Chapter -20
পাড়াগাঁর
দু-পহর ভালোবাসি
------------------------------------
Short
Question Answer
1.জীবনানন্দ দাশের লেখা দুটি কবিতার বইয়ের নাম লেখো।
উত্তর: কবি জীবনানন্দ দাশ প্রণীত দুটি কাব্যগ্রন্থ হল-
১.ধূসর পাণ্ডুলিপি : ১৯২৭
২.বনলতা সেন : ১৯৪২
2.তাঁর লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম কী?
উত্তর: জীবনানন্দ দাশের লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম-'ঝরাপালক'। এর প্রকাশকাল ১৯২৭।
উত্তর: 'দু-পহর' শব্দটির অর্থ হল 'দুপুরবেলা'। 'দ্বিপ্রহর' শব্দ থেকে 'দু-পহর' কথাটি এসেছে।
4.'কেবল প্রান্তর জানে তাহা'-'প্রান্তর' কী জানে?
উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় কবির মনে কোন্ গল্প, কাহিনি, স্বপ্ন ঘর বেঁধেছে তা অন্য কেউ না জানলেও কেবল প্রান্তরই তার খবর রাখে।
5.'তাহাদের কাছে যেন এ জনমে নয়- যেন ঢের যুগ ধরে কথা শিখিয়াছে এ হৃদয়'- কাদের কথা এখানে বলা হয়েছে?
উত্তর: আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় 'তাহাদের' বলতে বিস্তৃত প্রান্তর এবং সেই প্রান্তরে উড়ে বেড়ানো শঙ্খচিলের কথা বলা হয়েছে।
6.'জলসিড়িটির পাশে ঘাসে…'-কী দেখা যায়?
উত্তর: আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় জলসিড়ির পাশে বুনো চালতার নুইয়ে পড়া শাখাগুলি দেখা যায়, নদীর জলে তাদের প্রতিবিম্ব পড়ে।
7.'জলে তার মুখখানা দেখা যায়…'- জলে কার মুখ দেখা যায়?
উত্তর: একালের অন্যতম আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় বুনো চালতা গাছের ডালের যে ছায়া নদীর জলের এসে পড়েছে, তারই মুখের কথা বলা হয়েছে।
8.'ডিঙিও ভাসিছে কার জলে…'- ডিঙিটি কেমন?
উত্তর: কবি-পুরোহিত জীবনানন্দ দাশের 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় জলের ভাসমান যে ডিঙিটির কথা বলা হয়েছে সেটি 'ঝাঁঝরা-ফোঁপরা', অর্থাৎ একেবারেই ভাঙাচোরা ডিঙি।
9.ডিঙিটি কোথায় বাঁধা রয়েছে?
উত্তর: বিশ শতকের তিনের দশকের কবি জীবনানন্দ দাশের 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় ডিঙিটি জলসিড়ি নদীটির পাড়ে হিজল গাছে বাঁধা রয়েছে।
Long Question Answer
1.পাড়াগাঁয়ের দ্বিপ্রহরকে কবি ভালোবাসেন কেন?
উত্তর: রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় কবির গভীর প্রকৃতিপ্রেম ছবির মতো উঠে এসেছে। পল্লিগ্রামের নির্জন দুপুরবেলা অদ্ভুত এক স্বপ্নময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে কবির মনে। গ্রামের চিরপরিচিত প্রান্তর এবং সেই প্রান্তরের উপর দিয়ে উড়তে থাকা শঙ্খচিল একমাত্র জানে কবির মনে কোন্ স্বপ্ন বাসা বেঁধে আছে।
গ্রামবাংলার অতি তুচ্ছ 'শুল্ক পাতা', 'শালিকের স্বর', 'ভাঙা মাঠ', 'নক্শাপেড়ে শাড়িখানা' গায়ে জড়ানো একটি মেয়ের রৌদ্রের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় বিমুগ্ধ নয়নে দেখেছেন কবি।
জলসিড়ি নদীটির পাশে নুইয়ে থাকা বুনো চালতার ডাল কবির মনে অন্য আরেক ভাবলোকের জন্ম দিয়েছে। 'হিজল গাছে-বাঁধা এই বিবর্ণ, জীর্ণ ডিঙিটি মালিকহীন। ভাঙাচোরা ডিঙিটির মালিক হয়তো কোনো তার কাছে ফিরে আসবে না। এই না আসার বোধ থেকে কম্পি মনে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা জায়গা করে নিয়েছে। ডিঙিটি যেমন একাধী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে, আমরাও তেমন প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই কবি লেখেন-
2.'স্বপ্নে যে-বেদনা আছে'- কবির স্বপ্নে কেন বেদনার অনুভূতি?
উত্তর: বিশ শতকের তিনের দশকের কবি জীবনানন্দ দাশ প্রণীত 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা কবিতার শেষে দেখা যায়। এই কবিতায় কবি পাড়াগাঁয়ের প্রান্তর, সেখানে উড়ন্ত শঙ্খচিল, শুকনো পাতা ঝরে পড়া, শালিকের আলাপন ইত্যাদি প্রসঙ্গকে এনে পল্লিজীবনের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরেছেন।
দুপুরের রৌদ্রে নাপাড়ের অসাধারণ একটি শাড়ি পরে বাংলার এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে হলুদ পাতার মতো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। জলসিড়ি নদীটির পাশে ঘাসের উপর অসংখ্য শাখা নিয়ে নুইয়ে থাকে বুনো চালতার গাছটি। পুরোনো ভাঙা-চোরা মালিকহীন একটি ডিঙি নদীর জলে ভাসতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে হিজল গাছে বাঁধা এই ডিঙিটির মালিক ফিরে আসে না। কবি লেখেন-
3.প্রকৃতির কেমন ছবি কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে তা আলোচনা করো।
উত্তর: জীবনানন্দের কবিতা প্রকৃতির বর্ণময় কারুকার্যে ছবির মতো উঠে আসে। 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার মধ্যে প্রকৃতির অন্তরঙ্গ আলাপন ধরা পড়ে। অসংখ্য গাছ-গাছালি, নদী-প্রান্তর, পাখ-পাখালি কবির একাধিক কবিতায় দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' নামাঙ্কিত কবিতায় নিস্তব্ধ দুপুরের বর্ণনা প্রসঙ্গেঙ্গ এসেছে রোদে ক্লান্ত শালিকের স্বর, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, হলুদ পাতার মতো সরে যাওয়া একটি মেয়ের ছবি। জীবনানন্দের একাধিক কবিতায় শঙ্খচিল ও ধানসিড়ি নদীর কথা এসেছে। কবির মনের কথা শুধুমাত্র 'প্রান্তর জানে', আর জানে 'ঐ প্রান্তরের শঙ্খচিল'।
কবি দেখেন হিজল গাছে বাঁধা পড়ে রয়েছে বিবর্ণ-ভাঙাচোরা একটি ডিঙি। বহুদিন ধরে তার মালিক তার কোনো সংবাদ রাখে না। কবির নিঃসঙ্গ মনের সঙ্গে কোথাও যেন মিল রয়েছে নির্জনে পড়ে থাকা ডিঙিটির। এই কবিতায় শঙ্খচিল, নক্কাপেড়ে শাড়ি, বুনো চালতার নুইয়ে পড়া, জলসিড়ি নদী ইত্যাদি প্রসঙ্গ নির্জন গ্রামবাংলার অপূর্ব শ্রী ও সৌন্দর্যকে রূপায়িত করেছে।
4.'কেঁদে কেঁদে ভাসিতেছে আকাশের তলে'- কবির এমন মনে হওয়ার কারণ কী বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর: আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় নির্জন দুপুরের বর্ণনার পাশাপাশি গ্রামবাংলার অপূর্ব শোভার বর্ণনা করা হয়েছে। কবিতার শুরু হয়েছে 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে। কবি প্রথমেই জানিয়ে নিয়েছেন তাঁর হৃদয়ে যে স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে তাঁর খবর শুধু রাখে প্রান্তর আর প্রান্তরের শঙ্খচিল। এই কথাগুলি বলবার পর কবি হিজল গাছে বাঁধা এবং নদীর জলে ভেসে থাকা মালিকহীন একটি জীর্ণ-বিবর্ণ ভাঙাচোরা ডিঙির কথা তুলে ধরেন।
কবি খেয়াল করেন এই ডিঙির কোনো মালিক নেই। তাঁর মনে হয়েছে সে মালিক 'কোনোদিনই এইদিকে আসিবে না আর'। আর এভাবেই পড়ে থাকবে ভাঙাচোরা ডিঙিটা। কবির মনের একাকিত্ব আর নির্জনে পড়ে থাকা ডিঙিটি যেন কোথাও এক হয়ে ওঠে। জরাজীর্ণ ডিঙিটির এভাবে অনাদরে নির্জন নদীর কূলে পড়ে থাকার কারণে কবির মনে হয়েছে ডিঙিটি যেন 'কেঁদে-কেঁদে ভাসিতেছে আকাশের তলে'।
5.পাড়াগাঁর দু-প্রহর ভালোবাসি… শীর্ষক কবিতাটি 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থের কত সংখ্যক কবিতা? 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় কবি জীবনানন্দের কবি-মানসিকতার পরিচয় কীভাবে ধরা দিয়েছে, তা বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: উত্তরের প্রথমাংশ: রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতাটি 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থের পঁচিশ সংখ্যক কবিতা।
উত্তরের দ্বিতীয়াংশ: জীবনানন্দ সম্পর্কে যদি এককথায় কিছু বলার থাকে তাহলে বলতে হয়-তিনি প্রকৃতির কবি, প্রকৃত কবি। তাঁর একাধিক কবিতায় রূপসী বাংলার অপূর্ব লাবণ্যময় রূপ আলোক-উদ্ভাসিত হয়েছে। আলোচ্য এই কবিতায় বাংলার অপরূপ রূপের বর্ণনার প্রসঙ্গে কবি একটির পর একটি চিত্রকল্প তুলে ধরেছেন। যেমন-
২.শুষ্ক পাতার ঝরে পড়া
৩.শালিকের স্বর
৪.ভাঙা মাঠ
৫.নক্শাপেড়ে শাড়ি
৬.বুনো চালতার নুয়ে পড়া ডাল
৭.জলসিড়ি নদীর চিত্র
৮.জলে ভাসমান ভাঙাচোরা একটি ডিঙি
এইসব খণ্ডচিত্রগুলি একত্রিত হয়ে রূপসী বাংলার এক রূপময় চিত্র তৈরি করে। নির্জন, নিস্তব্ধ দুপুর কবির মনে অদ্ভুত এক একাকিত্ব নিয়ে হাজির হয়। প্রকৃতির বুকে এক বিষণ্ণতা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিন্নপত্রাবলীর বিভিন্ন পত্রে বিষন্ন প্রকৃতির কথা তুলে ধরেছেন; কবি জীবনানন্দ দাশ অনুরূপ এক বেদনাবোধের পরিচয় দিয়েছেন এই কবিতার শেষাংশে।
6.কবিতাটির গঠন-প্রকৌশল আলোচনা করো।
উত্তর: ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক-কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতিটি কবিতা নানা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। আমাদের আলোচ্য 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' নামাঙ্কিত কবিতাটি গঠন প্রকৌশলে অসামান্য একটি সনেটের মর্যাদা লাভ করেছে।
সনেটধর্মী কবিতায় থাকে ১৪টি পঙ্ক্তি। তাই একে চতুর্দশপদী কবিতাও বলা যায়। পাঠ্য কবিতাটির প্রথম আটটি পঙ্ক্তিতে রয়েছে। একটি ভাব। সেই ভাবেরই প্রসারণ ঘটেছে শেষের ছয়টি পঙ্ক্তিতে। অর্থাৎ প্রথম স্তবকে রয়েছে অষ্টক বা আটটি পঙ্ক্তি এবং দ্বিতীয় স্তবকে রয়েছে ষটক বা ছটি পঙ্ক্তি। মিলের বিন্যাস এমন-
১.প্রথম স্তবকের আটটি পঙ্ক্তি এমন ক, খ, খ, ক, ক, খ, খ, ক।
মিশ্রকলাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত এই কবিতায় মাত্রাবিন্যাস পদ্ধতি হল ৮/৮/৬। এর ফলে এই কবিতার লয় ধীর। কবিতার শব্দ নির্মাণেও রয়েছে যথেষ্ট বৈচিত্র্য। যেমন-
১. দেশজ শব্দ: ডিঙি, নুয়ে আছে।
২. তৎসম শব্দ: রৌদ্র, হৃদয়, শুষ্ক।
৩. চলিত গদ্যধর্মী শব্দ: দু-পহর, নক্শাপেড়ে।
কবি জীবনানন্দ দাশ এমন অসাধারণ চিত্রকল্প বা Image এই কবিতার মধ্যে তুলে ধরেছেন যা অতুলনীয়। কবি আলোচ্য কবিতার শেষাংশে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা ফুটিয়ে তুলেছেন। সব মিলিয়ে কবিতাটির গঠন প্রকৌশল একেবারে স্বতন্ত্র।
7.'রৌদ্রে যেন ভিজে বেদনার গন্ধ লেগে আছে'- কবিতায় কীভাবে এই অপরূপ বিষণ্ণতার স্পর্শ এসে লেগেছে, তা যথাযথ পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে আলোচনা করো।
উত্তর: রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের 'পাড়াগাঁর দু-পহর ভালোবাসি' কবিতায় কবির প্রকৃতি প্রেমের অপূর্ব ভালোবাসা ব্যক্ত হয়েছে। পল্লিগ্রামের নির্জন দ্বিপ্রহর দেখে বিমুগ্ধ কবি প্রথমেই বিবৃতির সুরে জানিয়েছেন-
প্রত্যেকের হৃদয়েই স্বপ্ন থাকে। কবি অবশ্য জানিয়ে দেন, 'স্বপ্নে যে-বেদনা আছে' সেই বেদনার প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে শুষ্ক পাতায়, শালিকের স্বরে, ভাঙা মঠে। বুনো চালতার শাখা নুয়ে পড়ে নদীর জলের কাছে। কবি তাই জানান, 'জলে তার মুখখানা দেখা যায়'।
কবিতার শেষাংশে এসে কবি একটি ভাঙাচোরা ডিঙির পরিচয় দেন। সেই ডিঙির কোনো মালিক নেই। একাকী নির্জন নদীর কূলে দাঁড়িয়ে থাকা ডিঙিটির কাছে হয়তো কোনোদিন তাঁর মালিক ফিরে আসবে না। তাই 'ডিঙিটিরে বেঁধে রেখে গিয়েছে হিজলে।' কবির মনে হয়েছে, 'রৌদ্রে যেন ভিজে বেদনার গন্ধ লেগে আছে'। তাই কোথাও যেন 'কেঁদে-কেঁদে ভাসিতেছে আকাশের তলে'। কবিতার শেষে এভাবে এক বিষণ্ণতা ধরা দেয়।