Chapter - 1                                           


 অতীত স্মরণ

----------------------


MCQs


1 . রাজতরঙ্গিনী রচনা করেন-


(a)কৌটিল্য


(b) কলহন


(c) বিলহন


(d) কালিদাস


উত্তর : (b) কলহন


2. নারায়ণ সান্যালের লেখা স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থটি হল-


(a) 'একাত্তরের ডাইরি'


(b) 'আমি নেতাজিকে দেখেছি'


(c) 'আমি গান্ধিজিকে দেখেছি'


(d) 'আমি ভারত মাকে দেখেছি'


উত্তর: (b) 'আমি নেতাজিকে দেখেছি'


3. 'হারকিউলিস', এই কিংবদন্তি চরিত্রটি হল-


(a) ভারতের


(b) রোমের


(c) গ্রিসের


(d) পারস্যের


উত্তর: (c) গ্রিসের


4. 'ওরাল হিস্ট্রি সোসাইটি' (১৯৭৩ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন-


(a) ব্রিটিশ মৌখিক ইতিহাসবিদগণ


(b) জাপানের মৌখিক ইতিহাসবিদগণ


(c)  রাশিয়ার মৌখিক ইতিহাসবিদগণ


(d) আমেরিকার মৌখিক ইতিহাসবিদগণ


উত্তর:


5. মৌখিক ঐতিহ্যের একটি নিদর্শন হল-


(a)  পুরাণ


(b) উপনিষদ


(c) বাইবেল


(d) বেদ


উত্তর: (d) বেদ


6. 'একাত্তরের ডায়েরি' নামক স্মৃতিকথার রচয়িতা-


(a) সুফিয়া কামাল


(b) নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়


(c) নারায়ণ সান্যাল


(d) দক্ষিণারঞ্জন বসু


উত্তর:  (a) সুফিয়া কামাল


7. 'আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের কাহিনি' কীসের উদাহরণ?


(a) স্মৃতিকথা


(b) পৌরাণিক কাহিনি


(c) কিংবদন্তি


(d) লোককথা


উত্তর:   (d) লোককথা


8. কিংবদন্তির একটি বৈশিষ্ট্য হল-


(a)  বাস্তবধর্মী


(b) অতিরঞ্জন


(c) ধর্মকেন্দ্রিক


(d) রাজনৈতিক ঘটনাকেন্দ্রিক


উত্তর:  (b) অতিরঞ্জন


9. 'ইতিহাসমালা' রচনা করেন-


(a) নারায়ণ সান্যাল


(b) উইলিয়াম কেরি


(c) জেমস মিল


(d)  ভিনসেন্ট স্মিথ


উত্তর: (b) উইলিয়াম কেরি


10. 'মিউজিয়াম' (Museum) শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ----------------  থেকে।


a) Mouseion


b) Musion


c) Mousin


d) Mosem


উত্তর: A 


11. হিস্ট্রিজ অব দ্য পার্সিয়ান ওয়ারস' গ্রন্থটির লেখক হলেন- হেরোডোটাস


a) হেরোডোটাস


b) ইবন খালদুন


c) ই এইচ কার


d) থুকিডিডিস


উত্তর: a) হেরোডোটাস


12. "ঐতিহাসিকের কাজ হল অতীত ঘটনাবলিকে পরিবর্তিত না করে উপস্থাপিত করা" উক্তিটির প্রবক্তা-


a) কার


b) র‍্যাঙ্কে


c) কোচে


d) বিউরি


উত্তর: b) র‍্যাঙ্কে


13. গ্রিক পুরাণের 'শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক মিউজদের মন্দির', এটির অর্থ হল-


a) Miuseion শব্দের


b) Mouseion শব্দের


c) Mauseion শব্দের


d) Meuseion শব্দের


উত্তর: d) Meuseion শব্দের


14. মিউজিয়াম সংক্রান্ত বিদ্যাকে বলা হয়-


a) জুলজি


b) মিউজিওলজি


c) মিউজিকোলজি


d) কোনোটিই নয়


উত্তর: b) মিউজিওলজি


15. পুরাণ রচিত হয়-------------- যুগে।


a) মৌর্য


b) গুপ্ত


c) পাল


d) সেন


উত্তর: b) গুপ্ত


16. হলেন 'ঠাকুমার ঝুলি' গ্রন্থের রচয়িতা।


a) দক্ষিণারঞ্জন বসু


b) রামরাম বসু


c) দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার


d) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উত্তর: c) দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

17. বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনিগুলির মধ্যে অন্যতম একটি ঘটনা হল--------------


a)  বিশ্বব্যাপী বন্যা


b) ভূমিকম্প


c) মহামারি


d)  দেবতাদের যুদ্ধ


উত্তর:  a)  বিশ্বব্যাপী বন্যা


1৪. শিন্টোবাদের প্রচলন ছিল--------------


a) চিনে


b) জাপানে


c) ভারতে


d) নরওয়েতে

উত্তর: b) জাপানে

19. Legend শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ -------------  থেকে।


a) Legendary


b) Legends


c) Legenda


d) Legende


উত্তর: c) Legenda




Short Answer Question


1. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের তিন শিক্ষকের লেখা তিনটি পুরাণকল্প ও আধুনিক ইতিহাস চর্চার সংমিশ্রণে রচিত তিনটি গ্রন্থের নাম লেখো।


উত্তর : পুরাণকল্প ও আধুনিক ইতিহাস চর্চার সংমিশ্রণে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের তিন শিক্ষক কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-রামরাম বসুর 'রাজ প্রতাপাদিত্য চরিত্র', রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের 'মহারাজ কৃয়চন্দ্র রহস্যচরিত্রম', এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের 'রাজাবলি' গ্রন্থ।


2. ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে ইউরোপীয়দের মধ্যে কয়টি মত প্রচলিত ও কী কী?


উত্তর : ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে ইউরোপীয়দের মধ্যে দুইটি মত প্রচলিত। এই দুইটি মত হল- প্রাচ্যবাদ (orientalism) এবং হিতবাদ (utilitarianism)।


3. লোককথায় 'সমাজের সূত্র' বলতে কী বোঝ?


উত্তর : লোককথায় অনেক সময় ঘটনাগুলির মধ্যে অসংখ্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকি অনেক সময় পার্শ্ব চরিত্রের নামকরণের ক্ষেত্রেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়।


4. ইংরেজি ভাষায় লেখা বিশ্বের প্রথম লোককথার গল্পটির নাম লেখো।


উত্তর : ইংরেজি ভাষায় লেখা বিশ্বের প্রথম লোককথার গল্পটির নাম হল রিচার্ড জনসনের 'দ্য স্টোরি অফ টম থাম্ব'।


5. ফোক লেজেন্ড ও ফোক টেল কথা দুটির পার্থক্য লেখো।


উত্তর : ফোক লেজেন্ডের কাহিনি ফোক টেলের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তবধর্মী হয়। ফোক লেজেন্ডের চরিত্রগুলি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হওয়ায় সাহিত্যের ইতিহাসে ফোক লেজেন্ডের ঐতিহাসিক মূল্য ফোক টেলের তুলনায় অনেক বেশি।


6. কোথায় পৃথিবীর প্রাচীনতম জাদুঘর গড়ে উঠেছিল?


উত্তর :পৃথিবীর প্রাচীনতম জাদুঘর এননিগালডি-নান্নার এখনকার ইরাকে গড়ে উঠেছিল (আনুমানিক ৫৩০ খ্রি.পূ.)।


7. পৃথিবীর প্রথম আধুনিক জাদুঘর বলা হয় কোন যাদুঘরকে?


উত্তর :ইলিয়াস অ্যাশমোল-এর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা দ্য অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ামকে পৃথিবীর প্রথম আধুনিক জাদুঘর বলা হয়।


8. পৃথিবীর প্রাচীনতম মিউজিয়ামটির নাম কী এবং এটি কোন্ সময়কালে গড়ে ওঠে?


উত্তর : পৃথিবীর প্রাচীনতম মিউজিয়ামটির নাম হল মেসোপটেমিয়ার এননিগালডি-নান্নার সংগ্রহশালা।


9. কবে, কোথায় ব্রিটিশ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়?


উত্তর : ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে ব্রিটিশ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়।


30. শিল্পবিপ্লবের সময়কালে ইউরোপে কোন্ দুই বিখ্যাত মিউজিয়াম তৈরি হয়?


উত্তর : শিল্পবিপ্লবের সময়কালে ১৭৫৯ খ্রি. লন্ডনে তৈরি হয় দ্য ব্রিটিশ মিউজিয়াম (১৭৫৯ খ্রি.)। এ ছাড়াও শিল্পবিপ্লবকালে ফ্রান্সের প্যারিসে তৈরি হয়েছিল ল্যুভর মিউজিয়াম (১৭৯৩ খ্রি.)।


31. ইতিহাস রচনায় পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের কয়টি স্তর ও কী কী?


উত্তর : ইতিহাস রচনায় পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের চারটি স্তর। এগুলি হল- [1] হিউরিসটিক (Heuristic) বা বাহ্যিক সমালোচনার স্তর, [ii] হারমিনিউটিকস (Hermeneutics) বা অভ্যন্তরীণ সমালোচনার স্তর, [iii] সিনথেসিস (Synthesis) বা সমন্বয়সাধনের স্তর এবং [iv] এক্সপোজিশন (Exposition) বা বর্ণনাগত স্তর।


32. 'What is History' বইটি কার লেখা? 


উত্তর : 'What is History' বইটি ই এইচ কারের লেখা।


33. আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি বা চর্চার বিভিন্ন ভাগগুলি কী কী?


উত্তর: আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি বা চর্চার বিভিন্ন ভাগগুলি হল-সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদী, কেমব্রিজ গোষ্ঠী, মার্কসবাদী এবং নিম্নবর্গীয় (সাবলটার্ন) প্রভৃতি। 


34. আধুনিক ইতিহাস চর্চার জনক কাকে কেন বলা হয়?


উত্তর: আরবীয় ঐতিহাসিক ইবন খালদুনকে আধুনিক ইতিহাস চর্চার জনক বলা হয়। কারণ তিন্নি প্রথম বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ইতিহাস রচনার সূচনা করেন এবং ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি তুলে ধরেন।


35. কে কোন্ শতককে ইতিহাসের শতক বলে উল্লেখ করেছেন?


উত্তর: ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জর্জ পেবডি পুচ উনিশ শতককে ইতিহাসের শতক বলে উল্লো করেছেন।


36. Folklore বা Folk tales ইতিহাস রচনায় কীভাবে সাহায্য করে?


উত্তর: Folklore বা Folk tales-এর বিভিন্ন শাখা যেমন-লোকসাহিত্য, লোক শিল্পকলা, লোকসংগীত ইত্যাদি ইতিহাসের নানা উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি এগুলি সমাজের নানা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন প্রথা ও রীতিনীতির সম্পর্কে ধারণা জুগিয়ে ইতিহাস রচনায় সাহায্য করে।


37. স্মৃতিকথা কাকে বলে?


উত্তর: যে অ-উপন্যাসধর্মী সাহিত্যে লেখক তাঁর অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার ।। স্মৃতিচারণ করে থাকেন, তাকে স্মৃতিকথা বলা হয়।


38. কোন্ প্রেক্ষাপটে ইংরেজরা ভারত ইতিহাস চর্চা শুরু করেন?


উত্তর:  ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় সমাজব্যবস্থা ও ভারতবাসীর জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা ইংরেজদের কাছে জরুরি হয়ে ওঠে। পাশাপাশি ইংরেজ শক্তি শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর উন্নততর শাসন, আইন ও ভূমিবন্দোবস্ত প্রবর্তনের লক্ষ্যেও ভারত ইতিহাস চর্চা শুরু করেন।


39. মৌখিক ঐতিহ্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য লেখো।


উত্তর: মৌখিক ঐতিহ্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সাক্ষাৎকার অর্থাৎ কোনো কাহিনি বা ঘটনার একটি চরিত্রের সঙ্গে অন্য চরিত্রের সাক্ষাতের ফলশ্রুতি এক্ষেত্রে মৌখিকভাবে বর্ণিত হয়।


40. গীতিকা কী?


উত্তর: ইংরেজি 'ব্যালাড'-এর বাংলা প্রতিশব্দ হল গাথা বা গীতিকা। সুর করে নাটকীয় ভঙ্গিতে গাওয়া গল্পগুলি হল গীতিকা।


41. মৌখিক ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ কেন?


উত্তর: মৌখিক ইতিহাস অতীতের নানাধরনের গল্প বা কাহিনি জানতে সাহায্য করে এবং অতীতের বহু বিষয় ও তথ্যের জানান দেয়।


42. পরিকথার সংজ্ঞা দাও।


উত্তর: যে সমস্ত লোককথাগুলি পরিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় সেগুলি হল পরিকথা। পরিকথায় কোনো পরি কাহিনিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বা মুখ্য ভূমিকা পালন করে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।


43. পশুকথা কাকে বলে?


উত্তর: পশুকে নিয়ে কল্পিত গল্পকে পশুকথা বলে। পশুকথায় পশু পাখিদের চারিত্রিক গুণাবলি তুলে ধরা হয়।


45.  আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লেখো।


উত্তর: আধুনিক ইতিহাসতত্ত্বের কয়েকটি বৈশিষ্ট হল-জাতীয়তাবাদ, যুক্তিবাদ, প্রগতির ধারণা, দুষ্টবাদ, অবয়ববাদ ও উত্তর অবয়ববাদ, আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা, আপেক্ষিকতাবাদ, বিজ্ঞানধর্মিতা ও নৈতিকতাবাদ ইত্যাদি।


46. কিংবদন্তি বা লেজেন্ড কী?


উত্তর: ইতিহাস ও কল্পনার মিশ্রণে লৌকিক কথাসাহিত্যের রূপবিশিষ্ট লোককাহিনি হল কিংবদন্তি।


47. কয়েকটি কিংবদন্তি চরিত্রের উল্লেখ করো।


উত্তর: কয়েকটি কিংবদন্তি চরিত্র হল-ভারত ইতিহাসের পৌরাণিক ইন্দ্র চরিত্র, কৃষ্ণ চরিত্র, রাম চরিত্র এবং ইংল্যান্ডের ইতিহাসে রবিন হুড চরিত্র ইত্যাদি।


48. 'Legend' কথাটি কোথা থেকে এসেছে এবং এর অর্থ কী?


উত্তর: Legend' শব্দটি ল্যাটিন শব্দ 'Legenda' থেকে এসেছে। এর অর্থ হল পাঠের বিষয়বস্তু।


49. মৌখিক ঐতিহ্য বলতে কী বোঝ?


উত্তর: মৌখিক ঐতিহ্য হল এমন এক সংস্কৃতিগত ধারণা যা এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মে লোকমুখে প্রচারিত হয়। বিভিন্ন দিক থেকে মৌখিক ঐতিহ্যের সংজ্ঞা দেওয়া যায়- ওরাল হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন-এর মতে, "অতীতের ঘটনা সম্পর্কে মানুষের কণ্ঠস্বর, স্মৃতিকথা, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বিশ্লেষণ এবং চর্চা করাকেই মৌখিক ঐতিহ্য বলে"।


50. 'History' শব্দটি কোথা থে কী?


উত্তর:  এ 'History' শব্দটি 'Historia' নামক একটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ হল অনুসন্ধান বা তদন্ত।


51. জনশ্রুতি কী?


উত্তর: যখন কোনো ঐতিহাসিক বিবরণের তথ্য ও সন-তারিখের যথার্থতার প্রমাণের অভাব থাকে এবং যে অতীত কাহিনিগুলি বংশপরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছোয়, তাকে জনশ্রুতি বলে।



Long Answer Question


1. আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লেখো। অথবা, আধুনিক ইতিহাস রচনার উপাদানগুলির সংক্ষিপ্ত আে বিবরণ দাও। অথবা, আধুনিক ইতিহাস রচনার মূল বিষয়গুলি কী কী তা পর্যালোচনা করো।


 

উত্তর: আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ-:


1.  জাতীয়তাবাদ: বিশ্বের প্রতিটি দেশেই ঐতিহাসিকদের লেখায় জাতীয়তাবাদের ছাপ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। বিভিন্ন দেশের ইতিহাসগুলিতে নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্য ও শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসিবিপ্লব, রুশ বিপ্লব বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্রে বি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায়। এই জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতিহাসবিদ গোবিনোর জোসেফ আর্য জাতির, চার্লস কিংসলি বি টিউটনিক জাতির, মরিসবার গল জাতির, আর. কিপলিং স্যাক্সন জাতির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন। ভারতীয় ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত তিনখণ্ডে লেখেন 'প্রাচীন ভারতের সভ্যতার ইতিহাস', যা হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।


2.  যুক্তিবাদ: আধুনিক ইতিহাস তত্ত্বের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যুক্তিবাদ। আধুনিকতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের স্থলে আসে যুক্তিবাদ। মানুষ বুঝতে শেখে কোনো কিছু বিশ্বাস করার আগে তাকে যুক্তিবাদের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়া উচিত। মানুষের এই যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে ঐতিহাসিকগণও যুক্তিভিত্তিক ইতিহাস রচনায় প্রয়াসী হন। যুক্তিবাদী ঐতিহাসিকগণ স্থান-কাল-চরিত্র-নির্বিশেষে যুক্তিবাদের আলোকে তথ্যসূত্রগুলি বিচার করে সেগুলি ইতিহাসে প্রয়োগ করে থাকেন।


3.  প্রগতির ধারণা: ইতিহাসে ঘটনা ও মূল্যবোধ উভয়ের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রগতির উদ্ভব ঘটে। ইতিহাসে প্রগতির আসল অর্থ হল মানুষের ক্ষমতা ও সম্ভাবনার বিপুল বিস্তার। উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের ধনসম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসে প্রগতির ধারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক গিবন ইতিহাসে প্রগতির ধারণা ব্যাখ্যায় বলেন প্রতিটি যুগেই মানুষের সম্পদ, শক্তি, জ্ঞান বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিহাসে প্রগতির ধারণায় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একই শৃঙ্খলে আবদ্ধ।


4.  দুষ্টবাদ: রোমান্টিক ভাবধারার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভব ঘটে দৃষ্টবাদী ইতিহাস দর্শনের। রোমান্টিক পর্বে ইতিহাসে যে সমস্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, সেগুলি যথেষ্ট তথ্যনির্ভর ছিল না। দৃষ্টবাদী দর্শনের প্রবক্তা অগাস্ট কোঁৎ সমাজের বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক নিয়ম-রীতি প্রয়োগের কথা নে। দৃষ্টবাদী পদ্ধতি মেনে ঐতিহাসিককে দুটি কাজ করতে হয়, যথা- অসিক তথ্য আবিষ্কার ও ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রের দ্বারা ঘটনার ব্যাখ্যা একদের লেখায় ইতিহাসগুলিতে লক্ষ করা যায়। ইউরোপীয় রাষ্ট্রে চেতনায় উদ্বুদ্ধ চার্লস কিংসলি স্যাক্সন জাতির তিনখণ্ডে লেখেন জাতীয়তাবাদী ন বৈশিষ্ট্য হল অনে কুসংস্কার ও প্রখে কোনো কিছু াই করে নেওয়া কাজে লাগিয়ে হন। যুক্তিবাদী দের আলোকেকেন। দান। দৃষ্টবাদী দর্শন দ্বারা ঐতিহাসিক ছোটো ছোটো বিষয়কেন্দ্রিক সমালোচনামূলক ইতিহাস রচনা করে থাকেন।


5. অবয়ববাদ ও উত্তর অবয়ববাদ: বিশ্বসভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, ধর্মনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ভাবনাচিন্তাগুলিই ধীরে ধীরে অবয়বের রূপ নিয়েছে। অবয়ববাদ হল আসলে প্রথাগত ও আচারগত ঐতিহ্যের ওপর নির্ভরশীল মানব ইতিহাস। ঐতিহাসিক ধারণায় অবয়বের পরিবর্তন ঘটলে বিষয়বস্তুরও পরিবর্তন ঘটে। অবয়ববাদী সমর্থকরা মনে করেন ইতিহাসে সত্যকে সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যায় না, পূর্ণ সত্য সদা অধরা থাকে। বিশ্বজনীনতা, ঐক্য, মুক্তি প্রভৃতির ভিত্তিতে উত্তর-অবয়ববাদীরা নিজেদের তত্ত্ব গড়ে তোলেন।


6.  আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা: আধুনিকতা শব্দটি আসলে আপেক্ষিক, কেন-না প্রতিটি প্রজন্মের কাছেই নিজের যুগটি আধুনিক বলে মনে হয়। রেনেসাঁস যুগের মানুষেরা নিজ যুগকে আধুনিক আখ্যা দিয়েছিল আবার আজকের যুগকে আমরা আধুনিক যুগ আখ্যা দিই। প্রকৃত অর্থে সব দেশে, সব যুগে আধুনিকতার চরিত্র ও মানদণ্ড আলাদা আলাদা হয়। এই বিচারে ঐতিহাসিককে তার আধুনিকতার স্বরূপ বর্ণনা করতে হয়। আধুনিকতার বিচারে ঐতিহাসিক যাকে সত্য বলে ধরে নেন উত্তর আধুনিকতায় তা আংশিক সত্য বা অতিকথা হিসেবে বিবেচিত হয়। 


7.  আপেক্ষিকতাবাদ: ইতিহাসের তথ্যসূত্রগুলি কখনোই চিরসত্য নয়, নতুন যুগে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে তথ্যসূত্রের সত্যতা আপেক্ষিক বলে প্রমাণিত হয়। আপেক্ষিকতাবাদের দুটি বৈশিষ্ট্য, প্রথমটি হল-ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনুসন্ধান; দ্বিতীয়টি হল বর্তমানের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ইতিহাস রচনা। এই মতবাদ অনুযায়ী ইতিহাসে বিষয়বস্তুর গুরুত্ব, সময়ের গুরুত্ব, ঘটনার পরিণতির গুরুত্ব সবই আপেক্ষিক।


৪.  বিজ্ঞানধর্মিতা ও নৈতিকতাবাদ: সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চায় বিজ্ঞানসম্মতভাবে তথ্যসূত্র সংগ্রহ করে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানে যেরকম পরীক্ষা, অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের দ্বারা সত্য উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা করা হয়, ইতিহাসেও একইরকমভাবে বিষয়বস্তু ঘটনার সত্যতার কাছাকাছি পৌঁছোনোর চেষ্টা করা হয়। ইতিহাসের সঙ্গে নৈতিকতারও সম্বন্ধ রয়েছে। ইতিহাসে নৈতিক মূল্যবোধের কষ্টিপাথরে ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনাবলির বিচার করা হয়।


2.পেশাদারি শাখা (Professional Branch) হিসেবে ইতিহাসের গুরুত্ব লেখো। অথবা, পেশাদারি শাখা হিসেবে ইতিহাসের গুরুত্ব সংক্ষেপে আলোচনা করো। অথবা, ইতিহাস রচনায় ঐতিহাসিকের ভূমিকা লেখো।

  

উত্তর: ইতিহাসের গুরুত্ব


1. অতীতের ধারণাদানে: আর. জি. কলিংউড তাঁর 'দ্য আইডিয়া অব হিস্ট্রি' গ্রন্থে লিখেছেন ঐতিহাসিকের মস্তিষ্ক থেকে অতীতের যে ছবি বেরিয়ে আসে তা হল ইতিহাস। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব, মানুষের সভ্য দশা, বন্য দশা, সভ্যতার উদয় ও অগ্রগতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি সমস্ত কিছুরই ধারণা দেয় ইতিহাস। জে. বি. বিউরি এবং লিওপোল্ড ভন র‍্যাঙ্কের মতো ঐতিহাসিকগণ তাই বলেছেন- “ঐতিহাসিকের কাজ হল শুধুমাত্র অতীত পুনর্গঠন করা এবং অতীত ঘটনাগুলিকে পরিবর্তিত বা বিকৃত না করে উপস্থাপিত করা।"


2.  জ্ঞানের সুষম বিকাশে: ইতিহাসে আমরা খুঁজে পাই পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভৌগোলিক অবস্থান, সাহিত্যিক বিবর্তন, ভাষার বৈচিত্র্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞানের মানবক্রিয়া এবং অর্থনীতির নানারূপ। এ ছাড়াও মানব বিবর্তন, সভ্যতার উত্থানপতন, সাম্রাজ্যের উত্থানপতন, সমকালীন সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি, সংস্কারকাজ, মহাপুরুষদের উদ্যোগ, বিদ্রোহ, বিপ্লব, আন্দোলন প্রভৃতি সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করা যায় ইতিহাস থেকে। ঐতিহাসিক তাঁর লেখায় সুস্পষ্টভাবে এই বিষয়গুলি তুলে ধরেন।


3.  ঘটনার ধারাবাহিকতার অনুধাবনে: তুর্গো, কনডারসেট প্রমুখের ধারণায় ইতিহাস অনুন্নত থেকে ধীরে ধীরে উন্নত সভ্যতায় গিয়ে পৌঁছোয়। ঐতিহাসিক গিবন বলেন প্রত্যেক যুগেই মানুষের সম্পদ, শক্তি, রান বাড়ছে। ইতিহাস এই সমস্ত কিছুকেই ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করে

স্ব থাকে। প্রাগৈতিহাসিক পর্ব থেকে শুরু করে প্রায়-ঐতিহাসিক ও ঐতিহাসিক স পর্বের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি ইতিহাসে ধারাবাহিকভাবে উঠে আসে। উ ঐতিহাসিক তার ইতিহাস লেখায় প্রাচীন যুগের নিদর্শনগুলি মধ্যযুগে এবং এ মধ্যযুগের নিদর্শনগুলি আধুনিক যুগের মানুষের কাছে উপস্থাপন করে। 


4.  অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সম্পর্কস্থাপনে: ইতিহাস অতীত ও বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র নির্মাণ করে। তাই ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড হ্যালেট গ্রিক ইতিহাসবিদ থুকিডিডিস কার (E.H. Carr) বলেছেন, "ইতিহাস হল বর্তমান ও অতীতের মধ্যে অন্তহীন সংলাপ।” ঐতিহাসিক কার আরও বলেছেন, বর্তমান যেমন অতীত থেকে শিক্ষা নেয়। তেমনি অতীতকেও দেখা হয় বর্তমানের আলোকে। এই প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ঐতিহাসিকের মাধ্যমে ইতিহাসে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে দেওয়া-নেওয়া চলতে থাকে।


5.  বর্তমানের ভিত্তি নির্মাণে: অতীতের ভিতের ওপর বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে। এই বর্তমানকে জানা ও বোঝার জন্য অতীত ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে। আসলে ঐতিহাসিক বর্তমানের চোখে অতীতকে দেখে থাকেন। তিনি বর্তমানের চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা অতীতের ওপর প্রয়োগ করে থাকেন। ফলশ্রুতি হিসেবে অতীত বর্তমানরূপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।


6.  আর্থ-সাংস্কৃতিক উন্নতির ধারণায়: প্রাচীনকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষি ও পশুপালনভিত্তিক অর্থনীতি কীভাবে শিল্প ও বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হল তা জানা যায় ইতিহাস থেকে। এ ছাড়াও কোন্ ধরনের অর্থনীতি মানুষ ও রাষ্ট্রের পক্ষে কল্যাণকর বা কোন্ ধরনের অর্থনীতি দ্বারা একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব সে সম্পর্কে ধারণা দেয় ইতিহাস। এ ছাড়াও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি বা বিবর্তনের ধারা বোঝা যায় ইতিহাস থেকে।


7.  সঠিক সত্য নিরূপণে: সভ্যতায় মানুষের অবদানের বিভিন্ন দিকগুলি তুলে ধরতে গিয়ে ইতিহাস সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যকে অধিক গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত করে। অপরদিকে ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলিকে যতটা বেশি সম্ভব বাদ দিয়ে চলার চেষ্টা করে। নতুন নতুন সঠিক তথ্যের দ্বারা প্রচলিত তথ্যকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন এবং বর্জন করে নতুন সর্বজনগ্রাহ্য সঠিক তথ্য উপস্থাপনা করে ইতিহাস। ফলে ইতিহাসের ক্ষেত্রে আমরা সহজেই সঠিক সত্যটি নিরূপণ করতে পারি।


৪.  জাতীয়তাবাদের ও দেশপ্রেমের বিকাশে: ইতিহাস জনগণকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে ও দেশপ্রেমে জাগ্রত করে। ইতিহাস থেকেই বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্বরূপ উন্মোচিত হয়। স্পেনের বিরুদ্ধে ওলন্দাজদের স্বাধীনতা আন্দোলন, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সংগ্রাম প্রভৃতি সম্পর্কে ইতিহাস থেকেই জ্ঞান লাভ করি।


উপসংহার: পেশাদারি শাখা হিসেবে ইতিহাসের নানাবিধ গুরুত্ব থাকলেও এর সবচেয়ে বড়ো গুরুত্ব হল-একটি দেশের অতীত সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরা।


 3. লোককথার অন্তর্ভুক্ত কিংবদন্তি, লোকপুরাণ, নীতিকথা, গীতিকা ও ব্রতকথার ব্যাখ্যা দাও। অথবা, লোককথার পরিচয় দাও।


উত্তর: সূচনা: লোকসাহিত্যের এক বিশেষ অঙ্গ হল লোককথা। লোককথা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের গল্প।


লোককথার ব্যাখ্যা


1.  কিংবদন্তি


i) পরিচিতি: ইংরেজি 'লেজেন্ড' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল কিংবদন্তি। প্রাচীন সাহিত্যগুলিতে এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- "পূর্বকালে বিশেষ কোনো ভোজ উৎসবে যখন কোনো সন্ন্যাসী বা ধর্মগুরুর জীবনবৃত্তান্ত কথিত বা গীত হত তখন তার নাম হয় কিংবদন্তি।” সাধারণভাবে বলা যায় ইতিহাস ও কল্পনার মিশ্রণে লৌকিক কথাসাহিত্যের রূপবিশিষ্ট লোককাহিনি হল কিংবদন্তি।


ii) চরিত্র: কিংবদন্তির চরিত্রগুলি বীর মানুষের জীবনগাথা। কিংবদন্তি চরিত্র নানা গুণে প্রায় দেবতা হয়ে ওঠেন। অনেক সময় সন্ন্যাসী, ফকির, যাজক বা কোনো স্থান কিংবদন্তির চরিত্র হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকদের ধারণায় কয়েকটি কিংবদন্তির চরিত্র হল-শ্রীকৃয়, রামচন্দ্র, গিলগামেশ, হারকিউলিস, রবিন হুড প্রমুখ।


iii) কাহিনি: কিংবদন্তিতে যে কাহিনি বর্ণিত হয় তা একদিন নির্দিষ্ট অঞ্চলে ঘটেছিল বলে সেই এলাকার বহু মানুষ সাধারণত বিশ্বাস করে থাকেন। কিংবদন্তির কাহিনি সর্বদা আখ্যাননির্ভর হয় না।


2.  লোকপুরাণ


i) পরিচিতি: সৃষ্টির আদিকালে অপরিণত বুদ্ধির মানুষ যে সমস্ত ধর্মীয় অলৌকিক কল্পকাহিনি রচনা ও প্রচার করে তাকে লোকপুরাণ (Myth) বলে। 'Myth' শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ 'Muthos' থেকে।


ii) চরিত্র: লোকপুরাণে কেন্দ্রীয় চরিত্র হল অলৌকিক দেবদেবীগণ। এতে কাহিনির মূল চরিত্র ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক শক্তির ওপর আরোপিত। মূল চরিত্রটি ঈশ্বরের অলৌকিক লীলাকাহিনি বা কর্মকান্ডের রূপকার।


iii) কাহিনি: পৌরাণিক কাহিনিগুলি মূলত ধর্মভিত্তিক। ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার, রীতিনীতি, পূজা-প্রার্থনা, ধর্মোৎসব-উপাচার ইত্যাদির ভিত্তিতে পৌরাণিক কাহিনি গড়ে ওঠে। বিশ্বসৃষ্টির রহস্য, দেবতা —  মানবের জন্ম, মহাপ্লাবন, দেবতা-দানব-মানবের দ্বন্দ্ব, জন্ম-মৃত্যু-আত্মা- পুনর্জন্ম-অবতার, স্বর্গ-নরক, পাপপুণ্য সমস্ত কিছুই হল এর বিষয়।


3.  নীতিকথা


i) পরিচিতি: মানবসমাজের বিভিন্ন সামাজিক পারিবারিক নীতিগুলির দ্বারা যে লোককাহিনি বর্ণিত হয় তাকে বলা হয় নীতিকাহিনি। নীতিকথায় কোনো উপদেশ প্রত্যক্ষভাবে উপস্থাপনা করা হয়। নীতিকথাতে খুব সংক্ষিপ্তভাবে মূলনীতিগুলি উল্লেখ থাকে। বিশেষত লৌকিক নীতিকথাগুলিই এর মূল সুর।


ii) চরিত্র: নীতিকথাগুলির মূল চরিত্র বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগুরু মোজেস, জিশুখ্রিস্ট, হজরত মহম্মদ, ভীষ্ম, বুদ্ধদেব, রামকৃয়দেব প্রমুখ ধর্মগুরু বা ধর্মপ্রবক্তাগণ যুগে যুগে লৌকিক নীতিকথার সাহায্যে অনেক সময় তাদের ধর্মাদর্শ প্রচার করে গেছেন।


iii) কাহিনি: নীতিকথার কাহিনিগুলির শেষে সাধারণত উপদেশগুলির উল্লেখ থাকে। কেবলমাত্র উপদেশ, নির্দেশ বা আদেশ নয়, নীতিবোধের আদর্শই নীতিকথার মূল বিষয়। নানা দোষগুণে ভরা মানুষদের নিয়েই গড়ে উঠেছে নীতিকথার কাহিনি।


4.  গীতিকা


i) পরিচিতি: ইংরেজি 'ব্যালাড' এর বাংলা প্রতিশব্দ হল 'গাথা' বা গীতিকা। লোককথার এক অন্যতম অঙ্গ হল গীতিকা। সুর করে নাটকীয় ভঙ্গিতে গাওয়া গল্পগুলি হল গীতিকা বা ব্যালাড।


ii) চরিত্র: গীতিকা চরিত্রগুলি মূলত কথক ও গায়ক। কথক ও গায়কের মাধ্যমে যে সমস্ত চরিত্রগুলি বর্ণিত হয় সেগুলি মূলত আঞ্চলিক কিংবদন্তি বা সত্য কাহিনিভিত্তিক।


iii) কাহিনি: গীতিকায় নিটোল কাহিনি থাকে। এই কাহিনিতে আঞ্চলিক ভাবনা, ভাষা, রীতিনীতি, পরব, পারিবারিক-সামাজিক জীবন ও আঞ্চলিক লোক সাংস্কৃতিক পরম্পরা ধরা পড়ে।


5.  ব্রতকথা


i) পরিচিতি: ব্রতকথা বলতে আমরা লোককথার সেই বিভাগকেই বুঝি যাতে ব্রতের মধ্যে দিয়ে গ্রাম্য জীবনের নানা ধরনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। ব্রতকথা দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথা-শাস্ত্রীয় ব্রতকথা, মেয়েলি ব্রতকথা।


ii) চরিত্র: ব্রতকথার চরিত্রগুলি মূলত দেবদেবীকেন্দ্রিক। ব্রতকথায় দুধরনের দেবদেবী দেখা যায়। যথা-শান্তশিষ্ট দেবতা ও রুষ্ট দেবতা। অনেক সময় রূপকথা বা পশুকথার চরিত্রগুলিও এতে স্থান পায়।


iii) কাহিনি: ব্রতকথার কাহিনিতে বিভিন্ন ধরনের লোকসামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, কামনা পূরণের লক্ষ্যে কৃচ্ছসাধন পালন, বিপদ মুক্তির উপায়, দেবদেবীর কৃপা লাভের উপায় এবং দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রভৃতি বিষয়কেন্দ্রিক কাহিনি বর্ণিত হয়। ব্রতকথা শোনার গুণ বর্ণনা এবং ব্রত পালনের বিধি-নির্দেশ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে ব্রতকথা কাহিনির সমাপ্তি ঘটে।


উপসংহার: বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষেত্রে লোককথাগুলির মধ্যে সাধারণ কিছু মিল দেখা গেলেও কিংবদন্তির ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না।


4.  কিংবদন্তি বা বীরগাথা (Legends)-র সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য লেখো।


উত্তর:কিংবদন্তির সংজ্ঞা


সাধারণত বিশেষ কোনো অঞ্চলে সংঘটিত কোনো ঘটনা বা চরিত্রকেন্দ্রিক কাহিনি যা সেই অঞ্চলের মানুষ প্রজন্ম পরম্পরায় মনে রাখে এবং বিশ্বাস করে ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রচার করে, তাকে কিংবদন্তি বলে। মৌখিক ইতিহাসে এক প্রধান উপাদান হল কিংবদন্তির কাহিনি বা বীরগাথা (Leg- ends)। সত্য, মিথ্যা, সম্ভাবনা-এই তিনের মিলিত সমষ্টি কিংবদন্তি। পুরাকালে বিশেষ কোনো ভোজ উৎসবে কোনো সন্ন্যাসী বা ধর্মগুরুর যে সমস্ত জীবনবৃত্তান্ত কথিত বা গীত হত তাকে কিংবদন্তি বলা হত। ব্লুমসবেরি ইংরেজি অভিধানে কিংবদন্তি সম্বন্ধে বলা হয়েছে-কিংবদন্তি হল এমন এক গল্প যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উপস্থাপিত হয়েছে ইতিহাসরূপে, আসলে যা সত্যি নয়। মারিয়া লিচ সম্পাদিত 'Standard Dictionary of Folk- lore, Mythology and Legend' গ্রন্থে বলা হয়েছে "কিংবদন্তি একটি বর্ণিত বিষয়রূপেই প্রচলিত হয়েছে, যা ঘটনার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে, এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে ঐতিহ্যগত উপাদান, যাতে কোনো ব্যক্তি, স্থান অথবা ঘটনার কথাই বলা হয়।"


কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্য:-


1.  উদ্ভবগত: অনেকের মতে মানুষের সামাজিক বিবর্তনের পথ ধরেই কিংবদন্তির উদ্ভব হয়েছে। পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক কল্পকাহিনির চরিত্রগুলি থেকেই কিংবদন্তির জন্ম বলে মনে করা হয়। যে সময়ে মানুষ আদিম জীবন থেকে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে সেই সময় থেকেই কিংবদন্তির সূচনা।


2.  বীরত্বমূলক কাহিনির নায়ক: কিংবদন্তি বা বীরগাথায় আসলে বীরত্বমূলক কাহিনির নায়কের দ্বারা অতীতের কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বীরত্বপূর্ণ ও অবিশ্বাস্য কর্মকাণ্ডের পরিচয় তুলে ধরা হয়। কিংবদন্তি কোনো প্রামাণ্য চরিত্র নয়।


3.  লোকমানসজাত গল্প: লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হল কিংবদন্তি। লোকের মুখে বিভিন্ন কথার মাধ্যমে কিংবদন্তি ছড়িয়ে পড়ে। কিংবদন্তি জীবনের যথার্থ প্রতিফলন, এতে লোকবিশ্বাস ও সংস্কার লুকিয়ে থাকে।


4.  অতিরঞ্জন: কিংবদন্তি চরিত্র বা ঘটনাগুলির মধ্যে মানবীয় কাল্পনিক ঘটনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বলা যায় কিংবদন্তি হল বাস্তব ও কল্পিত ঘটনার সংমিশ্রণে গঠিত খণ্ড খণ্ড অবয়ব। আসলে কিংবদন্তির চরিত্র এবং ঘটনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লৌকিক হওয়ায় তার বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি।


5. বিস্ময় ও কল্পনা: কিংবদন্তির চরিত্র বা কাহিনিগুলি আমাদেরকে বিস্মিত করে এবং আমাদেরকে এক কল্পনার জগৎ-এ নিয়ে যায়। কিংবদন্তি হল বস্তুত সাধারণ মানুষের ভাবনা ও আগ্রহের বিকশিত রূপ যাতে কালে কালে নতুন কল্পনার রং মিশে তাকে কাল্পনিক করে তোলে।


6.  ইতিহাসধর্মিতা: অনেক সময় কিংবদন্তির মধ্যে সত্য ইতিহাসভিত্তিক কাহিনি লুকিয়ে থাকে। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীগণ মনে করেন কিংদন্তির মধ্যে ক্ষীণভাবে হলেও ইতিহাসের সূত্র রয়ে যায়। যদিও মৌখিক ঐতিহ্যে রূপান্তরিত হওয়ার পর কিংবদন্তির মধ্যে অনেক কাল্পনিক প্রলেপ পড়ে। তাই ঐতিহাসিক স্টিথ থমসন তাঁর 'The Folk' গ্রন্থে লিখেছেন প্রাথমিক অবস্থায় কিংবদন্তির মধ্যে কিছু ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য থাকলেও পরবর্তীকালে পল্লবিত হতে হতে ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনা মুছে যায়, রয়ে যায় শুধুমাত্র সম্ভব-অসম্ভবের অপরূপ কাহিনি।


5. ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব কী? পেশাদারি শাখা হিসেবে সংক্ষেপে ইতিহাসের গুরুত্ব আলোচনা করো। 


উত্তর: ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার গুরুত্ব


স্মৃতিকথা (Memories) হল ইতিহাস রচনার একটি অন্যতম মৌখিক উপাদান। কোনো মানুষ অতীতের কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী হতে পারেন এবং সেই বিষয়ে তাঁর কাছে অনেক তথ্য থাকতে পারে। সেই ব্যক্তি এই ঘটনাগুলি পরবর্তীকালে স্মরণে এনে তা লিখিত আকারে প্রকাশ করতে পারেন। এই লিখিত তথ্য স্মৃতিকথা নামে পরিচিত। ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।যেমন— 


1.  গুণীজনদের লেখা তথ্য: স্মৃতিকথাগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন শাখার গুণী ব্যক্তিরা রচনা করেন। ফলে তাতে অবান্তর, পক্ষপাতমূলক ও অতিরঞ্জিত ঘটনার প্রবেশ খুবই হ্রাস পায় বলে কেউ কেউ মনে করেন। অবশ্য এবিষয়ে বিতর্ক আছে।


2.  বাস্তবতা: স্মৃতিকথাগুলি কাল্পনিক বিষয় নয়। এগুলি থেকে অতীতের বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার তথ্য ও বিবরণ পাওয়া যায়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার দাঙ্গার ঘটনাবলি বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়।


3.  প্রত্যক্ষ সাক্ষী: বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বা প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে ঘটনার বিবরণ তাঁদের স্মৃতিকথাগুলিতে আলোচনা করেন। ফলে উক্ত বিবরণে ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যতা অনেক বেশি থাকে।


4.  ঐতিহাসিক উপাদান:
বিভিন্ন স্মৃতিকথা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার মূল্যবান উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাক-বাহিনী পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের ওপর যে বর্বর ও নৃশংস অত্যাচার ও হত্যালীলা চালিয়েছিল তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হল বিভিন্ন স্মৃতিকথাগুলি। কেননা, পাক সামরিক বাহিনী তখন পূর্ববাংলার সমস্ত সংবাদ গোটা বিশ্ব থেকে আড়াল করেছিল।



Editing by- Rita Moni Bora