিদ্রোহ মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।

উত্তরঃ ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহকে অনেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত বলে মনে করেন। কারণ-

[1] প্রথম বৃহৎ বিদ্রোহ: সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম সর্ববৃহৎ আন্দোলন। এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, ইংরেজ শক্তি অপরাজেয় নয়।

[2] স্বাধীনতার জন্য লড়াই: অনেক সাঁওতাল বিদ্রোহী এই বিদ্রোহকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই বলে মনে করেছিলেন। পরবর্তী মহাবিদ্রোহেও স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, নিজেদের স্বাধীনতার জন্য ভারতীয়রা লড়াই করতে জানে।

[3] দেশবাসীকে সচেতন: সাঁওতাল বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি যেমন-কৃষক শোষণ, দুর্নীতি, অপশাসন, শ্বেতাঙ্গের ঔদ্ধত্য প্রভৃতি বিষয়কে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে ভারতবাসীকে সচেতন করে তোলেন। এই সচেতনতা পরবর্তী মহাবিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

[4] মহাবিদ্রোহে আদিবাসী: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বহু মানুষও অংশ নিয়েছিল। এই অংশগ্রহণের প্রবণতা তৈরি করে দিয়েছিল ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ।

2. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের কারণগুলি কী ছিল?
অথবা, সাঁওতাল বিদ্রোহ কি মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত?

উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের কারণ-

ভূমিকা: ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্যারাকপুর সেনা- বাহিনীর সিপাহি মঙ্গল পান্ডে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এই বিদ্রোহ দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন-

[1] স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ: লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতির দ্বারা ঝাঁসি, সাতারা, নাগপুর, সম্বলপুর, তাঞ্জোর, কর্ণাটক-সহ বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য দখল করলে সেসব রাজ্যের রাজারা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়।

[2] অর্থনৈতিক শোষণ: ব্রিটিশ শাসনে ভারতে চরম অর্থনৈতিক শোষণ শুরু হয়। রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি পায়, কুটির শিল্প ধ্বংস হলে বেকারত্ব বাড়ে।

[3] ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সর্বত্র ইংরেজরা ভারতীয়দের ঘৃণার চোখে দেখত। বহু ইউরোপীয় ক্লাবের দরজায় লেখা থাকত 'কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ'।

[4] ভারতীয় কর্মচারীদের অবজ্ঞা: ব্রিটিশ রাজকর্মচারীরা ভারতীয় রাজকর্মচারীদের খুবই ঘৃণা ও হেনস্থা করত।

[5] ভারতীয়দের রক্ষণশীল মনোভাব: ভারতীয়রা এদেশে বিদেশি শ্বেতাঙ্গ শাসন কখনোই মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। মুঘল শাসনের পতন ঘটানোর জন্য মুসলিমরা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুদ্ধ ছিল। আবার সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ, বিধবাবিবাহ প্রচলন প্রভৃতির জন্যও রক্ষণশীল হিন্দুরা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুদ্ধ ছিল।

[6] ভারতীয় সৈন্যদের প্রতি বৈষম্য: ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সেনারা নানা বৈষম্যের শিকার হয়। ব্রিটিশ সেনারা ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে নানা দুর্ব্যবহার করত।

[7] ধর্মীয় অসন্তোষ: খ্রিস্টান মিশনারিরা প্রকাশ্যে ভারতীয়দের ধর্মের নিন্দা করত এবং তাদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা চালাত।

[৪] প্রত্যক্ষ কারণ: সরকার সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড নামক রাইফেল চালু করে। গোরু ও শূকরের চর্বি মিশিয়ে এর টোটা তৈরি হত বলে গুজব ছড়ায়। এই টোটা দাঁত দিয়ে কেটে ধর্মনাশের আশঙ্কায় ভারতীয় সেনারা বিদ্রোহ শুরু করে।

উপসংহার: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১০০ বছর পর অর্থাৎ পলাশির যুদ্ধের এক শতাব্দী পরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এই বিদ্রোহ ছিল এক গণ অভ্যুত্থান। তবে প্রথম দিকে এই বিদ্রোহ সাফল্য লাভ করলেও পরে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

3. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূত্রপাত ও প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।
 
উত্তরঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূত্রপাত ও প্রসার-

ভূমিকা: ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার ও শোষণ ভারতের সর্বস্তরের মানুষের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে এনফিল্ড রাইফেল-এর টোটার ব্যবহারকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সিপাহিরা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।

 [1] বহরমপুরে বিক্ষোভ: সর্বপ্রথম মুরশিদাবাদের বহরমপুর সেনানিবাসের ১১ নং নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সিপাহিরা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম বিক্ষোভ দেখায়।

[2] মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহ ঘোষণা: ব্যারাকপুর সেনানিবাসের ৩৪ নং নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সিপাহিরা অভ্যুত্থান ঘটায়। এখানকার সিপাহি মঙ্গল পান্ডে (১৮২৭-৫৭ খ্রি.) ২৯ মার্চ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সরকার মঙ্গল পান্ডেকে গ্রেফতার করে। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। তিনি হলেন বিদ্রোহের প্রথম শহিদ।

[3] সেনা বিদ্রোহের প্রসার: ব্যারাকপুরের সেনা অভ্যুত্থানের খবর শীঘ্রই দেশের অন্যান্য সেনানিবাসে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১০ মে মিরাট এবং ১১ মে দিল্লি সেনানিবাসে বিদ্রোহ শুরু হয়।

[4] জনগণের অংশগ্রহণ: সিপাহি বিদ্রোহ ক্রমে অযোধ্যা, কানপুর, লখনউ, এলাহাবাদ, মোরাদাবাদ, ফৈজাবাদ, ঝাঁসি, পাটনা প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।

উপসংহার: ১৮৫৭-এর বিদ্রোহ মূলত উত্তর ভারত জুড়েই হয়েছিল, দক্ষিণ- ভারতে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।

4. ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণগুলি কী ছিল? 

উত্তরঃ ভারতীয় মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ-

ভূমিকা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ সারা দেশে ব্যাপক আকার ধারণ করলেও শেষপর্যন্ত এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন-

[1] বিদ্রোহের বিচ্ছিন্নতা: ভারতের সর্বত্র একযোগে বিদ্রোহ না হয়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্রোহ পরিচালিত হয়। ফলে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে বিদ্রোহ দমন সহজ হয়।

[2] শিখ-গোর্খাদের সহযোগিতা: বিদ্রোহের সময় শিখ, গোর্খা প্রভৃতি সৈন্যরা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সমর্থন জানায় এবং বিদ্রোহ দমনে সরকারকে যথেষ্ট সহায়তা করে।

[3] নেতৃত্বের অভাব: বিদ্রোহ পরিচালনা করার মতো কোনো সর্বভারতীয় নেতৃত্ব ছিল না। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নেতারা ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ বা পরিকল্পনা নিয়ে বিদ্রোহ পরিচালনা করলে বিদ্রোহ তার গতি হারিয়ে ফেলে।

[4] দেশীয় রাজ্যের সহযোগিতা: কাশ্মীর, রামপুর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যগুলি বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের সহযোগিতা করে। সিপিয়া ও রাজপুত রাজারা বিদ্রোহীদের সহযোগিতা না করে নিরপেক্ষ নীতি নেয়। ফলে বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সুবিধা হয়।

[5] শিক্ষিত শ্রেণির অসহযোগিতা: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ ১৮৫৭-এর বিদ্রোহের প্রতি সমর্থন না জানিয়ে বিদ্রোহ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে এবং ইংরেজদের প্রতি অনুরাগ দেখায়। ফলে বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সুবিধা হয়।

[6] দক্ষ সেনানায়কের অভাব: বিদ্রোহীদের মধ্যে দক্ষ ও যোগ্য সেনানায়কের যথেষ্ট অভাব ছিল। অন্যদিকে ইংরেজ বাহিনীতে হ্যাভেলক, নীল, আউট্রাম প্রমুখ সুদক্ষ সেনাপতিগণ ছিলেন।

 [7] ব্রিটিশ-শক্তির পরাক্রম: সিপাহিদের তুলনায় ব্রিটিশবাহিনীর অস্ত্রশক্তি ও নৌশক্তি অনেক বেশি ছিল। ব্রিটিশরা ইংল্যান্ড, পারস্য ও মালয় থেকে বহু সৈন্য ও অস্ত্র এনে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে।

উপসংহার: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও এটি ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক বৃহৎ সংগ্রাম। এই বিদ্রোহের পরই ভারতে কোম্পানিরাজের অবসান ঘটে এবং সূচনা হয় ব্রিটিশরাজের।

5. উনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে কোন্ কোন বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে?

উত্তরঃ ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে বিভিন্ন বিষয়ের ভূমিকা-

ভূমিকা: উনিশ শতকে ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। এই জাতীয়তাবোধের বিকাশে বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। যেমন- /

[1] সংবাদপত্র: উনিশ শতকে প্রথম বঙ্গদেশে এবং পরে অন্যান্য প্রদেশে সংবাদপত্রের প্রকাশ শুরু হয়। 'সমাচার দর্পণ', 'সম্বাদ কৌমুদী', 'সমাচার চন্দ্রিকা', 'সংবাদ প্রভাকর', 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট', 'সোমপ্রকাশ', 'বামাবোধিনী', 'বঙ্গদর্শন' প্রভৃতি সংবাদপত্রে ঔপনিবেশিক শাসনের ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। এর ফলে ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবোধ জেগে ওঠে।

[2] রাজনৈতিক সংগঠন: উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জমিদার সভা, পুনা সার্বজনিক সভা, হিন্দুমেলা, ভারতসভা, জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি। এসব সংগঠন নিয়মিত প্রচারের মাধ্যমে দেশবাসীর মনে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে। 

 [3] দেশাত্মবোধক সাহিত্য: ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয় সাহিত্যিকদের লেখা বিভিন্ন সাহিত্য ও গ্রন্থ দেশবাসীর মনে জাতীয়তাবোধের বিকাশে যথেষ্ট সহায়তা করে। যেমন- দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ', বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দমঠ', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গোরা', স্বামী বিবেকানন্দের 'বর্তমান ভারত', রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা 'স্বাধীনতা হীনতায়' প্রভৃতি।

[4] দেশাত্মবোধক চিত্রকলা: ঔপনিবেশিক আমলের শেষ শতকে বিভিন্ন ভারতীয় চিত্রকর দেশাত্মবোধক বিভিন্ন ছবি আঁকেন। এগুলিও ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবোধের বিকাশে সহায়তা করে। এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বঙ্গমাতা', 'ভারতমাতা' প্রভৃতি।



Editing By:- Lipi Medhi







































জেনে রাখোইংরেজ সেনাপতি হিউ রোজ ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইকে বিদ্রোহীদের মধ্যে 'সর্বোত্তমা ও সর্বাপেক্ষা সাহসিনী' বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, লক্ষ্মীবাই ছিলেন 'বিদ্রোহীদের মধ্যে একমাত্র পুরুষ'।





















জেনে রাখো  মহারানির ঘোষণাপত্রে ভারতীয়দের বহু আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে সেগুলির অধিকাংশ রূপায়িত হয়নি। তাই ভারতীয়দের ক্ষোভও প্রশমিত হয়নি। এই ক্ষোয় থেকে বাংলা তথা ভারতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা শুরু হয়।





























































































































































































































































































































































জেনে রাখো জমিদার সভা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ জেনে রাখো পর্যন্ত এই সভার ক্ষীণ অস্তিত্ব টিকেছিল। পরে এর স্থান দখল করে নেয় বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (১৮৪৩ খ্রি.)।














































































































































































































Buy Class 10

3. এটি পণ্য কোড (Product Code) ব্যবহার করুন :  DAM000059