Chapter–3
ঔপনিবেশিক আধিপত্যের প্রকৃতি:
নিয়মিত ও অনিয়মিত সাম্রাজ্য
--------------------------------
1. নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করেন-------------- খ্রিস্টাব্দে।
a) ১৭০৭
b) ১৭২৭
c) ১৭৩৯
d) ১৭৫২
উত্তর: c) ১৭৩৯
2. পন্ডিচেরি ছিল--------------দের প্রধান ঘাঁটি।
a) ইংরেজ
b) পোর্তুগিজ
c) ফরাসি
d) ওলন্দাজ
উত্তর: c) ফরাসি
3. বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব ছিলেন--------------।
a) মুর্শিদকুলি খাঁ
b) আলিবর্দি খাঁ
c) সিরাজ-উদ্দৌলা
d) মিরকাশিম
উত্তর: a) মুর্শিদকুলি খাঁ
4. কলকাতা নগরীর প্রতিষ্ঠা করেন----------------।
a) লর্ড ক্লাইভ
b) জব চার্নক
c) সিরাজ-উদ্দৌলা
d) ওয়ারেন হেস্টিংস
উত্তর: b) জব চার্নক
5. পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের-------------।
a) ২৩ মার্চ
b) ২৩ এপ্রিল
c) ২৩ মে
d) ২৩ জুন
উত্তর: d) ২৩ জুন
6. পন্ডিচেরির ফরাসি শাসনকর্তা কে ছিলেন?
a) ক্লাইভ
b) ডুপ্লে
c) কাউন্ট লালি
d) হেস্টিংস
উত্তর: b) ডুপ্লে
7. ভারতের ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ছিলেন-
a) জোসেফ ডুপ্লে
b) রবার্ট ক্লাইভ
c) টমাস রো
d) ভাস্কো-ডা-গামা
উত্তর: a) জোসেফ ডুপ্লে
৪. ইংরেজ কোম্পানি যার কাছ থেকে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার পায়, তিনি হলেন-
a) বাহাদুর শাহ
b) মহম্মদ শাহ
c) দ্বিতীয় শাহ আলম
d) ফারুখশিয়ার
উত্তর: d) ফারুখশিয়ার
9. ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফারুখশিয়ারের কাছ থেকে ফরমান বা দস্তক লাভ করে-
a) ১৭০৭ খ্রি.
b) ১৭১৭ খ্রি.
c) ১৭২৪ খ্রি.
d) ১৭৩৩ খ্রি.
উত্তর: b) ১৭১৭ খ্রি.
10. ভারতের কোন্ রাজ্যে প্রথম ইংরেজরা রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে?
a) বোম্বাই
b) গুজরাট
c) মাদ্রাজ
d) বাংলা
উত্তর: d) বাংলা
11. সিরাজ-উদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন-
a) ঘসেটি বেগম
b) আলিবর্দি খাঁ
c) আমিনা বেগম
d) মীরমদন
উত্তর: a) ঘসেটি বেগম
12. ইংরেজরা কলকাতায় আশ্রয় দিয়েছিল-
a) রাজবল্লভকে
b) ঘসেটি বেগমকে
c) মানিকচাঁদকে
d) কৃষ্ণদাসকে
উত্তর: d) কৃষ্ণদাসকে
13. সিরাজ-উদ্দৌলা তাঁর দূত হিসেবে কাকে ইংরেজদের কাছে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন?
a) কৃষ্ণদাসকে
b) রাজবল্লভকে
c) নারায়ণ দাসকে
d) মানিকচাঁদকে
উত্তর: c) নারায়ণ দাসকে
14 . সিরাজ-উদ্দ্দৌলার প্রধান সেনাপতি ছিলেন-
a) মিরজাফর
b) মোহনলাল
c) মিরমদন
d) মিরকাশিম
উত্তর: a) মিরজাফর
15. কার আদেশে সিরাজ-উদদৌলা নিহত হন?
a) মিরজাফরের
b) মিরনের
c) মিরকাশিমের
d) জগৎ শেঠের
উত্তর: b) মিরনের
Short Answer Question
1. সর্বপ্রথম কোন্ ইউরোপীয় নাবিক কবে জলপথে আসেন?
উত্তর: পোর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন।তিনি ভারতে ভারতে পশ্চিম উপকূলে কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছান।
2. এশিয়ার কোন্ দুটি দেশে ইউরোপীয়দের সর্বাধিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এখানে কোন্ শক্তির সর্বাধিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: এশিয়া মহাদেশের ভারত ও চিনে ইউরোপীয়দের সর্বাধিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এখানে সর্বাধিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটেন।
3. মোগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সময় ভারতে গড়ে ওঠা কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তির নাম লেখো।
উত্তর: মোগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সময় ভারতে গড়ে ওঠা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক শক্তি ছিল বাংলা, হায়দ্রাবাদ, অযোধ্যা, মহীশূর, মারাঠা প্রভৃতি।
4. মুর্শিদকুলি খাঁ কে ছিলেন?
উত্তর: মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বিশ্বস্ত অনুচর। তিনি ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার দেওয়ান এবং ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ও উড়িষ্যার সুবাদার বা নবাব নিযুক্ত হন।
5. পোর্তুগিজরা ভারতের কোথায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে?
উত্তর: পোর্তুগিজরা ভারতের কালিকট, কোচিন, গোয়া, দমন, দিউ, সলসেট, বেসিন, বোম্বাই, হুগলি প্রভৃতি স্থানে তাদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে।
6. ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের কোথায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে?
উত্তর: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের সুরাট, আগ্রা, আহম্মদনগর, ব্রোচ, মাদ্রাজ, কলকাতা প্রভৃতি স্থানে তাদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে।
7. ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কোথায় প্রথম ইংরেজ বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়?
উত্তর: ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে সুরাটে প্রথম ইংরেজ বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপিত হয়।
৪. স্যার টমাস রো কবে, কী উদ্দেশ্যে এবং ভারতের কোন্ সম্রাটের দরবারে হাজির হন?
উত্তর : ব্রিটিশ-রাজ প্রথম জেমসের দূত স্যার টমাস রো ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের দরবারে হাজির হন। তার উদ্দেশ্য ছিল জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে কিছু বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা লাভ করা।
9. 'দস্তক' কী?
উত্তর: মোগল সম্রাট ফারুখশিয়ার ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুকূলে এক 'ফরমান' জারি করেন। এই ফরমান অনুসারে কোম্পানি বার্ষিক ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য ও অন্যান্য কিছু অধিকার পায়। এটি ফারুখশিয়ারের ফরমান বা 'দস্তক' নামে পরিচিত।
10. সিরাজ-উদ্দৌলা কবে কলকাতা আক্রমণ ও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করেন?
উত্তর: সিরাজ-উদদৌলা ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা আক্রমণ ও ২০ জুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করেন।
11. 'অন্ধকূপ হত্যা' কী?
উত্তর: হলওয়েল নামক জনৈক ইংরেজ কর্মচারী উল্লেখ করেছেন যে, সিরাজ-উদ্দ্দৌলা কর্তৃক কলকাতা আক্রমণের (১৭৫৬ খ্রি.) পরে তাঁর নির্দেশে কলকাতায় বন্দি ১৪৬ জন ইংরেজ সৈন্যকে ১৮ ফুট লম্বা ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি চওড়া একটি ছোটো ঘরে আটক রাখা হয়। এর ফলে ১২৩ জন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই ঘটনা 'অন্ধকূপ হত্যা' (Black Hole Tragedy) নামে পরিচিত।
12. কলকাতা দখল করে সিরাজ-উদ্দ্দৌলা কলকাতার কী নামকরণ করেন এবং তিনি কাকে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন?
উত্তর: কলকাতা দখল করে সিরাজ-উদ্দৌলা এর নতুন নামকরণ করেন 'আলিনগর' এবং তিনি সেখানকার শাসনকর্তা হিসেবে মানিকচাঁদকে নিযুক্ত করেন।
13. কবে, কাদের মধ্যে আলিনগরের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়?
অথবা, আলিনগরের সন্ধি কত খ্রিস্টাব্দে কাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়?
উত্তর: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে (৯ ফেব্রুয়ারি) বাংলার নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা ও কলকাতার ইংরেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলিনগরের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়।
14. আলিনগরের সন্ধির দ্বারা ইংরেজরা কী কী অধিকার লাভ করে?
উত্তর: আলিনগরের সন্ধির দ্বারা ইংরেজরা বিনাশুল্কে বাণিজ্য, কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ ও নিজ নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলনের অধিকার লাভ করে।
15. কবে, কাদের মধ্যে পলাশির যুদ্ধ হয়েছিল?
উত্তর: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে (২৩ জুন) বাংলার নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা এবং কলকাতার ইংরেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে পলাশির যুদ্ধ হয়েছিল।
16. পলাশির যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রধান সেনাপতি কারা ছিলেন?
উত্তর: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশির যুদ্ধে সিরাজ-উদ্-দৌলার বাহিনীর মিরজাফর এবং ইংরেজ বাহিনীর লর্ড ক্লাইভ প্রধান সেনাপতি ছিলেন।
17. 'পলাশির লুণ্ঠন' বলতে কী বোঝ? অথবা, 'পলাশির লুণ্ঠন' কী?
উত্তর: পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা ইংল্যান্ডে পাচার করেছিল। ইংরেজরা সোনা, রুপো । বা অন্য কোনো পণ্যসামগ্রীর বিনিয়া এই সম্পদের নির্গমন ঘটায়নি। তাই এই ঘটনাকে অনেকে লুণ্ঠন বলে উল্লেখ করেছ ব্রুকস অ্যাডামস আর্থিক নির্গমনের এই ঘটনাকে 'পলাশির লুণ্ঠন' বা 'Plassey Plung বলে অভিহিত করেছেন।
18. কবে, কাদের মধ্যে এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়?
উত্তর: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং অয্যোধার নবাব সুজা-উদদৌলার ৯ এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়।
19. কবে, কাদের মধ্যে এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়?
উত্তর: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং দিল্লির মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম মধ্যে এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়।
20. কে, কবে ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হন?
উত্তর: লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হন।
Long Answer Question
1. 'ক্যান্টন বাণিজ্য' বলতে কী বোঝ? ক্যান্টন বাণিজে বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো। অথবা, ক্যান্টন বাণিজ্য বলতে কী বোঝায়? চিনের এ আরোপিত বৈষম্যমূলক চুক্তি পর্যালোচনা করো।
উত্তর: ক্যান্টন বাণিজ্য
প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ক্যান্টন ছিল চিনের একটি গরুদ্ধদ্ধ প্রাণিজ্যকেন্দ্র। নানকিং-এর সন্ধির (১৮৪২ খ্রি.) আগে পর্যন্ত গোটা বিদেশিদের কাছে বুদ্ধ থাকলেও একমাত্র ক্যান্টন ছিল বিদেশিদের কা উন্মুক্ত বন্দর। চিনা আদালত ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে এক নির্দেশনামার জ একমাত্র ক্যান্টন বন্দরকেই বিদেশি বাণিজ্যের জন্য খুলে দেয়। এভা ক্যান্টন বন্দরকে কেন্দ্র করে চিনে বিদেশিদের এক-বন্দরকেন্দ্রিক যে বদ্যি প্রথার সূচনা হয় তা 'ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা' নামে পরিচিত। এই প্রথা ১৮৪ খ্রিস্টাব্দে নানকিং-এর সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত চলে। ক্যান্টকে বাণিজ্যে প্রথম পর্বে পোর্তুগিজরা এবং পরে ব্রিটেন-সহ অন্যান্য ইউরোগ জাতিগুলি নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে।
ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য:
1. রুদ্ধদ্বার নীতি: ক্যান্টন বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী বিদেশি বণিকদে চিনা ভাষা ও আদবকায়দা শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। তারা ক্যান্টনে চিনা ফৌজদারি ও বাণিজ্যিক আইন মেনে চলতে বাধ্য ছিল। বিদেশি বাণিজ্য কুঠিতে মহিল ও আগ্নেয়াস্ত্রের প্রবেশ, দাসী নিয়োগ প্রভৃতি নিষিদ্ধ ছিল। বাণিজ্যের মরণ শেষে ক্যান্টনে আসা বিদেশি বণিকদের এই বন্দর ছেড়ে চলে যেতে হয় চিনে বিদেশি বণিকদের প্রতি এই কঠোর নীতি 'রুদ্ধদ্বার নীতি' নায় পরিচিত।
2. মূল শহরে প্রবেশে বাধা: ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্য করতে আস ইউরোপীয় বণিকরা শহরের প্রধান ফটকের বাইরে একটি নির্দিষ্ট স্বায় বসবাস ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপ চালাতে বাধ্য হত। বণিকরা ক্যান্টন শহরে প্রাচীরের বাইরে বাস করলেও তাদের স্ত্রী-সন্তানদের রেখে আসতে হয় ম্যাকাও-এ।
3. কো-হং প্রথা: বিদেশি বণিকরা চিনের ক্যান্টন বন্দরে এ স্বাধীনভাবে বা সরাসরি এখানকার বাণিজ্যে অংশ নিতে পারত না। কেনন বিদেশি বণিকদের কোনো অবস্থাতেই চিনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে দেওয়া হত না বা অন্য যে-কোনো বণিকদের কাছ থেকেও সস্তা দরে তালে মাল কেনার অধিকার ছিল না। চিন সরকার একমাত্র 'কো-হং' নামক বণিকসংঘকে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছিল এবং বিদেশি বণিকরা ক্যান্টন বন্দরে একমাত্র কো-হং বণিকদের কাছ থেকেই মাল কিনছে বাধ্য ছিল।
7. শিমোনোসেকির সন্ধির শর্তানুসারে-[i] কোরিয়াকে চিন স্বাধীনতা দেয়। [ii] চিনের কাছ থেকে জাপান পেস্কাডোরেস, তাইওয়ান, লিয়াও উপদ্বীপ ও পোর্ট আর্থার লাভ করে। [iii] জাপানকে চিন ২৩০ মিলিয়ন কিউপিং টেল ক্ষতিপূরণ দেয়। [iv] চিন তার বেশ কয়েকটি বন্দর জাপানে জন্য খুলে দেয়।
৪. বক্সার প্রোটোকলের শর্তানুসারে-[i] বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত ১২ জন রাজপুরুষের প্রাণদণ্ড এবং শতাধিক রাজপুরুষকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয় [ii] চিনের ওপর বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়। [iii] পিকিং-এর বিদেশি দূতাবাসগুলি রক্ষার জন্য সেখানে স্থায়ীভাবে বিদৌ সেনা মোতায়েন করা হয়। [iv] চিনের ২৫টি দুর্গ ভেঙে ফেলা হয় এবং ১২৫টি রেলস্টেশন ইউরোপীয় সেনাদের দখলে রাখা হয়।
4. কো-হং-দের দুর্নীতি: ক্যান্টনের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পেয়ে কো-হং বণিকরা অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একচেটিয়া তারা চিনা রাজদরবার, আদালত ও শুল্ক অধিকর্তাকে বিপুল অর্থ উৎকোচ হিসেবে দিত। বাণিজ্যের বেশির ভাগ লভ্যাংশ কো-হং বণিকরা আত্মসাৎ করত।
5. ব্যক্তিগত বাণিজ্য: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-সহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের বণিকরা চিনের ক্যান্টন বন্দরে যে বাণিজ্য করত তা ছিল মূলত ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের জন্য চিনের সঙ্গে বিদেশি বণিকদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন পড়ত না।
6. ব্রিটিশ বণিকদের প্রাধান্য: ক্যান্টন বাণিজ্যে প্রথমদিকে পোর্তুগিজরা প্রবেশ করলেও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ বণিকরা এই বাণিজ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। ক্যান্টনে ব্রিটিশ বণিকদের চায়ের বাণিজ্য সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল। এ ছাড়া তারা রেশম, মৃৎপাত্র, দারুচিনি, ঔষধপত্র প্রভৃতি ইংল্যান্ডে রপ্তানি করত। তারা ইংল্যান্ড থেকে পশম বস্ত্র, লোহা, টিন, সিসা, পশুর লোম প্রভৃতি চিনে আমদানি করত। চিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের এই বাণিজ্য 'দেশীয় বাণিজ্য' নামে পরিচিত ছিল।
উপসংহার: ব্রিটিশ বণিকরা উনিশ শতকের প্রথম থেকে ভারত থেকে চোরাপথে চিনে আফিম রপ্তানি করতে থাকে। ফলে ক্যান্টন বাণিজ্যের চরিত্র বদলাতে শুরু করে। আফিমের ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে চিনের সঙ্গে ব্রিটেনের বিরোধের ফলে প্রথম আফিম যুদ্ধ বা প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২ খ্রি.) সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে চিনের পরাজয়ের ফলে ক্যান্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। চিন ক্যান্টন-সহ বেশ কয়েকটি বন্দর বিদেশি বণিকদের জন্য খুলে দিতে বাধ্য হয়।
2. চিনের ওপর আরোপিত 'অসম চুক্তি' বলতে কী বোঝায়? এ অসম চুক্তি বা বৈষম্যমূলক চুক্তির বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।
উত্তর: চিনের ওপর আরোপিত অসম চুক্তি :
একদা বিদেশিদের জন্য রুদ্ধ চিনের অভ্যন্তরে বিদেশিরা উনিশ শতক থেকে • প্রবেশ করতে শুরু করে এবং চিনের অভ্যন্তরে নিজেদের ক্ষমতার জরি । ছড়িয়ে দেয়। বহিরাগত, বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যায় রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি মোটামুটিভারে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের আগে পর্যন্ত চিনে কিং বংশের শাসনকালে চিনকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করে এবং যুদ্ধের পর চিনের ওপর বিভিন্ন শোষণমূলক সন্ধি বা চুক্তি চাপিয়ে দেয়। এই চুক্তিগুলি সাধারণভাবে 'অসম চুক্তি' বা 'বৈষম্যমূলক চুক্তি' (Unequal treaty) নামে পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চিনা ঐতিহাসিক ওয়াং ডং-এর মতে, 'অসম চুপ্তি - কথাটি দীর্ঘদিন ধরে বহুল প্রচলিত হলেও এর সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন অর্থের • অভাব রয়েছে। তা ছাড়া সঠিক কোন্ চুক্তিগুলিকে বা কতগুলি চুব্বিরে 'অসম' বা 'বৈষম্যমূলক' আখ্যা দেওয়া উচিত তা-ও পরিষ্কার নয়।
চিনের ওপর আরোপিত অসম চুক্তির বৈশিষ্ট্য :
১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত চিনের ওপর বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি বিভিন্ন 'অসম' বা 'বৈষম্যমূলক' চুক্তি সাক্ষরে বার্ধ করে। এই চুক্তিগুলিকে চিনের 'শতাব্দীব্যাপী অবমাননা' বলে চিহ্নিত করা হয়। চিনের ওপর বিদেশিদের আরোপ করা বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলির কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, যেমন-
1. একতরফা চুক্তি: প্রতিটি চুক্তির ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, কোনো পশ্চিমি শক্তির কাছে যুদ্ধে পরাজয়ের পর তারা চিনের ওপর একতরফাভাবে এসব চুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিল। চুক্তির শর্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে চিনের মতামতের কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
2. ভৌগোলিক আধিপত্য: চিনের ওপর বিভিন্ন অসম চুক্তি আরোপের মাধ্যমে বিদেশি শক্তিগুলি চিনের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের একাধিপত্য স্থাপন করে। এইসব অঞ্চলগুলিতে বিদেশি আইন ও প্রশাসন কার্যকরী হয়।
3. সার্বভৌমত্ব সংকুচিত: চিনের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অসম চুক্তিগুলি সরাসরি চিনের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত করে। এই চুক্তিগুলির মাধ্যমে চিনের সার্বভৌম ক্ষমতা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পায়। চিন প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমি শক্তিগুলির 'আধা উপনিবেশ'-এ পরিণত হয়।
4. এখনিজ সম্পদ রপ্তানি: বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি চিনের ওপর অসম চুক্তিগুলি চাপিয়ে চিনের বিভিন্ন খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করে নেয়। এইসব সম্পদ চিনের বন্দরগুলি থেকে বিদেশে রপ্তানি হলে বিদেশের শিল্প ও অর্থনীতির উন্নতি ঘটে। অন্যদিকে চিনের শিল্প ও অর্থনীতি ক্রমাগত ভেঙে পড়তে থাকে।
5. ক্ষতিপূরণ দান: প্রথম আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২ খ্রি.) ও পরবর্তী বিভিন্ন যুদ্ধগুলির জন্য চিনই একমাত্র দায়ী ছিল না। অথচ যুদ্ধের পর পশ্চিমি শক্তিগুলি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চিনের ওপর নানকিং-এর চুক্তির ন্যায় বিভিন্ন অসম চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে চিনকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করে।
6. বাণিজ্য করার অধিকার: বিভিন্ন অসম চুক্তির মাধ্যমে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির কাছে চিন তার বিভিন্ন বন্দর বাণিজ্যের জন্য খুলে দিতে ও বিভিন্ন ভূখণ্ড লিজ (lease) দিতে বাধ্য হয়। চিন তার হংকং বন্দর ব্রিটেনের জন্য এবং ম্যাকাও বন্দর পোর্তুগালের জন্য খুলে দেয়। বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা ছাড়াও চিন বিদেশির আরও বিভিন্ন রকম সুযোগসুবিধা দিতে বাধ্য হয়। এসব বৈশিষ্ট্যের জন্য বিদেশি শক্তিগুলির দ্বারা চিনের ওপর আরোপিত এই চুক্তিগুলিকে 'অসম' বা 'বৈষম্যমূলক' বলে অভিহিত করা হয়।
7. শুল্ক ছাড়: বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি চিনের ওপর ওয়াংঘিয়ার ন্যায় বিভিন্ন অসম চুক্তি চাপিয়ে নিজেদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক ছাড় নিতে থাকে। চিনের বণিকরা সরকারকে ন্যায্য শুল্ক দিয়ে বাণিজ্য করলেও বিদেশিরা শুল্ক ছাড় পেয়ে বাণিজ্যে অধিক মুনাফা অর্জন করে। অন্যদিকে চিনের দেশীয় বাণিজ্য মার খেতে থাকে।
3. অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত চিনে বিদেশিদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হত? কোন্ পরিস্থিতিতে চিনে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করে?
উত্তর: চিনে বিদেশি বাণিজ্যের সমস্যা :
উনবিংশ শতকের সূচনায় কিং বা মাঞ্জু রাজবংশ-শাসিত চিন ছিল সবদিক থেকেই পিছিয়ে-পড়া একটি দেশ। আধুনিক যুগের শুরুতেও সামন্ততান্ত্রিক চিনের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান, কারিগরি জ্ঞান, সামরিক বাহিনী-সবকিছুই ছিল পশ্চাৎপদ। চিনের জনসংখ্যার ৪/৫ অংশই তার কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। গর্বিত চিনারা মনে করত যে, বিদেশিরা হল 'বর্বর' এবং বিদেশিদের কাছ থেকে তাদের কিছু শেখার বা গ্রহণ করার নেই। -- এজন্য চিনে বিদেশিদের বাণিজ্যে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হত, যেমন-
1. বিদেশি বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা: চিনাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিজের দেশেই পাওয়া যেত বলে তা বিদেশ থেকে আনতে হত না। এজন্য চিনের সাধারণ মানুষ ও সরকার চিনে বিদেশিদের প্রায় আগমন ও বাণিজ্যের অধিকার দেওয়ার তীব্র বিরোধী ছিল। চিনের মাঞ্জু * শাসকগণ ১৬৫৬, ১৬৬২ ও ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে পৃথক ঘোষণার মাধ্যমে চিনের বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে জানায় যে, সম্রাটের বিশেষ অনুমতি ছাড়া কোনো ইউরোপীয় চিনে প্রবেশ করতে পারত না।
2. নজরানা পদ্ধতি: চিনে বাণিজ্যিক অধিকার পাওয়ার উদ্দেশ্যে কোনো বিদেশি দূত চিন সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে তাকে বশ্যতা স্বীকারের নিদর্শনস্বরূপ দুটি অপমানজনক কাজ করতে বাধ্য করা হত- [i] চিন সম্রাটকে 'নজরানা' বা 'উপঢৌকন' দিতে হত এবং [ii] 'কাও তাও' ঠাপ্রথা অনুসারে সম্রাটের সামনে তাকে ভূমি পর্যন্ত নত হতে হত।
3. বল প্রয়োগ: ইউরোপীয় বণিকদের কাছে চিনের মূল্যবান সাদা রেশম, সবুজ চা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের বিপুল চাহিদা ছিল। কিন্তু বিদেশিরা সহজ পথে চিনে প্রবেশ ও বাণিজ্য করার সুযোগ না পেয়ে পরবর্তীকালে চিনের ওপর বল প্রয়োগ ও সামরিক অভিযান চালায়। চিনের এ। ওপর বিভিন্ন অসম চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে বিদেশি শক্তিগুলি চিনের কাছ থেকে নানা বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেয়।
চিনে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ :
চিনে বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্র চিনে বাণিজ্যের মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে পোর্তুগালের রাফায়েল পেরস্ট্রেলো ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম চিনে বাণিজ্য করতে আসেন। এরপর অবশ্য অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে একে একে বিভিন্ন ইউরোপীয় বণিক জাতি চিনে প্রবেশ করতে থাকে। চিনে বিদেশিদের পুঁজির অনুপ্রবেশের প্রেক্ষাপট ছিল-
1. মাঞ্জু শাসকদের অপশাসন: অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে চিনের মাঞ্জু রাজবংশের অপশাসন, দুর্নীতি ও সামরিক দুর্বলতা অত্যন্ত প্রকট হয়ে ওঠে। ধনী অভিজাত ও ভূস্বামীদের হাতে দেশের যাবতীয় সম্পদ কেন্দ্রীভূত হলে দরিদ্র কৃষকদের অবস্থা করুণ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে অত্যাচারী মাঞ্জু শাসকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে। 'শ্বেতপদ্ম' নামে গুপ্ত সমিতির উদ্যোগে চিনে প্রায় ৯ বছর ধরে কৃষক বিদ্রোহ চলে। চিনের বিভিন্ন স্থানে আরও বিভিন্ন বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
2. পাশ্চাত্যের সঙ্গে যোগাযোগ: ষোড়শ শতক থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করতে আসা ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে চিনাদের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগালের মাধ্যমে চিনের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এরপর একে একে স্পেনীয় (১৫৭৫ খ্রি.), ওলন্দাজ (১৬০৪ খ্রি.), ইংরেজ (১৬৩৭ খ্রি.), ফরাসি (১৬৯৮ খ্রি.), দিনেমার (১৭৩১ খ্রি.), আমেরিকান (১৭৮৪ খ্রি.) প্রভৃতি জাতি চিনে বাণিজ্য করতে আসে।
3. অনুপ্রবেশের পর্যায়: চিনে বিদেশি বণিকদের অনুপ্রবেশের তিনটি প্রধান পর্যায় লক্ষ করা যায়, যথা-
i) প্রথম পর্যায়: অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ বা প্রথম আফিম যুদ্ধ পর্যন্ত চিনে বিদেশি অনুপ্রবেশের প্রথম পর্যায়।
ii) দ্বিতীয় পর্যায়: ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে নানকিং চুক্তি থেকে উনবিংশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত চিনে বিদেশি অনুপ্রবেশের দ্বিতীয় পর্যায়।
iii) তৃতীয় পর্যায়: উনবিংশ শতকের শেষ থেকে ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত চিনে বিদেশি অনুপ্রবেশের তৃতীয় পর্যায়।
4. চিনের খনিজ সম্পদের ওপর বিদেশিদের অধিপত্য়ের প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো ।
উত্তর : চিনের খনিজ সম্পদের ওপর বিদেশিদের আধিপত্য :
1. আধিপত্যের সূত্রপাত: প্রথম আফিম যুদ্ধের পর চিনের ওপর ইংল্যান্ড নানকিং-এর সন্ধি (১৮৪২ খ্রি.) চাপিয়ে দেয়। এরপর থেকে বিদেশিদের কাছে বুদ্ধ চিনের অভ্যন্তরে প্রবেশের পথ সহজ হয়ে যায়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি বিভিন্ন দেশ চিনের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের
প্রভাবাধীন অঞ্চল গড়ে তোলে এবং সেখানে নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
2. খনিজ সম্পদ রপ্তানি: চিনে নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে বিদেশি শক্তিগুলি সেখানকার খনিজ সম্পদের ওপর নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করে। তা ছাড়া বিদেশি জাতিগুলি বিপুল পরিমাণ অর্থ উৎকোচ দিয়ে চিন সম্রাটের কাছ থেকে সেখানকার বিভিন্ন খনিজ সম্পদ উত্তোলন করার অধিকার অর্জন করে এবং কয়লা, লোহা ও অন্যান্য ধাতুর আকরিক প্রভৃতি সংগ্রহ করে তা নিজেদের দেশে রপ্তানি করতে থাকে।
3. রেলপথের ব্যবহার: চিনের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি থেকে খনিজ সম্পদ সংগ্রহ করে তা নিজেদের দেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বিদেশি শক্তিগুলি চিনে রেলপথের প্রসার ঘটায়। রাশিয়া রেলপথের মাধ্যমে চিনের সেন্ট পিটার্সবার্গ-এর সঙ্গে উত্তর সীমান্তের ভ্লাডিভোস্টক বন্দরকে এবং ট্রান্স- সাইবেরীয় রেলপথের সঙ্গে পোর্ট আর্থার বন্দরকে যুক্ত করে। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের পর তা রেলের মাধ্যমে চিনের বিভিন্ন বন্দরে এবং করার থেকে বিদেশের শিল্প-কারখানায় চলে যায়।
4. অসম সন্ধির ভূমিকা: বৈদেশিক শক্তিগুলি চিনের ওপর দি অসম সন্ধি চাপিয়ে দিয়ে সেখানকার খনিজ সম্পদের ওপর দখলস কায়েম করে। জাপানের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শিমোনোসেকির স (১৮৯৫ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হলে চিন বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের সহায়তা লাগ আশা করে। এই সুযোগে ফ্রান্স চিনের ইউনান, কোয়াংসি এবং কোয়াং। অঞ্চলের খনিজ সম্পদের অধিকার লাভ করে। ফ্রান্স ইন্দেচিনের অন্য থেকে চিনের অভ্যন্তর ভাগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত রেলপথ নির্মাণের অধিক - পায়। এই রেলপথের মাধ্যমে চিনের ইউনান, কোয়াংসি, কোয়াং টুং প্রড়া অঞ্চলের খনিজ সম্পদকে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বন্দর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সুযোগ তৈরি হয়। অর্থনীতির সাংবাদিক মার্টিন জ্যাক (Martin Jacque তাঁর 'হোয়েন চায়না বুস্ দ্য ওয়ার্ল্ড' গ্রন্থে বলেছেন যে, "অষ্টাদশ শতকে চিন এবং ইংল্যান্ডের জীবন প্রায় একরকম ছিল। কিন্তু নিউ ক্যাল্ খনি কয়লাপ্রাপ্তি, সমুদ্র বাণিজ্যই তফাত গড়ে দিয়েছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তখ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ তৈরি কা সেখানকার জমি, কৃষিজ ও খনিজ সম্পদ দখল করেছিল।"
উপসংহার: চিনের খনিজ সম্পদ দীর্ঘকাল ধরে বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকলে এর বিরুদ্ধে চিনে ক্ষোভ দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে মাদ শাসকগণ বিদেশি বণিকদের বাণিজ্যের লাইসেন্স প্রদান সংকুচিত কে চিনের নতুন খনি থেকে সম্পদ উত্তোলনে বিদেশিদের দাবি প্রত্যাখ্যান কার হয়। অবশ্য কিছু কিছু প্রত্যন্ত ও পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলে খনিজ সম্প উত্তোলনে চিনে সম্রাট অনুমতি দেন। চিনের খনিজ সম্পদ বিদেশে রপ্তানি বিরুদ্ধে বিংশ শতকের শুরুতে ক্ষোভ তীব্রতর হয়। ফলে চিনের খনিজ সম্পদে বিদেশি শোষণ কমতে থাকে।
5. রায়তওয়ারি ও মহলওয়ারি বন্দোবস্ত সম্পর্কে যা জান লেখো ।
উত্তর: রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত :
1. পরিচিতি: অষ্টাদশ শতকের শেষে কোম্পানি মাদ্রাজ প্রেসিলে বাদে দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য জায়গায় স্যার টমাস মনরোর নেতৃত্বে এ বোম্বাই প্রদেশে লিফিনস্টোনের নেতৃত্বে এক ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবচ করে (১৮২০ খ্রি.), যা রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত নামে পরিচিতি লাভ করে।
2. পটভূমি: দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় চিরস্থায়ী বন্দোঝ প্রবর্তনে কিছু অসুবিধা থাকায় এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। যথা-[1] দক্ষি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারশ্রেণির অস্তিত্ব ততটা ব্যাপক ছিলন [ii] বিক্ষিপ্তভাবে কিছু জমিদারের অস্তিত্ব থাকলেও তারা ব্রিটিশবিরে ভূমিকা নিয়েছিল।
3. শর্তাবলি: রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শ অনুসারে-[i] নির্দিষ্ট রাজস্বের বিনিময়ে প্রতিটি কৃষকের সঙ্গে সরকারে সরাসরি জমি বন্দোবস্ত করা হয় এবং কৃষকরা জমির ভোগদখলি স্বত্ব লা করে। [ii] ২০-৩২ বছর অন্তর আলোচনার মাধ্যমে ভূমিরাজস্বের পরিম বাড়ানো হবে বলে ঠিক হয়। [iii] মোট উৎপাদিত ফসলের শতকরা ৪৫-৫৫ ভাগ রাজস্ব রূপে নির্ধারিত হয়। [iv] জমি জরিপের মাধ্যমে এবং উৎপাদনের মাপকাঠিতে জমিকে ৯ ভাগে ভাগ করা হয়। [v] কৃষকদের জমি ভোগ করার স্বত্ব থাকলেও জমির মালিকানা স্বত্ব ছিল না। [vi] বন্যা বা খরার জন্য শস্যহানি হলেও প্রজারা খাজনা দিতে বাধ্য থাকত।
4. ফলাফল:
i) সুফল: [a] এই বন্দোবস্তে সরকারের সঙ্গে রায়তদের সরাসরি সম্পর্ক গড়ে ওঠায় প্রশাসনিক জটিলতা হ্রাস পায় ও জমি সংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে। [b] এই ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীর কোনো অস্তিত্ব না থাকায় কৃষকরা অন্যায় জোরজুলুম ও অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়। [c] জমিদাররা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত না। ফলে কৃষকরা জীবিকার জন্য জমির ওপর নির্ভর করতে পারত। [d] এই বন্দোবস্তে বেশিরভাগ রায়তেরই ভূমিদাস রাখার ক্ষমতা না থাকায় ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটে।
ii) কুফল: [a] কৃষকরা সরাসরি কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে শোষিত ও অত্যাচারিত হত। [b] এই ব্যবস্থাতে জমির ওপর কৃষকের মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় কোম্পানি ভাড়াটে হিসেবে কৃষক প্রজাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত। [c] এই বন্দোবস্তে খাজনার হার অত্যন্ত বেশি হওয়ায় কোম্পানিকে খাজনা দেওয়ার পর কৃষকের হাতে অবশিষ্ট যা থাকত তা দিয়ে সারাবছর জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন ছিল। [d] বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্যহানি ঘটলেও রায়তদের খাজনা দিতে হত। ফলে তারা জমিরক্ষার তাগিদে সাউকার ও মহাজনদের কাছে ঋণ নিয়ে দেনায় আকণ্ঠ ডুবে থাকত।
মহলওয়ারি বন্দোবস্ত :
1. পরিচিতি: জমিদারি বন্দোবস্তেরই এক পরিবর্তিত রূপ ছিল মহলওয়ারি বন্দোবস্ত। সরাসরি কৃষক বা জমিদার নয়, একটি গ্রাম ও মহলের সঙ্গে এই বন্দোবস্ত গড়ে ওঠে বলে এর নাম মহলওয়ারি বন্দোবস্ত। গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে এই মহলওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয় (১৮২২ খ্রি.)। ড. রমেশচন্দ্র দত্তের মতে-এই ব্যবস্থায় ধন-সঞ্চয় বা মানুষের আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব ছিল না।
2. পটভূমি: বিশেষ কমিশনার মি. এইচ. জি. টাক প্রমুখ, চিরস্থায়ী বিকল্প ব্যবস্থার সুপারিশ পেশ করেন। ইংল্যান্ডের পরিচালক সভা ওই সুপারিশ মেনে চিরস্থায়ীর পরিবর্তিত ভূমিরাজস্ব প্রবর্তনের মত দেয়। অবশেষে পরিচালক সভার সম্পাদক হোল্ট ম্যাকিস্তি মহলভিত্তিক ভূমি বন্দোবস্তের সঙ্গে রায়তওয়ারি ব্যবস্থার বেশ কিছু নীতির সংমিশ্রণ ঘটান। এরপর কোম্পানি সপ্তম আইন জারির মাধ্যমে (১৮২২ খ্রি.) এই ব্যবস্থার প্রচলন ঘটায়।
3. শর্তাবলি: [i] জমি জরিপ করে প্রতিটি মহল বা গ্রামের ওপর রাজস্ব নির্ধারিত হয়। [ii] গ্রামের ওপর ধার্য রাজস্ব গ্রামবাসীদের মিলিতভাবে দিতে হত। [iii] গ্রামবাসীরা তাদের নির্দিষ্ট রাজস্ব গ্রাম প্রধানের মারফত সরকারের ঘরে জমা করত। [iv] জমির উৎপাদিকা শক্তির হার অনুসারে ভূমিরাজস্বের হার নির্ধারিত হত। [v] রায়ত ও সরকারের মধ্যে কোনো মধ্যস্বত্বভোগীর অবস্থান ছিল না। [vi] প্রতিটি মহল বা মৌজার সঙ্গে ২০-৩০ বছরের জন্য ভূমি বন্দোবস্ত করা হয়।
4. উদ্দেশ্য: [i] এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সরকার চেয়েছিল ভবিষ্যতে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে। [II] কোম্পানি এই ব্যবস্থার মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিলুপ্তি চেয়েছিল।
5. ত্রুটি: [i] এই জমি বন্দোবস্তে জমির ওপর কৃষকদের কোনো মালিকানা ছিল না। [ii] অত্যধিক রাজস্বের হার দিতে গিয়ে কৃষক পরিবারগুলির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় ও দুঃখদুর্দশা বাড়ে। [iii] মধ্যস্বত্বভোগীর জায়গায় গ্রামপ্রধানরা স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল। [iv] গ্রাম বা মহলের যেসব কৃষক সঠিক সময়ে রাজস্ব মেটাতে ব্যর্থ হত তাদের সেই বকেয়া রাজস্ব গ্রামের অন্যান্যদের মেটাতে হত, না হলে গ্রামের জমি হাতছাড়া হয়ে যেত।
উপসংহার: মহলওয়ারি ব্যবস্থাকে লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে আরও ঢেলে সাজানো হয়েছিল। বেন্টিঙ্ক নবম রেগুলেশন জারি করে (১৮৩৩ খ্রি.) এই ব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করেন এবং নতুন গড়ে ওঠা এই ব্যবস্থা কার্যকর করার দায়িত্ব দেন রবার্ট কর্ডিকে।
6. বক্সারের যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করো। অথবা, বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল লেখো।
উত্তর: বক্সারের যুদ্ধের কারণ :
1. মিরকাশিমের স্বাধীনচেতা মনোভাব: মিরকাশিম আলি খান পূর্ব ভারতে এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। এই লক্ষ্যপূরণের জন্য তিনি আর্থিক ও সামরিক বিভাগকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। এ ছাড়াও ইংরেজদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনার লক্ষ্যে তিনি মুরশিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে (বিহারে) রাজধানী স্থানান্তর করেন। তাঁর এই উদ্যোগ ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি করে।
2. আর্থিক পদক্ষেপ: একজন স্বাধীন নবাবের মতোই মিরকাশিম আর্থিক সংস্কারের দ্বারা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। তিনি-[i] জমিদারদের ওপর কয়েকটি বাড়তি কর চাপান ও ভূমিরাজস্বের হার দেড় আনা বাড়ান। [ii] ইংরেজদের প্রতি অনুগত রয়েছেন-এমন কর্মচারী ও জমিদারদেরও তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। ইংরেজ মদতপুষ্ট বিহারের নায়েব দেওয়ান নবাবের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ ও হিসাবপত্র দাখিলের আদেশ অগ্রাহ্য করলে তিনি রামনারায়ণকে হত্যা করেন। [iii] রাজস্ব আত্মসাৎকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন ও কঠোর শাস্তি দেন। [iv] আলিবর্দি ও মিরজাফরের পরিবারবর্গের কাছ থেকে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও সঞ্চিত অর্থ জোর করে আদায় করেন।
3. সামরিক উদ্যোগ: মিরকাশিম এক প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন। ইউরোপীয় রণকৌশল গ্রহণের পাশাপাশি তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আফগান, তাতার পারসিক এবং আর্মেনীয়দের সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত করেন। আর্মেনীয় গ্রেগরি (গুরগিন খাঁ)- কে তিনি তাঁর প্রধান সেনাপতি ও ওলন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন। ফরাসি সমবু (ওয়াল্টার রাইন হাউন্ড)-কে ও আর্মেনীয় মার্কারকে তিনি অন্য সমর বিভাগের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। এ ছাড়াও আর্মেনীয় কারিগরদের সাহায্য নিয়ে তিনি মুঙ্গেরে কামান ও বন্দুক তৈরির এক অস্ত্রকারখানা নির্মাণ করেন। মিরকাশিমের এই সামরিক উদ্যোগ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে।
4. শুক্ল বিবাদ: কোম্পানির কর্মচারীরা যথেচ্ছভাবে ব্যক্তিগত বাণিজ্য দস্তক বা শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নিতে শুরু করে। পরিণামে দেশীয় বণিকগোষ্ঠীর বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নবাবও তাঁর প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হন। মিরকাশিম এই সংকটমোচনের জন্য ভ্যান্সিটার্ট-এর কাছে এক আবেদন জানান। কিন্তু তাতেও সংকটের নিরসন না হওয়ায় মিরকাশিম দেশীয় বণিকদের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেন। ফলে কোম্পানিকে দেশীয় বণিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যের মুখোমুখি হতে হয়। এতে ইংরেজদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে ও তারা মিরকাশিমকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়। ফলে ইংরেজ ও কোম্পানি, উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। সংঘটিত হয় বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪ খ্রি. ২২ অক্টোবর)। মিরকাশিমের সেনাপতি মার্কার ও ইংরেজ সেনাপতি মেজর হেক্টর মনরোর কাছে পরাজিত (১৭৬৪ খ্রি. ২২ অক্টোবর) হলে, ব্রিটিশ শক্তি সুদৃঢ় হয়।
ফলাফল ও গুরুত্ব :
1. ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ হিসেবে: বক্সারের যুদ্ধ ছিল ভারতের ইতিহাসে এক ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলাফল যদি ইংরেজদের প্রতিকূলে যেত তাহলে ভারতের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হত।
2. ঔপনিবেশিক শাসনের দৃঢ়তায়: পলাশির যুদ্ধে জিতে কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছিল। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে জিতে কোম্পানি ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনকে দঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।
3. বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়: বক্সারের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীনচেতা নবাব মিরকাশিমের পরাজয় ঘটায় ব্রিটিশ শক্তিকে বাধা দেওয়ার মতো আর কোনো শাসক রইল না, ফলে বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ নিস্কণ্টক হল।
4. উত্তর ভারতে আধিপত্য সূচনায়: বক্সারের যুদ্ধে জিতে কোম্পানি বাংলার আধিপত্যকে দৃঢ় করে উত্তর ভারতের দিকে নজর দেয়। অযোধ্যায় নবাব সুজা-উদ্দৌলা কোম্পানির অনুগত হন এবং নামসর্বস্ব মোগল বাদশা কোম্পানির দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে কোম্পানির আধিপত্যের সূচনা ঘটে।
5. আর্থিক লুষ্ঠনের সূচনায়: বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলার বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় কোম্পানির অবাধ অর্থনৈতিক লুণ্ঠন শুরু হয়। কোম্পানির উচ্চপদস্থ আমলারা নতুন নবাব নজম-উদ্দৌলার কাছ থেকে পনেরো লক্ষ টাকা উপঢৌকন হিসেবে আদায় করে। এর পাশাপাশি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ্দৌলার কাছ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়।
6. দেওয়ানি লাভের ক্ষেত্রে: বক্সারের যুদ্ধে চরম প্রাপ্তি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও ওড়িশায় দেওয়ানি লাভ করেছিল। দেওয়ানি লাভের ফলে একদিকে বাংলার রাজনীতিতে কোম্পানির কর্তৃত্ব দৃঢ় হয়েছিল অপরদিকে কোম্পানির আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বহুগুণ বেড়েছিল।
উপসংহার: বক্সারের যুদ্ধের পরেই বণিকের মানদণ্ড শাসকের রাজদণ্ডরূপে দেখা দিয়েছিল। বক্সারের যুদ্ধে জেতার পর থেকেই ভারতের ইতিহাসে প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়।
7. ব্রিটিশ শাসনকালে দেশীয় উদ্যোগে শিল্পের বিকাশের বিবরণ দাও।
উত্তর: দেশীয় পুঁজিতে শিল্পের বিকাশ :
1. বস্ত্র শিল্প
i) শিল্পোদ্যোগের কারণ: বস্ত্র শিল্পে দেশীয় উদ্যোগের উল্লেখযোগ কারণগুলো নিম্নরূপ-[a] ভৌগোলিক সুবিধা নিয়ে বোম্বাই ও গুজরাটের পারসি এবং মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা তাদের মূলধন বিনিয়োগ করার জন্য বস্ত্র শিল্পকেই সবার আগে বেছে নেয়া [b] গুজরাট ও বোম্বাই অঞ্চলে প্রথম রেলপথের সূচনার সুবিধাকে কাজে লাগায় দেশীয় বস্ত্র শিল্পপতিরা। [c] বস্ত্র শিল্পের প্রয়োজনীয় বিন্ন কাঁচামাল তুলোর চাষ দক্ষিণ ভারতে বেশি হওয়ায় দেশীয় শিল্পপতিরা বস্ত্র শিল্পে মূলধন বিনিয়োগে উৎসাহী হয়ে ওঠে। [d] পারসি বস্ত্র ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই আফ্রিকা ও চিনের সঙ্গে তুলোর ব্যাবসা গড়ে তুলেছিল বলে তারা সেই অভিজ্ঞতা ভারতের বস্ত্রশিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাজে লাগায়।
ii) শিল্প স্থাপন: [a] ভারতীয় উদ্যোগে বোম্বাইয়ে প্রথম ভারতের বৃহত্তম বস্ত্রশিল্প 'বোম্বে স্পিনিং অ্যান্ড উইভিং কোম্পানি' স্থাপন করেন ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে। পারসি শিল্পপতি কাউয়াসজি নানাভাই দাভর। [b] রণছোড়লাল ছেপটলাল নামে এক গুজরাতি ব্রাহ্মণ খ্রি আমেদাবাদে একটি কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৫৯ খ্রি.)। প্র [c] পারসি শিল্পপতি জামশেদজি টাটার উদ্যোগে নাগপুরে স্থাপিত (শ হয় 'এম্প্রেস মিল' (১৮৭৭ খ্রি.)।
iii) শিল্পের প্রসার: ভারতীয় উদ্যোগে কাপড়ের কলের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে 'বয়কট' ও 'স্বদেশি' আন্দোলনের প্রভাবে দেশে সুতিবস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে এই শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। দেখা গেছে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে যেখানে কাপড়ের কলের মোট সংখ্যা ছিল ৫৮টি, সেখানে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ২০৬টিতে। ওই কলগুলিতে প্রায় দুই লক্ষ শ্রমিক কাজ করত।
2. পাট শিল্প: ভারতীয় উদ্যোগে পাট শিল্পে প্রথম (১৯২১ খ্রি.) অর্থ বিনিয়োগ করেন মাড়োয়ারি শিল্পপতি বিড়লা, এরপর বিনিয়োগ করেন স্বরূপচাঁদ হুকুমচাঁদ (১৯২২ খ্রি.)। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারত থেকে আনুমানিক ২ কোটি ৫ লক্ষ টাকার পাটজাত দ্রব্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।
3. চা শিল্প: চা শিল্পেও ভারতীয় পুঁজির বিনিয়োগ শুরু হয়। আসাম টি কোম্পানিতে পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ বিনিয়োগের পাশাপাশি ভারতীয় পুঁজিরও বিনিয়োগ শুরু হয়। সম্পূর্ণ দেশীয় উদ্যোগে জয়চাঁদ সান্যাল জলপাইগুড়ি টি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে (১৮৭৮ খ্রি.)। এর পাশাপাশি মোতিলাল শীল, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মির্জা ইস্পাহানি প্রমুখ চা শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করেন।
4. কয়লা শিল্প: কয়লা শিল্পে দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। তাঁর এই উদ্যোগের পরেই রানিগঞ্জ, আসানসোল, বরাকর, সীতারামপুর প্রভৃতি অঞ্চলে দেশীয় উদ্যোগে কয়লাখনিতে পুঁজি বিনিয়োগ শুরু হয়। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, দেশীয় উদ্যোগে বর্ধমানের রানিগঞ্জ, আসানসোল, বরাকর, অন্ডালসহ বিভিন্ন স্থানে ৪০টি এবং মানভূম, ছোটোনাগপুর জেলায় ৬২টি ছোটো কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। দেশীয় মালিকানাধীন এইসব কয়লাখনি নিয়ে ইন্ডিয়ান মাইনিং ফেডারেশন গঠিত হয়।
5. লৌহ-ইস্পাত শিল্প: বাঙালি শিল্পপতি কিশোরীলাল মুখোপাধ্যায় ও রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও অবাঙালি নওয়াল কিশোর, পারসি শিল্পপতি জামশেদজি টাটা ভারতে লৌহ-ইস্পাত শিল্প বিকাশের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে কিশোরীলাল মুখোপাধ্যায় ছোটো ছোটো যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য হাওড়ার শিবপুরে একটি লৌহ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাঙালি প্রযুক্তিবিদ রাজেন্দ্রনাথ ও ইংরেজ প্রযুক্তিবিদ মার্টিন যৌথভাবে মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি (১৮৯২ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করে হাওড়া- আমতা রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এই সময় লক্ষ্ণৌতে জামশেদজি টাটার উদ্যোগে ও বাঙালি প্রযুক্তিবিদ প্রমথনাথের সহযোগিতায় ১৯০৭ খ্রি. বিহারের জামশেদপুরে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। জামশেদজি টাটার দুই পুত্র দোরাবজি এবং রতনজি পিতার তৈরি করা টাটা কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন করিয়ে লৌহ-ইস্পাত শিল্পের ক্ষেত্রে নিজেদের কোম্পানিকে একচেটিয়া কর্তৃত্বের অধিকারী করে তোলেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এখানে উন্নতমানের লৌহপিণ্ড এবং ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশুদ্ধ ইস্পাত-পিণ্ড উৎপাদন শুরু হলে ভারতে লৌহ-ইস্পাত শিল্পে যুগান্তর আসে।
6. ইঞ্জিনিয়ারিং ও রাসায়নিক শিল্প: ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার মার্টিনের সঙ্গে একযোগে বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি। এই কোম্পানির প্রচেষ্টাতেই প্রথম হাওড়া থেকে আমতা রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে (১৮৯৭ খ্রি.)। এ ছাড়াও হাওড়া থেকে শিয়াখালা লাইট রেলপথ (১৮৯৮ খ্রি.) গড়ে তোলে এই কোম্পানি। মাদ্রাজে চিদাম্বরম পিল্লাই একটি জাহাজ নির্মান কারখানা গড়ে তোলেন (১৯১১ খ্রি.)। রাসায়নিক শিল্পের ক্ষেত্রে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস। এ ছাড়াও ড. নীলরতন সরকার জাতীয় সাবান কারখানা গড়ে তোলেন।
উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনকালে দেশীয় উদ্যোগে শিল্পের প্রসার জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তিকে অনেকটাই দৃঢ় করেছিল।
8. দ্বৈত শাসন কী? এর গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তর:
9. ডালহৌসির রেলপথ বিস্তার নীতি আলোচনা করো।
অথবা, ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে রেলপথ বিস্তার ২ আলোচনা করো।
উত্তর:
10. ব্রিটিশ আমলে ভারতে ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের উদ্যো শিল্পের অগ্রগতির কারণ কী ছিল? ভারতীয় মালিকানায় এদে শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা ছিল?
উত্তর: ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের উদ্যোগে ভারতে শিল্পের অগ্রগতি :
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে ইউরোপীয়দের উদ্যোগে সর্বপ্রথম শিশু বিকাশ শুরু হয়। মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭ খ্রি.) পর থেকে ভারতে শিল্পায় অগ্রগতি শুরু হয়।
1. সস্তা কাঁচামাল: যে-কোনো দেশে শিল্পের বিকাশের জন্য সস্তায় পর্যাপ্ত পরিমাণে শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সরবরাহ থাকা দরকা ভারত ছিল মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। এখানে শিল্পের প্রয়োজনীয় তুলো, প চা, আখ প্রভৃতি কৃষিপণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হত। এসব কাঁচামা সস্তায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়ার ফলে বিদেশি পুঁজিপতিরা ভারতে স্থাপনে খুবই আগ্রহী ছিল।
2. সুলভ শ্রমিক: শিল্পে প্রতিযোগিতার বাজারে উৎপাদন ব্যয় কমা খুব প্রয়োজন। ভারতে খুব অল্প মজুরিতে শিল্পের কাজে নিয়োগ করার মা প্রচুর শ্রমিক পাওয়া যেত। ফলে এদেশে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কম হত।।
3. পুঁজির জোগান: শিল্প স্থাপনের জন্য প্রচুর মূলধনের জোগ প্রয়োজন। ভারতে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ শিল্পপতিরা সহজ সুদে। পেত। ভারতীয়রা এরূপ সুবিধা পেত না।
4. পণ্যের চাহিদা: ভারতে ইউরোপীয়দের শিল্প-কারখানায় উৎপাদি শিল্পপণ্যের চাহিদা ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে যথেষ্টই ছিল শিল্পপতিদের শিল্প প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করেছিল।
5. বিপুল লাভের আশা: ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা উপলব্ধি করেছিলেন। ইংল্যান্ডের তুলনায় ভারতে শিল্প স্থাপনে পুঁজি বিনিয়োগ তাদের পক্ষে লাভজনক ও নিরাপদ।
6. সহায়তা: ব্রিটিশ শিল্পপতিরা ভারতে শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরি ধরনের সহায়তা পেয়েছিল। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল ব্রিটেন যে যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম আমদানি, বিদেশি বিমা কোম্পানি ও সরকা কর্মচারীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতি।
ভারতীয় মালিকানায় শিল্পোদ্যোগের সমস্যা :
ব্রিটিশ শিল্পপতি ও ভারতের ইংরেজ বণিকরা মনে করত যে, ভারতে দেশীয় উদ্যোগে আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটলে ভারতের বাজার ও কাঁচামাল তাদের হাতছাড়া হবে। এজন্য তারা নানা উপায়ে ভারতীয় উদ্যোগে এদেশে শিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত।
1. শুদ্ধ সমস্যা: ভারতের ব্রিটিশ সরকার ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা সুতিবস্ত্রের ওপর নামমাত্র শুল্ক আরোপ করলেও বিলাতে রপ্তানি করা ভারতীয় সুতিবস্ত্রের ওপর বিপুল পরিমাণ শুল্ক চাপিয়েছিল। ফলে ভারতীয় সুতিবস্ত্রের মূল্য অত্যন্ত বেড়ে যায় এবং প্রতিযোগিতায় পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
2. পরিবহণে বৈষম্য: রেলে পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের তুলনায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা রেলে পণ্য পরিবহণের সময় বেশি মাশুল দিতে বাধ্য হত। তথাপি উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে যে শিল্পোদ্যোগ শুরু হয়, তাতে ব্রিটিশ পুঁজির প্রাধান্য থাকলেও ভারতীয় পুঁজি একেবারে পিছিয়ে ছিল না।
3. সংরক্ষণ নীতির অভাব: ভারতীয়দের শিল্পোদ্যোগকে বিদেশি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারের উচিত ছিল শুল্ক সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করা। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এরূপ কোনো উদ্যোগ নিয়ে ভারতীয় মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পকে রক্ষার কোনো চেষ্টা করেনি। ফলে সস্তা বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতীয় শিল্পপতিদের শিল্পপণ্য পিছিয়ে পড়ে।
4. লাইসেন্স-এর সমস্যা: ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা শিল্প স্থাপনের জন্য সরকারের কাছ থেকে সহজেই লাইসেন্স পেয়ে যেত। কিন্তু সরকার ভারতীয় শিল্পগুলিকে লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে টালবাহনা করত।
5. মূলধনের অভাব: ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের মতো বিপুল পরিমাণ বে মূলধন বিনিয়োগ করে এদেশে শিল্প স্থাপনের সামর্থ্য অধিকাংশ ভারতীয় পুঁজিপতিদের ছিল না। তাদের অধিকাংশেরই মূলধন ছিল সীমিত।
6. ব্যাংক ঋণের সমস্যা: ভারতীয় শিল্পপতিরা শিল্প স্থাপনের জন্য ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পেত না। তাদের ঋণ দেওয়া হলেও সুদের হার ছিল খুব বেশি।
7. বিনিয়োগে অনীহা: ভারতীয় পুঁজিপতিদের বেশিরভাগই শিল্প স্থাপনের জন্য খুব বেশি পুঁজি বিনিয়োগে অনীহা দেখাত। তারা শিল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পেত না।
11. ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের সদর্থক প্রভাবগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের সুফলগুলি উল্লেখ করো।
অথবা, ভারতে রেলপথ স্থাপনে এদেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলেছিল?
উত্তর: রেলপথ স্থাপনের সুফল :
1. যোগাযোগের প্রসার: ভারতে রেলপথের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটে। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে প্রশাসনিক ঐক্য গড়ে ওঠে এবং সরকারি কাজে গতি বৃদ্ধি পায়।
2. পরিবহণের উন্নতি: রেলপথ স্থাপনের আগে ভারতের পরিবহণ ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত ছিল। রেলপথ স্থাপনের পর এর মাধ্যমে ভারতের মানুষ ও পণ্য পরিবহণে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। অতি দ্রুত মানুষ ও পণ্য চলাচল সম্ভব হওয়ায় দুর্ভিক্ষ ও খরার সময় দূরদূরান্তে খাদ্য পাঠানো সহজ হয়।
3. আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি: রেলপথের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজারগুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হলে তাদের মধ্যে পণ্য চলাচল সম্ভব হয়। ফলে পণ্যমূল্যের আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস পায় এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
4. রপ্তানি বৃদ্ধি: রেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহণের ব্যয় খুব কম হত। ফলে ভারতের বিভিন্ন কৃষিপণ্য রেলের মাধ্যমে সহজে বন্দরে নিয়ে যাওয়া যেত। বন্দরগুলি থেকে ভারতের পণ্যসামগ্রী সহজে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বাজারে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। ১৮৬২ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারত থেকে রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় ২১/২ গুণ বৃদ্ধি পায়।
5. আমদানি বৃদ্ধি: রেলের মাধ্যমে ভারতে বিদেশি পণ্যের আমদানি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বিলাতের বিভিন্ন শিল্পপণ্য ও বিলাস-সামগ্রী ভারতের বন্দরে এসে তা রেলের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে যায়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে আমদানির পরিমাণ
৩ গুণ বৃদ্ধি পায়।
6. আন্তর্জাতিক বাজার: আগে আঞ্চলিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে ভারতে কৃষি-উৎপাদন চলত। রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতের কৃষিপণ্য রেলের মাধ্যমে বন্দরে পৌঁছে সহজেই আন্তর্জাতিক বাজারে যাওয়ার সুযোগ পায়। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি মূল্য পাওয়া যায় এমন কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
7. শিল্পায়ন: কার্ল মার্কস বলেছেন যে, রেল ব্যবস্থা ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের প্রকৃত অগ্রদূত হবে। বাস্তবক্ষেত্রেও রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতে শিল্পের বিকাশের পটভূমি তৈরি হয়। রেল ব্যবস্থা স্বল্পব্যয়ে কাঁচামালের জোগান দিয়ে এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারে পৌঁছে দিয়ে লোহা, ইস্পাত, কয়লা প্রভৃতি আধুনিক শিল্পের বিকাশে সাহায্য করে।
৪. কর্মসংস্থান: ভারতে রেলপথ স্থাপনের ফলে রেলপথ নির্মাণ, রেল কারখানা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। দেশের ভূমিহীন কৃষকরা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে রেলের কাজে নিযুক্ত হয়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রেলে নিযুক্ত মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লক্ষ ৭৩ হাজার।
9. জাতীয় ঐক্য: রেলপথের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায় এবং ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার: ভারতে রেলপথের প্রসারের বিভিন্ন সদর্থক প্রভাব বা সুফল থাকলেও ব্রিটিশ সরকার নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই যে এদেশে রেলপথ স্থাপন করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। তবে সার্বিক বিচারে রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতীয়রা উপকৃতই হয়। রেলপথ প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন কুপ্রভাবও লক্ষ করা যায়। মার্কিন ঐতিহাসিক বুকানন বলেছেন যে, "স্বনির্ভরতার যে বর্ম ভারতের গ্রামগুলিকে এতদিন রক্ষা করে এসেছিল, ইস্পাতের রেল সেই বর্ম ভেদ করে গ্রাম-জীবনের রক্ত শোষণ শুরু করে দেয়।"
12. 'অব-শিল্পায়ন' বলতে কী বোঝ? ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে অব-শিল্পায়নের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: অব-শিল্পায়ন :
ভারতে ইংরেজদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে বাংলা তথা ভারতে কুটিরশিল্প যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ সরকার ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখল করার পর দীর্ঘদিন ধরে ভারতে শিল্পায়ন-বিরোধী বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে। তারা ইংল্যান্ডের শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত সামগ্রীর দ্বারা ভারতের বাজারগুলি ছেয়ে দেয় এবং ভারতকে একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করে। এর ফলে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভারতের চিরাচরিত সমৃদ্ধ কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনা 'অব-শিল্পায়ন' (De-industrialisation) নামে পরিচিত।
অব-শিল্পায়নের ফলাফল :
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ব্রিটিশরা এদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনে সমর্থ হয়।
1. বেকারত্ব: দেশীয় কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে ভারতের বিপুল সংখ্যক হস্তশিল্পী ও কারিগর কাজ হারায়। নরেন্দ্রকৃয় সিংহের মতে, শুধু বাংলাতেই ১০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছিল। কর্মচ্যুত হওয়ার ফলে দেশে তীব্র বেকার সমস্যা দেখা দেয়। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে, "যদি দেশের মানুষ শিল্পকর্ম ছেড়ে চাষ-আবাদে জীবিকা অর্জন শুরু করে অথবা জাতীয় আয়ে কৃষিজ অংশ বাড়তে থাকে ও শিল্পজ অংশ কমতে থাকে, তবে তাকে অব-শিল্পায়ন বলে।"
2. কৃষির ওপর চাপ: অব-শিল্পায়নের ফলে জমির অনুপাতে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহে চাপ বাড়ে। দেশে কৃষিজীবী ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
3. গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন: অব-শিল্পায়ন ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন সৃষ্টি করে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলির দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেলে সেখানে অর্থনৈতিক সমস্যা তীব্রতর হয়। অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ে। গ্রামে কৃষি মরসুম ছাড়া অন্য সময় মানুষের কাজ না থাকায় সার্বিকভাবে মানুষের গড় আয় যথেষ্ট কমে যায়।
4. নগরজীবনের অবক্ষয়: অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ শহরগুলির অবক্ষয় শুরু হয়। অষ্টাদশ শতকে ঢাকা, মুরশিদাবাদ, সুরাট, মসুলিপট্টম, তাঞ্জোর প্রভৃতি নগর ক্রমে জনবিরল হতে থাকে এবং নগরের অবক্ষয় শুরু হয়।
5. কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ: অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতবর্ষ একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। এখানকার কাঁচামাল সস্তায় ক্রয় করে ইংরেজ বণিকরা ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে থাকে। ভারতের কাঁচা তুলো, কাঁচা রেশম, নীল, চা প্রভৃতি কাঁচামাল নিয়মিত বিলাতের কারখানাগুলিতে চলে যেতে থাকে। এর ফলে ইংল্যান্ডের শিল্পায়নে গতি আসে।
6. বিলাতি পণ্য আমদানি: দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের ফলে ভারত একটি রপ্তানিকারক থেকে আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়। বিলাতের ম্যাঞ্চেস্টার, ল্যাঙ্কাশায়ার ও অন্যান্য স্থানের শিল্পজাত পণ্য ভারতে আমদানি শুরু হয়। কেবল সুতিবস্ত্র নয়, রেশম ও পশমজাত দ্রব্য, লোহা, মৃৎশিল্প, কাচ, অস্ত্রশস্ত্র, ঢাল-তলোয়ার, খোদাই ও কারুকার্যের সঙ্গে জড়িত শিল্প প্রভৃতির যথেচ্ছ আমদানির ফলে দেশীয় শিল্পগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
7. দারিদ্র্য বৃদ্ধি: অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতের অর্থনীতি ধ্বংস হয় এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ভারতীয় জনজীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
ড. বিপান চন্দ্রের মতে, ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যনীতি ব্রিটিশ শিল্প ও শিল্পপতিদের স্বার্থেই পরিচালিত হয়েছিল। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীকে জীবনধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্য ব্রিটেনের মুখাপেক্ষী করে রাখা এবং ভারত থেকে ব্রিটিশ পণ্যের জন্য কাঁচামাল আহরণ। মার্কিন গবেষক মরিস ডেভিড মরিস মনে করেন যে, অবশিল্পায়নের ধারণা জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের প্রচারিত এক 'অলীক কল্পনা' বা মিথ। কিন্তু ড. বিপান চন্দ্র, ড. সব্যসাচী ভট্টাচার্য, ড. অমিয় বাগচি, ড. তপন রায়চৌধুরী প্রমুখ অব-শিল্পায়নকে একটি বাস্তব ঘটনা বলে মনে করেন।
13. লর্ড কর্নওয়ালিশ কি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত উদ্ভাবক ছিলেন? মহলওয়ারি বন্দোবস্তের শর্তাবলি ও ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি উল্লেখ করো।
উত্তর: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত উদ্ভাবক
লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করলেও তিনি এই বন্দোবস্তের প্রকৃত উদ্ভাবক ছিলেন না। কর্নওয়ালিশ এই বন্দোবস্ত চালু করার পূর্বেই এই ব্যবস্থার পক্ষে বিভিন্ন মতামত প্রকাশিত হয়েছিল, যেমন- [1] কোম্পানির কর্মচারী ও ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ডাও প্রথম ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা বলেন। [2] এরপর হেনরি পান্ডুলো, ড্যাক্রিস, টমাস ল প্রমুখ কর্মচারী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সপক্ষে যুক্তিি দেখান। [3] ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে তাঁর পরিষদের সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস কোম্পানির পরিচালক সভার কাছে এক স্মারকলিপি দ্বারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে সুপারিশ করেন। [4] ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে পিটের ভারত শাসন আইনেও চিরস্থায়ী ব্যবস্থার পক্ষে মত প্রকাশ করা হয়। সুতরাং কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত উদ্ভাবক ছিলেন না। তাই ড. নরেন্দ্রকৃয় সিংহ বলেন যে, "কর্নওয়ালিশকে 'সীমিত অর্থে' চিরস্থায়ী খ্রি বন্দোবস্তের প্রবর্তক বলা যায়।” লর্ড বেন্টিংকের আমলে মহলওল বন্দোবস্তকে আরও ঢেলে সাজানো হয়। তিনি এই ব্যবস্থার ২০ সম্প্রসারণ ঘটান এবং রবার্ট বার্ড-কে এই ব্যবস্থা যথাযথভাবে ক করার দায়িত্ব দেন।
মহলওয়ারি বন্দোবস্তের শর্তাবলি
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বৃহদংশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা হ উত্তর ভারত ও অন্যান্য স্থানের কিছু কিছু স্থানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার বিষয়ে কোম্পানির কর্তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে গাঙ্গেয় উপত্যকা, উজ্জ পশ্চিম প্রদেশ ও মধ্য ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে মহলওয়ারি ব্যবস্থা২৯ এক ধরনের ভূমি বন্দোবস্ত চালু করে। এই ব্যবস্থার প্রবর্ত এলফিনস্টোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই ব্যবস্থার প্রধান শর্তণ ছিল-
1. বন্দোবস্ত: মহলওয়ারি ব্যবস্থায় কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি মরে বা 'তালুক' তৈরি হত এবং গ্রামের ওপর সামগ্রিকভাবে রাজস্ব নির্ধারণ ক হত। ২০ থেকে ৩০ বছরের জন্য জমির বন্দোবস্ত দেওয়া হত।
2. ইজারা প্রদান: সরকাবন্ধুত্বকে রাজস্ব দেওয়ার শর্তে কোটা একজন ব্যক্তি বা কয়েকজন ব্যক্তিকে যৌথভাবে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল হ মহল (Mahal)-এর ইজারা দেওয়া হত। ইজারা প্রাপক গ্রামের মোড়লর প্রধান রাজস্ব আদায় করে সরকারের কাছে জমা দিত।
3. রাজস্বের হার: জমির উৎপাদিকা শক্তি অনুসারে রাজস্বের হা নির্ধারিত হত। সরকার সমগ্র গ্রামের ওপর যে রাজস্ব ধার্য করত তা প্রদানে দায়িত্ব গ্রামবাসীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত। এই ব্যবস্থায় আদায় কর রাজস্বের ৮০ শতাংশ সরকার এবং ২০ শতাংশ ইজারাদারের প্রাপ্য ছিল।
4. মধ্যস্বত্বভোগীর অনুপস্থিতি: মহলওয়ারি ব্যবস্থায় কৃষক। সরকারের মাঝখানে জমিদারের মতো কোনো শোষক মধ্যস্বত্বভোগীর অস্তিত্ব ছিল না। ফলে জমিদারদের শোষণের কোনো সুযোগ ছিল না।
মহলওয়ারি বন্দোবস্তের ত্রুটিবিচ্যুতি : মহলওয়ারি ব্যবস্থায়ও কিছু ত্রুটি ছিল, যেমন-
1. উৎখাতের আশঙ্কা: মহলওয়ারি ব্যবস্থায় কৃষক নয়, সরকার দি জমির প্রকৃত মালিক। ফলে অধিকারহীন কৃষক জমি থেকে সর্বদা উৎখাত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগত।
2. শোষণ: এই ব্যবস্থায় কৃষকদের ওপর জমিদারের পরিবর্তে সরকারের প্রত্যক্ষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
3. বিপুল রাজস্ব: মহলওয়ারি ব্যবস্থায় রাজস্বের হার যথেষ্ট বেশ ছিল। তা সত্ত্বেও কৃষকের রাজস্বের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ানো হত। ফলে কৃষকদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে।
4. অত্যধিক কঠোরতা: এই ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায়ে অত্যধিক কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। ফলে বহু কৃষক তাদের জমি হারিয়ে জীবিকাহন হয়ে পড়ে। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ১৮৩৯ থেকে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৯৫ হাজার জমির মালিকানা হস্তান্তরিত হয়।
14. পলাশির যুদ্ধের পরবর্তীকালে বাংলায় কীভাবে দ্বৈত শাম প্রশ্ন ব্যবস্থা (১৭৬৫-৭২ খ্রি.) চালু হয়? এই ব্যবস্থার ফলাফ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন
বাংলার নবাব মিরকাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ্দ্দ্দৌলা এক দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত বাহিনী বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪ খ্রি.) ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়। এরপর বাংলায় ইংরেজদের ধারাবাহিক অগ্রগতি শুরু হয়।
1. দেওয়ানি লাভ: ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলার নবাব নজম-উদ্দ্দৌলার সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর দ্বারা নবাবের সকল 'নিজামতি' বা প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা। কোম্পানির মনোনীত 'নায়েব-নাজিম'-এর হাতে চলে যায়। নবার কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন। ইংরেজ কোম্পানি পরাজিত মোগর সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধির (১৭৬৫ খ্রি দ্বারা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে।
2. নায়েব-নাজিম নিয়োগ: কোম্পানি বাংলায় মহম্মদ রেজা খাঁ-রে এবং বিহারে সিতাব রায়-কে নায়েব-নাজিম অর্থাৎ নায়েব-সুবা পদে নিযুর করে তাঁদের হাতে বাংলা ও বিহারের নিজামত ও দেওয়ানি বিভান্তে যাবতীয় দায়িত্ব প্রদান করে। তাঁরা আইনত নবাবের অধীনে হলেও বাস্তবে নবাব নয়, কোম্পানি তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করত। ফলে তাঁদের প্রধান কাজ ছিল কোম্পানির স্বার্থরক্ষা করা।
3. দ্বৈত শাসনের প্রচলন: নায়েব-নাজিমদের হাতে কোম্পানি নবাবের যাবতীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করলে কোম্পানির লোকজনই সর্বর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে আইনত নবাবের হাতে বাংলার প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব থাকলেও তাঁর হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ছিল না। আবার কোম্পানির হাতে প্রকৃত ক্ষমতা থাকলেও তারা প্রশাসন পরিচালনা ও প্রশাসনিক ব্যয় বহনের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। এভাবে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় নবাব ক্ষমতাহীন দায়িত্ব এবং কোম্পানি দায়িত্বহীন ক্ষমতা লাভ করে। বাংলায় নবাব ও কোম্পানির এই দ্বিমুখী শাসন ইতিহাসে 'দ্বৈত শাসন' (Diarchy) নামে পরিচিত।
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার গুরুত্ব বা ফলাফল
1. শোষণ: দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানি বাংলায় তীব্র আর্থিক শোল শুরু করে। দেওয়ানি লাভের আগে ১৭৬৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে। ১ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এক বছর পর দেওয়ানি লাভ করে কোম্পানি ১৭৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে রাজস্ব আদায় করে প্রায় দ্বিগুণ-২ কোটি ২০ লক্ষ। ফলে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে।
2. কৃষকদের উৎখাত: দেওয়নি লাভের পর ইংরেজরা সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানে প্রতিশ্রুতিদানকারী ইজারাদারকে জমি ইজারা দিতে শুরু করে। কোম্পানিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পরিশোধ করতে গিয়ে ইজারাদারও কৃষকদের ওপর রাজস্বের হার অত্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। এই রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
3. বাংলার রাজস্ব ব্যবহার: দেওয়ানি লাভের পর ইংল্যান্ড থেকে অর্থ পাঠানো বন্ধ হয় এবং বাংলার রাজস্বের অর্থ দিয়ে পণ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা হয়। এই পণ্য বিক্রির লাভের অর্থ বিলেতে চলে যেতে থাকে।
4. একচেটিয়া বাণিজ্য: কোম্পানি বাংলায় লবণ, সুপারি, তামাক ও অন্যান্য কয়েকটি পণ্যের ওপর কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পায়। এর ফলে দেশীয় বণিকরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রব্যমূল্যও অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
5. লুণ্ঠন: দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা বাংলায় অবাধ লুণ্ঠন শুরু করে। এ সম্পর্কে স্বয়ং ক্লাইভ বলেছেন যে, "আমি শুধু এটুকুই বলছি যে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত অরাজকতা, বিভ্রান্তি, ঘুষ, দুর্নীতি এবং উৎপীড়ন-শোষণের ঘটনা কেউ শোনেনি বা দেখেনি- যতটুকুর লীলাক্ষেত্র হয়েছিল এই বাংলাদেশ।"
6. দুর্নীতি: দ্বৈত শাসনের সময় কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যাপক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। কোম্পানির কর্মচারী বোল্টস্ লিখেছেন যে, কোম্পানির কর্মচারীদের নির্যাতন ও দুর্নীতিতে সাধারণ মানুষের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়েছিল।
7. বিশৃঙ্খলা: দ্বৈত শাসনের ফলে বাংলার সমাজ ও জনজীবনে প্রবল বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঐতিহাসিক জন কে বলেছেন যে, "দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে আরও বিশৃঙ্খল করে তোলে।"
15. ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করেন ও অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি মেনে নেন। এরপর মারাঠা শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
উত্তর: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রসারে ইঙ্গ-শিখ দ্বন্দ্ব
রণজিৎ সিংহের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক
i) সম্পর্কের সূচনা: রণজিৎ সিংহ শিখ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি ব্রিটিশের স সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলে শিখ শক্তির অগ্রগতিতে সা থাকেন এবং অমৃতসর দখল (১৮০২ খ্রি.) করার পর শতদ্রু নট পশ্চিমতীরের শিখ মিস্লগুলি একে একে দখল করেন। রণজিতে এই অগ্রগতিতে ভীত হয়ে ইংরেজশক্তি ইউসুফ আলিকে লাহো রণজিৎ সিংহের দরবারে পাঠিয়ে সম্মান জানান।
ii) সম্পর্কের অগ্রগতি
[a] মিন্টোর সময়কালে-অমৃতসরের সন্ধি: রণজিৎ সিংহ প্রথমে লুধিয়ানা দখল করেন। শিখশক্তির অগ্রগতিতে শঙ্কিত হয়ে গভ জেনারেল লর্ড মিন্টো রণজিৎ সিংহের সঙ্গে দৌত্য স্থাপনে আগ্র হয়ে ওঠেন। বড়োলাট মিন্টোর দূত হিসেবে চার্লস মেটকাফ লাহোরে রণড়ি সিংহের দরবারে আসেন ও রণজিৎ সিংহের সঙ্গে অমৃতসরের স (১৮০৯ খ্রি.) স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধির দ্বারা ইংরেজ বিনা যু শতদ্রু ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী শিখ রাজ্যগুলির ওপর আধিপয় স্থাপনে সক্ষম হয়।
[b ] ময়রার সময়কালে: অমৃতসরের সন্ধির পর রণজিৎ একে এ কাংড়া (১৮১১ খ্রি.), আর্কট (১৮১৩ খ্রি.), কোহিনুর (১৮১৪ খ্রি মুলতান (১৮১৮ খ্রি.), কাশ্মীর (১৮১৯ খ্রি.), পেশোয়ার (১৮৯ খ্রি.) দখল করে শিখ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
[c] আমহার্স্টের সময়কালে: আমহার্স্টের আমলে উভয়পছে কূটনৈতিক পর্যায়ে দূত আদানপ্রদান হয়। এসময়ে ইংরেজদের সঙ্গে রণজিতের নেতৃত্বে শিখ শক্তির সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।
[d] বেন্টিষ্কের সময়কালে: রণজিতের সাহায্যলাভের জন্য উইলিয়া বেন্টিঙ্ক নিজে লাহোরে আসেন। বেন্টিঙ্ক ও রণজিৎ সিংহের ময়ে স্বাক্ষরিত হয় চিরস্থায়ী মিত্রতা চুক্তি (১৮৩১ খ্রি.)।
[e] অকল্যান্ডের সময়কালে: ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের গভর্ন জেনারেল অকল্যান্ড আফগানিস্তানে রুশ হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি আফগান অধিপতি শাহসুজাকে কাবুলে সিংহাসনে বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। এই লক্ষ্যে বড়োলাট অকলায় শাহসুজা ও রণজিৎ সিংহের মধ্যে ত্রিশক্তি চুক্তি (১৮৩৮ খ্রি স্বাক্ষরিত হয়।
iii) ইংরেজ ও রণজিৎ সিংহের সম্পর্কের অবসান: এর পাড়া ইংরেজ বাহিনী কাবুল অভিযান শুরু করে। রণজিৎ এই অভিযা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি। প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ চলাকালীন (1839 - খ্রী.) রণজিতের মৃত্য়ু ঘটালে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কেও অবসান ঘটে ।
i) প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ :
[a] প্রেক্ষাপট: রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর পর শিখ রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে গোলযোগ বাধে। শিখদের রাজমাতা ঝিন্দন খালসা-বিরোধী মনোভাব দেখান। এই সুযোগে ইংজের পাঞ্জাব দখলের প্রস্তুতি শুরু করেন।
[b] যুদ্ধের সূচনা: রাজমাতা ঝিন্দনের প্ররোচনায় শিখ বাহিনী শতদ্রুর ওপারের ব্রিটিশ রাজ্য আক্রমণ করে। বড়োলাট হার্ডিঞ্জ অমৃতসরের সন্ধি ভঙ্গের অভিযোগ এনে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। শুরু হয় প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ।
[c] সন্ধি: যুদ্ধে জয়ী হয়ে ব্রিটিশ সেনাদল লাহোরের দখল নেয়। ফলে শিখরা ইংরেজদের সঙ্গে পরপর লাহোরের প্রথম ও দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয় (১৮৪৬ খ্রি.)।
ii) দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ :
[a] প্রেক্ষাপট: শিখরা অপমানজনক লাহোরের সন্ধি দুটি মেনে নিতে দ্বিত পারেনি। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিখরা পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ হয়।
[b] যুদ্ধের সূচনা: বিক্ষুদ্ধ শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে আফগানিস্তানের আমির দোস্ত মহম্মদ জোট বাঁধলে শুরু হয় দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ।
ইংরেজদের পাঞ্জাব জয়: দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ জয়ের পর ডালহৌসি এক ঘোষণার দ্বারা পাঞ্জাবকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেন (১৮৪৯ খ্রি.)। পাঞ্জাব জয় করার ফলে ভারতে ইংরেজ কোম্পানির সাম্রাজ্যসীমা আফগানিস্তান পর্যন্ত প্রসারিত হয়।
শিখ শক্তির পতনের কারণ
i) যোগ্য নেতৃত্বের অভাব: দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবের জন্যই শিখ সামরিক শক্তি বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত হলে শিখ সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বিনষ্ট হয়।
ii) আদর্শ বিচ্যুতি: রণজিৎ সিংহ এবং তাঁর পরবর্তী সময়েও সর্বশিখবাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি অখণ্ড শিখ সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে।
iii) খালসা বাহিনীর দায়িত্ব: লাহোর দরবারের শিখ সর্দারগণ কূটনীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ায় খালসা বাহিনী নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে এবং তাদের রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ শিখশক্তির পতনকে সম্পূর্ণ করে।
উপসংহার: ইঙ্গ-শিখ দ্বন্দ্বে জয়ী হলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি অনেক দৃঢ় হয়।
16. মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সময় ভারতে নবোত্থিত বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তর: মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সময় বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিসমূহ
1. বাংলা: মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর মুর্শিদকুলি খাঁ- কে বাংলার দেওয়ান অর্থাৎ রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারী নিযুক্ত করেন (১৭০০ খ্রি.)। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা ও উড়িষ্যার 'সুবাদার' বা নবাব নিযুক্ত হন। প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকেই বাংলায় স্বাধীন নবাবি শাসনের সূচনা হয়। তাঁর পরবর্তী শাসক সুজাউদ্দিনের আমলে (১৭২৭-৩৯ খ্রি.) বাংলার সঙ্গে বিহার যুক্ত হয়। পরবর্তী দুই নবাব সরফরাজ খাঁ ও আলিবর্দি খাঁর আমলে বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকলেও পরবর্তী নবাব সিরাজ- উদ্দৌলা পলাশির যুদ্ধে (১৭৫৭ খ্রি.) ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।
2. হায়দ্রাবাদ: মির কমরউদ্দিন চিন কিলিচ খাঁ বা নিজাম-উল-মুলক ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট মহম্মদ শাহের প্রধানমন্ত্রী বা উজির নিযুক্ত হন। কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত আমির-ওমরাহ এবং সম্রাটের বিরোধিতায় বিরক্ত হয়ে তিনি ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে উজির পদ ত্যাগ করেন এবং দাক্ষিণাত্যে চলে যান। দাক্ষিণাত্যের মোগল শাসিত প্রদেশগুলিকে নিয়ে হায়দ্রাবাদকে কেন্দ্র করে তিনি প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন। মহম্মদ শাহ তাঁকে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা বলে মেনে নেন এবং 'আসফ ঝা' উপাধি দেন।
3. অযোধ্যা: মোগল আমলে অযোধ্যা 'সুবা' বা প্রদেশ বলতে বর্তমান অযোধ্যা, বারাণসী, এলাহাবাদ ও কানপুরের একাংশকে বোঝাত। ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে সাদাত খাঁ অযোধ্যার 'সুবাদার' বা নবাব নিযুক্ত হন। তিনি অযোধ্যায় স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। অযোধ্যা লর্ড ওয়েলেসলির অধীনতামূলক
ভন্ন মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হলে (১৮০১ খ্রি.) অযোধ্যা ইংরেজদের অধীনস হয়ে পড়ে।
4. মহীশূর: হায়দার আলি স্বাধীন মহীশূর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। হায়দার প্রথম জীবনে মহীশূরের শাসক নঞ্জরাজের অধীনে একজন সামান সৈনিক হিসেবে কাজ করতেন। হায়দার ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে দিন্দিগুলের ফৌজদার নিযুক্ত হন। পরে ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে নঞ্জরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করে তিনি মহীশূরের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন। এভাবে স্বাধীন মহীশূর রাজ্যের উত্থান ঘটে। তাঁর পুত্র টিপু সুলতান মহীশূরের ক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি করেন। তবে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে (১৭৯৮-৯৯ খ্রি.) টিপু ইংরেজদের কাছে পরাজিত ও নিহত হলে স্বাধীন মহীশূরের পতন ঘটে।
5. মারাঠা: মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে মারাঠা নেতা শিবাজি দাক্ষিণাত্যে মহারাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে শক্তিবৃদ্ধি করেন। শিবাজির মৃত্যুর (১৬৮০ খ্রি.) পর থেকে একে একে শম্ভুজি, রাজারাম, তৃতীয় শিবাজি প্রমুখ মারাঠা নেতা ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। ঔরঙ্গজেবের মৃতু্যুর পর শিবাজির পুত্র শাহু মারাঠা সিংহাসনে বসেন। তাঁর আমলে একে একে বিভিন্ন মারাঠা পেশোয়া বা প্রধানমন্ত্রী রাজ্যের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা দখল ঔপনিবেশির করেন। শেষপর্যন্ত তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে (১৮১৭-১৮ খ্রি.) মারাঠারা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হলে মারাঠা রাজ্যের বৃহদংশ ইংরেজদের দখলে চলে যায়।
উপসংহার: উপরিউক্ত রাজ্যগুলি ছাড়াও অষ্টাদশ শতকে আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রাজপুতানার জয়পুরের অম্বর রাজ্য, আগ্রা ও মথুরা অঞ্চলে জাঠনেতা চূড়ামন ও বদন সিং-এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ভরতপুর রাজ্য, আফগান নেতা মহম্মদ খাঁ বঙ্গেশ-এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ফারুখাবাদ রাজ্য, রোহিলা নেতা আলি মহম্মদ খাঁ-র নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত রোহিলা রাজ্য, শিখ নেতা রণজিৎ সিং-এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পাঞ্জাব রাজ্য প্রভৃতি। পরে রাজ্যগুলিতে শীঘ্রই ইউরোপের বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তির, বিশেষ করে ব্রিটিশদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অধিকাংশ রাজ্যই পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের অধিকারে চলে যায়।
👉Paid Answer ( For Membership User)