Chapter 11
---------------------
১. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও:
১.১ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীর নাম কী?
উত্তর: প্রসিদ্ধ ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীর নাম 'জীবনকথা'।
১.২ ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে কোন্ গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন?
উত্তর: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ্যাত অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'The Origin and Development of the Bengali Language' নামের ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ রচনার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
২. নীচের প্রশ্নগুলির একটি বাক্যে উত্তর দাও:
২.১ লেখকের কোন্ ট্রেন ধরার কথা ছিল?
উত্তর: লেখক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'দেহরা-দুন এক্সপ্রেস' ট্রেন ধরার কথা ছিল।
২.২ একটা তৃতীয় শ্রেণির বগির কাছে একেবারেই লোকের ভিড় নেই কেন?
উত্তর: 'পথচল্লি' নামাঙ্কিত গল্পে একটা তৃতীয় শ্রেণির বগির কাছে একেবারেই লোকের ভিড় না থাকার কারণ হল, ট্রেনের সেই অংশটি ছিল কাবুলিওয়ালাদের দখলে।
২.৩ পাঠানদের মাতৃভাষা কী?
উত্তর: পাঠানদের মাতৃভাষা হল 'পশতু'।
২.৪ বৃদ্ধ পাঠানের ডেরা বাংলাদেশের কোথায় ছিল?
উত্তর: বৃদ্ধ পাঠানের ডেরা ছিল বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলের পটুয়াখালি বন্দরে।
২.৫ খুশ-হাল খাঁ খট্টক কে ছিলেন?
উত্তর: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচল্লি' গল্পে খুশ-হাল খাঁ খট্টক ছিলেন ঔরঙ্গজেবের সমসাময়িক এবং পাঠানদের পশতু ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।
২.৬ আদম খাঁ ও দুরথানির কিসসার কাহিনি কেমন?
উত্তর: আদম খাঁ ও দুরখানির মহব্বতের কিসসার কাহিনি হল করুণ-রসাত্মক।
২.৭ এই পাঠ্যে কোন্ বাংলা মাসিকপত্রের উল্লেখ আছে?
উত্তর: এই পাঠ্যে 'প্রবর্তক' নামের বাংলা মাসিকপত্রের উল্লেখ আছে।
২.৮ রোজার উপোসের আগে কাবুলিওয়ালারা ভরপেট কী খেয়েছিলেন?
উত্তর: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচল্লি' গল্পে রোজার উপোসের আগে কাবুলিওয়ালারা বড়ো বড়ো পাঠান 'রোটা' আর কাবাব ভরপেট খেয়েছিলেন।
২.৯ 'তসবিহ' শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: 'তসবিহ' শব্দের অর্থ 'জপমালা' (মুসলমানদের ক্ষেত্রে)।
২.১০ আরবি ভাষায় ঈশ্বরের নিরানব্বইটি পবিত্র ও সুন্দর নামকে কী বলা হয়?
উত্তর: আরবি ভাষায় ঈশ্বরের নিরানব্বইটি পবিত্র ও সুন্দর নামকে 'নব্বদ-ও-নও অসমা-ই-হাসানা' বলা হয়।
৩. নিম্নলিখিত শব্দগুলির সন্ধি বিচ্ছেদ করো : হুংকার, স্বস্তি, বিষয়ান্তর।
উত্তর: হুংকার: হুম্ + কার, স্বস্তি: সু+ অস্তি, বিষয়ান্তর: বিষয় + অন্তর।
৪. নিম্নলিখিত শব্দগুলির প্রকৃতি-প্রত্যয় নির্ণয় করো: ফিরতি, আভিজাত্য, জবরদস্ত, নিবিষ্ট, উৎসাহিত।
উত্তর: ফিরতি: ফির্ + তি, আভিজাত্য অভিজাত + য, জবরদস্ত: জবর + দস্ত, নিবিষ্ট: নি-বিশ্ + ত, উৎসাহিত : উৎসাহ + হিন্ + ত।
৫. নির্দেশ অনুযায়ী বাক্য পরিবর্তন করো :
১. গাড়িতে সেদিন অসম্ভব ভিড় দেখা গেল। (না-সূচক বাক্যে)
উত্তর: গাড়িতে সেদিন ভিড় একটুও কম দেখা গেল না।
২. কাবুলিওয়ালা পাঠানদের মাতৃভাষা পশতুর সম্মান তখন ছিল না। (প্রশ্নবোধক বাক্যে)
উত্তর: কাবুলিওয়ালা পাঠানদের মাতৃভাষা পশতুর তখন সম্মান ছিল কি?
৩. কলকাতার ভাষা তাঁর আয়ত্ত হয়নি। (জটিল বাক্যে)
উত্তর: কলকাতার যে ভাষা সে ভাষা তাঁর আয়ত্ত হয়নি।
৪. দুই-একজন মাঝে-মাঝে এক-আধ লবজ ফারসি বললে বটে, কিন্তু এদের বিদ্যেও বেশিদূর এগোল না। (সরল বাক্যে)
উত্তর: দুই-একজন মাঝে মাঝে এক-আধ লবজ ফারসি বললেও এদের বিদ্যে বেশিদূর এগোল না।
৫. বাংলাদেশে তোমার ডেরা কোথায়? (নির্দেশক বাক্যে)
উত্তর: বাংলাদেশে তোমার ডেরা কোথায় বলো।
৬. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর কয়েকটি বাক্যে লেখো:
১. স্টেশনে পৌঁছে লেখক কী দেখেছিলেন?
উত্তর: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচল্লি' গল্পে লেখকের গয়াস্থিত শ্বশুরবাড়ি থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের এক অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে।
দেহরা-দুন এক্সপ্রেস ধরার জন্যে স্টেশনে পৌঁছে লেখক দেখেন গাড়িতে সেদিন অসম্ভব ভিড়। মধ্যমশ্রেণির কোনো কামরায় তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই। দ্বিতীয় শ্রেণির গাড়িগুলিতেই লোকে মেঝেতে বিছানা নিয়ে, কোথাও বা বসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ তৃতীয় শ্রেণির একটা বড়ো 'বগি'র কাছে একেবারেই লোকের ভিড় নেই। লেখক এগিয়ে গিয়ে দেখেন 'এই বিরাট গাড়িখানি গুটিকতক কাবুলিওয়ালার দখলে।' কেউ সেদিকে গেলে বা জানলা দিয়ে উঁকি দিলে তারা হুংকার ছেড়ে জানান, 'ইয়ে গাড়ে তোমারা ওয়াস্তে নেহি-জো তুম উদর।' জবরদস্ত চেহারার সেই কাবুলিওয়ালাদের ভয়ে রেলের কর্মচারি, এমনকি পুলিশ পর্যন্ত তাদের ত্রি-সীমানাতে যাচ্ছে না।
২. দু-চারটি ফারসি কথা বলতে পারার ক্ষমতা লেখককে কী রকম সাহস দিয়েছিল?
উত্তর: প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচল্লি' গল্পে লেখক জানিয়েছেন 'আমি দু-চারটি ফারসি কথা বলতে পারি।' লেখকের ফারসি ভাষায় যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি থাকায় সেই কাবুলিওয়ালাদের ভিড়ে ঠাসা কামরায় ওঠা এবং তাঁর নিজের জায়গাটি করে নেওয়া সহজ হয়েছিল।
লেখক বুঝতে পেরেছিলেন কাবুলিওয়ালা পাঠান হলেও শিক্ষিতজনের ভাষা, উচ্চ ও ভদ্রসমাজের ভাষা, সরকারি ভাষা-ফারসি জানে না। তাদের মাতৃভাষা হল পশতু। যদিও কাবুলিওয়ালা পাঠানদের এই মাতৃভাষার সম্মান তখনও ছিল না। লেখকের মনে হয়েছিল এদের মধ্যে ফারসি বলাটা একটা শিক্ষা ও আভিজাত্যের প্রকাশ তাই। তিনি ফারসি দু-একটি কথা বলবেন। বাঙালি হয়ে চমৎকার ফারসি ভাষায় কথা বলবার ফলে লেখককে দেখে কাবুলিওয়ালারা অবাক হয়েছিল। তারা যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে লেখককে বসবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ফারসি ভাষা জানার ফলে এবং পাঠানদের সাহিত্য সংস্কৃতির অজানা বহু তথ্য প্রকাশ করবার ফলে কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে একই কামরায় উঠে সানন্দে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন।
৩. 'আলেম' শব্দের মানে কী? লেখককে কারা, কেন 'এক মস্ত আলেম' ভেবেছিলেন?
উত্তর:উত্তরের প্রথমাংশ: বহুভাষাবিদ মনীষী অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচল্লি' গল্পে 'আলেম' শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এর অর্থ হল 'সর্বজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তি'।
উত্তরের দ্বিতীয়াংশঃ লেখককে 'আলেম' শব্দে চিহ্নিত করেছিলেন দেহরা-দুন এক্সপ্রেসের তৃতীয় শ্রেণির কামরায় থাকা কাবুলিওয়ালারা। বাঙালি হয়েও লেখক রীতিমতো ফারসি ভাষায় বাক্যালাপ করতে পারতেন। একজন বাঙালির পক্ষে এই পান্ডিত্য অর্জন করা কী করে সম্ভব তা ভেবে অভিভূত হয়েছিল কাবুলিওয়ালারা। তারা ভেবেছিল কলকাতার এই বাঙালিবাবু দিব্যি তাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। ফলে লেখককে তারা নিজেদের কাছে বসার ব্যবস্থা করে দেয়। এমনকি দিব্যি লেখকের সঙ্গে কথা বলেন। লেখকের ফরাসি ভাষা জানার কারণেই লেখককে তারা 'এক মস্ত আলেম' ভেবে নিয়েছিল।
৪. আগা-সাহেব সম্বন্ধে যা জানা গেল, সংক্ষেপে লেখো।
উত্তর: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচল্লি' গল্পে 'আগা-সাহেব'-এর প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে।
সুনীতিকুমার শ্বশুরবাড়ি থেকে কলকাতায় ফেরার পথে দেহরা-দুন এক্সপ্রেসের তৃতীয় শ্রেণির একটি কামরায় ওঠেন। সেখানে বৃদ্ধ আগা সাহেবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। আগা সাহেব জাতিতে ছিলেন পাঠান। কিন্তু বাঙালির আদব-কায়দা এমনকি ভাষা ও সংস্কৃতিও তিনি ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। আসলে বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলের পাটুয়াখালিতে তার নিজস্ব একটি আস্তানা আছে। সেখানে তিনি শীতের জামাকাপড় ও হিংয়ের ব্যাবসা করেন। প্রয়োজনে কৃষকদের টাকা ধারও দেন। এর ফলে দীর্ঘদিন বরিশালে থাকায় বাঙাল ভাষা ও বাঙ্গালি উপভাষা তাঁর রপ্ত হয়েছে। অবশ্য তিনি কলকাতার রাঢ়ি ভাষায় ততখানি অভ্যস্ত নন। ধর্মপ্রাণ আগা সাহেব ভোরে উঠেই 'তসবিহ' বা 'মালা জপ' করেন।
৫. লেখকের সামনের বেঞ্চির দুই পাঠান সহযাত্রী নিজেদের মধ্যে যে আলোচনা করছিলেন তা নিজের ভাষায় লেখো। লেখক কীভাবে সেই কথার অর্থ বুঝতে পারলেন?
উত্তর: উত্তরের প্রথমাংশ: প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচন্তি' গল্পে দেখা যায় গয়া থেকে কলকাতায় ফেরার পথে তিনি কাবুলিওয়ালাদের কামরায় উঠেছিলেন। যোলোজন পাঠান কাবুলিওয়ালার দখলে থাকা সেই কামরায় উঠে তিনি তাঁর পাণ্ডিত্য, বুদ্ধিমত্তা ও বহুভাষা জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন। লেখক তাঁর সামনের বেঞ্চে বসে থাকা দুই পাঠান সহযাত্রীর কথা থেকে বুঝেছিলেন লেখক সম্পর্কেই তারা নিজেদের মধ্যে কিছু বলছেন। যেমন-
(ক) তারা বলছিলেন লেখক অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিদ্বান। (খ) ইংরেজদের লেখা সব বই তিনি পড়েছেন। (গ) তিনি চমৎকার ফারসি ভাষা জানেন। (ঘ) পাঠানদের সম্পর্কেও তাঁর শ্রদ্ধা যথেষ্ট। (ঙ) তাদের অনেক গ্রাম্য দেহাতি ভাষাও তাঁর জানা আছে।
উত্তরের দ্বিতীয়াংশ: লেখক আঞ্চলিক ভাষা 'পশতু' না জানলেও দুই পাঠান সহযাত্রীর মুখের ভাষায় পেয়েছিলেন প্রচুর পরিমাণে ফারসি ও আরবি শব্দ। তিনি আরবি, ফারসি ও উর্দু-তিনটি ভাষাতেই গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ফলে সেই জ্ঞান থেকে পাঠান সহযাত্রীদের আলাপচারিতা অনুধাবন করা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল।
৮. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের ভাষায় লেখো:
১. পাঠ্য গদ্যটির ভাবের সঙ্গে 'পথচল্লি'- নামটি কতখানি সংগতিপূর্ণ হয়েছে, বিচার করো।
উত্তর: 'What's need a name?' বলেছিলেন শেক্সপিয়ার। তবু নামের মধ্যেই রয়ে যায় বিষয়ের সংকেত।
গয়া থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পথে লেখক অপেক্ষাকৃত একটি ফাঁকা কামরা দেখে সেখানে উঠে পড়েন। ষোলোজন পাঠান কাবুলিওয়ালার দখলে থাকা সেই কামরায় ওঠার মুহূর্তে পাঁচ-ছয়জন গম্ভীর স্বরে হুংকার দিয়ে জানিয়েছিল- 'কিদর আতে হোত? ইয়ে গাড়ে তুম লোগ কে ওয়াস্তে নেহি'। কিন্তু পথচল্লি জীবনে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের বোঝাপড়া থাকা উচিত। তাই লেখক ফরাসি ভাষায় কথা বলেন এবং অনুভব করেন এদের কেউ সে ভাষার সঙ্গে পরিচিত নয়। লেখক ফারসি ভাষায় খুব সুন্দর বাবিনিময় করলে ফারসি-বলিয়ে ছোকরা জানায়, 'ভিতরে এসো'। লেখক জানান, 'গুরুবলে রক্ষা পেলুম'।
একটি কামরায় ষোলোজন পাঠান এবং তার মধ্যে লেখক বসে আছেন। এরা 'পশতু' ভাষায় কথা বলে চলেছিল। তাদের সঙ্গে অবশ্য বাংলার পল্লি অঞ্চলে, বরিশালের পাটুলিখালিতে ব্যাবসা করা এক বৃদ্ধ পাঠানের সঙ্গে লেখকের ভাববিনিময় হয়েছিল। সেই বৃদ্ধ আগা-সাহেব বরিশালের ভাষা একেবারে মাতৃভাষার মতোনই বলতে পারেন। যদিও কলকাতার ভাষা তার আয়ত্ত হয়নি। লেখক কথাপ্রসঙ্গে 'পশতু' ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে কথা বললে কাবুলিওয়ালারা খুব খুশি হয়। তারা লেখককে 'এক মস্ত আলেম' বলে চিহ্নিত করেন।
বন্ধুত্ব, পারস্পরিক বোঝাপড়া, একের সঙ্গে অন্যের ভাববিনিময়ে কতখানি মানুষকে আপন করে নেওয়া যায় তারই অসাধারণ আখ্যান হল 'পথচল্লি'। পথ চলার নানা মুহূর্তগুলি কীভাবে লেখকের জীবনে বিশেষ অভিজ্ঞতার সঞ্চার করেছিল তারই যথাযথ বর্ণনায় এই গল্পের নামকরণ হয়েছে সংগতিপূর্ণ।
২। পাঠ্য গদ্যাংশটি থেকে কথকের চরিত্রের কোন্ বৈশিষ্টগুলি তোমার চোখে ধরা পড়েছে, বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে লেখো।
উত্তর: বহুভাষাবিদ মনীষী অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচল্লি' গল্পে কথক চরিত্রের মধ্যে বিশেষ কতকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন-
১। অসম সাহসী : 'পথচল্ল্ভি' গল্পের শুরুতেই লেখক জানিয়ে দেন 'শ্বশুরালয় গয়া থেকে ফিরছি।' কিন্তু সেদিন গাড়িতে অসম্ভব ভিড়। কোনো কামরাতেই ওঠা যাচ্ছিল না। লেখক বাধ্য হয়ে কাবুলিওয়ালাদের দখলে থাকা তৃতীয় শ্রেণির একটি 'বগি'তে উঠে পড়েন। পাঁচ-ছয় জন গুরুগম্ভীর স্বরে হুংকার দিয়ে জানিয়েছিল-'ইয়ে গাড়ে তুম লোগ কে ওয়াস্তে নেহি'। একথা শোনার পরেও তিনি কোনো দ্বিধা-দ্বন্দু-সংশয় না রেখে সেই কামরাতেই উঠে পড়েন। তাঁর অসম সাহসিকতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হল কাবুলিওয়ালাদের কামরায় ওঠা।
২৷ বহুভাষাবিদ : সুনীতিকুমার ছিলেন বহুভাষাবিদ। তিনি কাবুলিওয়ালাদের সামনে নিখুঁতভাবে আফগানিস্তানের জাতীয় ভাষা ফারসিতে কথা বলছিলেন। এমনকি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন-
আফগানিস্তানের কোন অঞ্চল থেকে আসছ যে ফারসিতে কথা বলবার ক্ষমতা তোমাদের নেই?
লেখকের আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা ছিল।
৩। সংগীত প্রেমিকঃ লেখকের সংগীত প্রেমিক মনের যথাযথ পরিচয় উঠে আসে পাঠানের 'পশতু' ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি খুশ-হাল খাঁ খট্রকের গজল সম্পর্কিত আলোচনায়।
৪। সাহিত্য প্রেমিক: দেশি ভাষায় রচিত 'আদম খাঁ-দুরথানির কিস্সা'র প্রসঙ্গে লেখকের সাহিত্য প্রেমিক মনটির পরিচয় পাওয়া যায়।
৫। আন্তরিকতা: অদ্ভুত এক আন্তরিকতায় লেখক পাঠানদের আপন করে নিয়েছিলেন। ক্ষণেকের সহযাত্রী ভিন্নজাতির বন্ধুরা তাঁর সঙ্গ-সুখ লাভ করে ধন্য হয়েছিল।
৩. কথকের সঙ্গে কাবুলিওয়ালাদের প্রারম্ভিক কথোপকথনটি সংক্ষেপে বিবৃত করো।
উত্তর: প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচলতি' গল্পে গয়া থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পথে কথকের সঙ্গে কাবুলিওয়ালার প্রারম্ভিক কথোপকথনের অসাধারণ একটি আলাপচারিতা রয়েছে।
সম্ভবত ১৯২৮-এর এক শীতকালে গয়া থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের সময় লেখক দেখেন গাড়িতে অসম্ভব ভীড়ের কারণে কোনো কামরাতে তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই। বাধ্য হয়ে তিনি তৃতীয় শ্রেণির 'বগি'র কাছে আসেন এবং দেখেন 'এই বিরাটখানি গুটিকতক কাবুলিওয়ালার দখলে।'
লেখক বাধ্য হয়ে সেই কামরাতেই ওঠেন। তিনি যেহেতু দু-চারটি ফারসি কথা অনায়াসেই বলে ফেলতে পারতেন সেইহেতু তাঁর মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে, পাঠানদের তিনি বোঝাতে সক্ষম হবেন। কিন্তু সেই কামরায় উঠতে গেলেই পাঁচ-ছয়জন একসঙ্গে গুরুগম্ভীর স্বরে হুংকার দিয়ে ওঠে-
ইয়ে গাড়ে তুম লোগ কে ওয়াস্তে নেহি, সির্ফ হম পঠান-লোগ ইসমে জাতে হৈঁ।
লেখক অবশ্য তাদেরকে জানান, তাকে জায়গা দেওয়া হোক, শুধু একজন মানুষের জন্য। একথাটুকু তিনি আফগানিস্তানের সরকারি ভাষা ফারসিতে বলায় তারা হতভম্ব হয়ে যায়। কিন্তু তারা ফারসি না জানায় লেখক তখন বেশ গলা চড়িয়ে বলেন-
আফগানিস্তানের কোন্ অঞ্চল থেকে আসছ যে ফারসিতে কথা বলবার ক্ষমতা নেই?
পাঠানদের মধ্যে একজন সামান্য হলেও ফারসি জানে। সে লেখককে প্রশ্ন করে যে লেখক কী চান? তারা জানতে চান 'কুজা মী-রভী?'-অর্থাৎ লেখক কোথায় যাবেন? তদুত্তরে লেখক জানান-'দর শহর কলকত্তা বি-রভম'। অর্থাৎ তিনি কলকাতায় যাবেন। দলের ইশারাময় ইঙ্গিত পেয়ে ফারসি-বলিয়ে ছোকরাটি লেখককে ভিতরে আসার অনুমতি দেয়।
লেখক ভিতরে প্রবেশ করেই দেখেন সেই বিরাট 'বগি'র একটা পুরো বেঞ্চি তারা খালি করে রেখেছেন লেখকের জন্যে। রীতিমতো সমীহের ভাব ছিল লেখক সম্পর্কে। তারা ভেবেছেন, 'যেন এক মস্ত আলেম এসেছেন।'
৪. কথক কেন বলেছেন- 'যেন এক পশতু-সাহিত্য-গোষ্ঠী বা সম্মেলন লাগিয়ে দিলুম।'- সেই সাহিত্য সম্মেলনের বর্ণনা দাও।
উত্তর: বহুভাষাবিদ মনীষী অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচলতি' গল্পে গয়া থেকে কলকাতায় ফেরার পথে কাবুলিওয়ালাদের দখলে থাকা তৃতীয় শ্রেণির একটি কামরায় উঠে পড়েন লেখক। আফগানিস্তানের সরকারি ভাষা ফারসিতে তাঁর দখল থাকায় তিনি কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গী হয়ে ওঠেন। কিছুটা দূর যাওয়ার পর তিনি জানতে চান, 'তোমরা কেউ খুশ-হাল খাঁ খট্টকের গজল জানো?' খুশ-হাল খাঁ খট্টক হচ্ছেন সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময়ের বিখ্যাত একজন পশতু ভাষার কবি। লেখকের মুখে এই কবির নাম শুনে পাঠানরা ভীষণ উৎসাহিত হয়েছিল। তাদের একজন বলেছিল-
খুশ-হাল খাঁ খট্টকের গজল শুনবে? বাবু, দেখছি তুমি আমাদের সব খবর-ই জানো, আমি তোমাকে শোনাচ্ছি।
সে বেশ চড়া গলায় রীতিমতো খুশিতে গজল শোনাতে লাগল। লেখক অতি সহজ আর সরলভাবে মাঝেমধ্যে 'বহুত খুব, বাহবা বেশ; ধন্যবাদ' ইত্যাদি অভিবাদনসূচক প্রশস্তি করলে তারা অত্যন্ত খুশি হয়। লেখক তাদের কাছে বলেন আদম খান আর দুরখানির মহব্বতের কিস্সা কেউ জানে কিনা। তাতে পাঠানদের একজন খুব উৎসাহিত হয়ে জানায়-
এ তো দিল-ভাঙা কাহিনি। আমি তোমাকে শোনাচ্ছি।
এভাবে দেহরা-দুন এক্সপ্রেসের সেই থার্ড ক্লাস গাড়িখানিতে যেন এক পশতু-সাহিত্য-গোষ্ঠী বা সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন লেখক।
৫. 'পথচল্লি' রচনায় ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও যে সহজ বন্ধুত্ব ও উদার সমানুভূতির ছবিটি পাওয়া যায় তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করো। বর্তমান সময়ে এই বন্ধুত্ব ও সমানুভূতির প্রাসঙ্গিকতা বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: উত্তরের প্রথমাংশ: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'পথচলতি' গল্পে গয়া থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পথে আফগানিস্তানের কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে গভীর হৃদ্যতার যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা অপূর্ব সংলাপের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।
বহুভাষা ও সংস্কৃতি মধ্যে সমন্বয়ের ভাব থেকেই একটি জাতি অন্য জাতির সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে যুক্ত হয়। অত্যন্ত ভিড়াক্রান্ত ট্রেনের থার্ড ক্লাসের কামরায় উঠে লেখক কাবুলিওয়ালাদের মন জয় করে নেন। তিনি তাদের জাতীয় ভাষা ফারসিতে ভাব বিনিময় করলে তারা উপলব্ধি করে এই মানুষটি নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষিত, ভদ্র ও শিষ্ট সমাজের মানুষই হবেন। তাই প্রথমে তাকে কামরায় উঠতে নিষেধ করা হলেও পরে রীতিমতো একটি বেঞ্চ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। লেখক ফারসি, আরবি, উর্দু-প্রতিটি ভাষায় অসম্ভব দক্ষতার অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি খুশ-আল খাঁ খট্টকের গজল এবং আদম খান আর দুরখানির মহব্বতের কিস্সা প্রসঙ্গ অবতারণা করেন। এতে সহযাত্রী পাঠান অভিভূত হয়। তারা মনে করে তাদের মধ্যে 'যেন এক মস্ত আলেম এসেছে'। এভাবে 'পথচল্লি' রচনায় ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও সহজ বন্ধুত্ব ও উদার সমানুভূতির ছবিটি অসাধারণভাবে উঠে এসেছে।
উত্তরের দ্বিতীয়াংশ: বন্ধুত্ব ও সমান অনুভূতি মানুষকে ভৌগোলিক দূরত্ব ভুলিয়ে মানুষকে আপন করে নেয়। আমাদের এই ভারতবর্ষ শুধু নয়, সারা বিশ্বে রয়েছে বহু বিচিত্র মানুষের সমাবেশ। আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সংকীর্ণ মনোভাব ত্যাগ করে যদি আমরা প্রত্যেকের সঙ্গে মিশে যেতে পারি তাহলে প্রকৃত মনুষ্যত্বের পরিচয় প্রদান করা সম্ভব। ভাষা-ধর্ম-জাতি-সংস্কৃতিগত পার্থক্য থাকলেও শুধুমাত্র আন্তরিকতা, পারস্পরিক নির্ভরতার কারণে আমরা একে অন্যের আপনজন হয়ে উঠতে পারি। রবীন্দ্রনাথের গোরা যেমন শেষপর্যন্ত বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠেছিলেন, আমরাও সমমনোভাব ও সহানুভূতির মাধ্যমে প্রত্যেকে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠতে পারি।
৯. রেল ভ্রমণের সময় অচেনা মানুষের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি রম্যরচনা লেখো তোমার লেখাটির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছবি আঁকো।
উত্তর: জীবন বড়ো বিচিত্র। মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবন-সংস্কৃতিও বিচিত্র। মা-বাবার সঙ্গে শান্তিনিকেতন বসন্ত উৎসবে যাওয়ার সময় আমি ভুল করে অন্য একটি ট্রেনে উঠে বসি। মা-বাবা আমাকে দাঁড়াতে বলে খাবার কিনতে গেলে আমার আর দেরি সহ্য হয়নি। ভেবেছিলাম ট্রেনটি ছাড়তে দেরি আছে। কিন্তু হঠাৎই গাড়ি হর্ন বাজিয়ে দৌড়াতে শুরু করলে আমি বিপদে পড়ে যাই। অতি দ্রুত নামতে গিয়ে দেখি ট্রেন তখন আমার থেকে আরও দ্রুত দৌড়ে চলেছে। আমি নামতে গেলে এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোক আমাকে বাধা দেন। আমি কেঁদে ফেলি। দূর থেকে আমার বাবা-মাকে আমি দেখতে পেয়ে চিৎকার করি। তারা আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে আসেন। ততক্ষণে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর পরিবার-পরিজন ছিল। তাঁরা বাড়ি ফিরছিলেন। পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের নাম অমৃক সিং অরোরা। তিনি ভালো বাংলা বলতে পারেন। আমার কাছে সমস্ত বিবরণ শুনে তিনি আমাকে সাহস দিয়ে বললেন, 'কোনো চিন্তা করো না। আমি তোমাকে পৌঁছে দেব তোমার বাবা-মায়ের কাছে।' তিনি আমার বাবা-মাকে ফোন করে বললেন তারা যেন কোনো চিন্তা না করেন। তিনি কলকাতাতেই চাকরি করেন। সুতরাং ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং বাবা-মা যেন শান্তিনিকেতনে তাঁদের নির্দিষ্ট হোটেলে গিয়ে ছেলের জন্যে অপেক্ষা করেন।
সেদিন রাতে নিজের সন্তানের মতো আমাকে আদর-যত্ন করেছিলেন। পরের দিন ভোরে আমাকে নিয়ে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের পত্নী আমার ব্যাগে দিয়েছিলেন নানারকম খাবার, জলের বোতল এবং একটি কাজুর প্যাকেট। আমার বাবা-মা'র হাতে আমাকে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, 'আপনার ছেলেটি বেশ ভালো। ও চমৎকার গান করে।' আমার মায়ের চোখে তখন জল। তিনি বললেন, 'আপনি এত ভালো হলেন কী করে?' এখনও রেলভ্রমণের সময় সেই অচেনা মানুষটির কথা আমার মনে পড়ে।
উত্তর পেতে সদস্যপদ প্রয়োজন