Chapter-4  

সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে

প্রতিক্রিয়া

---------------------

MCQs

1. ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলার দলিত আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল-

(A) কায়স্থ সম্প্রদায়


(B) আদিবাসী সম্প্রদায়


(C) নমঃশূদ্র সম্প্রদায়


(D) মাহিষ্য সম্প্রদায়


উত্তর:(C) নমঃশূদ্র সম্প্রদায়



2. 'নিম্নবর্ণ' বা 'Subaltern' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন-


(A) রণজিৎ গুহ


(B) অ্যান্তনিও গ্রামসি


(C) পার্থ চট্টোপাধ্যায়


(D) গৌতম ভদ্র


উত্তর:(B) অ্যান্তনিও গ্রামসি



3. 'দামিন-ই-কোহ' শব্দটি যে বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত সেটি হল-


(A) কোল


(B) পাইক


(C) সাঁওতাল


(D) নীল


উত্তর:(C) সাঁওতাল



4. গান্ধি প্রবর্তিত 'হরিজন'-এর অর্থ-


(A) অস্পৃশ্য


(B) নিপীড়িত


(C) ঈশ্বরের সন্তান


(D) তপশিলি জাতি


উত্তর:(C) ঈশ্বরের সন্তান



5. গুজরাটের অচ্ছুৎ আদিবাসীদের বলা হত-


(A) কালিপরাজ


(B) কোনোটিই নয়


(C) রাজাপরাজ


(D) উজালিপরাজ


উত্তর:(C) রাজাপরাজ



6. কলারাম মন্দিরে দলিত শ্রেণির প্রবেশের দাবিতে আন্দোলন করেন-


(A) বাবা রামচন্দ্র


(B) পান্ডুরাম


(C) বি. আর. আম্বেদকর


(D) গান্ধিজি


উত্তর: (C) বি. আর. আম্বেদকর



7. ভারতে অনগ্রসর শ্রেণির আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন-


(A) প্রমথরঞ্জন ঠাকুর


(B) গান্ধিজি


(C) যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল


(D) ড. বি. আর. আম্বেদকর


উত্তর:(D) ড. বি. আর. আম্বেদকর



9. 'শতদিবসের সংস্কার' অনুষ্ঠিত হয়-


(A) ১৮৯০ খ্রি. 


(B) ১৮৯২ খ্রি.


(C) ১৮৯৪ খ্রি. 


(D) ১৮৯৮ খ্রি.


উত্তর:(D) ১৮৯৮ খ্রি.



10. চিনে প্রথম শিক্ষাদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়-


(A) ১৯০৫ খ্রি.


(B) ১৯১১ খ্রি.


(C) ১৯১৯ খ্রি.


(D) ১৯৪৯ খ্রি. 


উত্তর:(A) ১৯০৫ খ্রি.



11. চিনে ৪ মে-র আন্দোলনের নিরিখে 'জিও গুয়ো'

স্লোগানের অর্থ ছিল-


(A) বিদেশিরা দূর হটো 


(B) দেশকে রক্ষা করো


(C) আমরা বৌদ্ধিক সংস্কার চাই


(D) চিন কেবল চিনাদের জন্য


উত্তর:(B) দেশকে রক্ষা করো


12. 'জ্ঞানের আলো' ছিল একটি-


(A) সংবাদপত্র


(B) বই 


(C) প্রচারপত্র


(D) পুস্তিকা


উত্তর:(A) সংবাদপত্র



13. চিনের ওপর একুশ দফা দাবি আরোপ করেছিলেন


(A) আমেরিকা


(B) জাপান


(C) ফ্রান্স


(D) ইংল্যান্ড 


উত্তর:(B) জাপান



5. ব্রিটিশ সরকার       খ্রিস্টাব্দে চিন থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের

আমদানি বন্ধ ঘোষণা করে।


(A) ১৮৬৬


(B) ১৮৬৮


(C) ১৮৭০


(D) ১৮৭২


উত্তর:(A) ১৮৬৬



6. ভারত ও চিনের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের সাধারণভাবে             বলে চিহ্নিত করা হত।


(A) বেগার


(B) চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক


(C) কুলি


(D) বাবু


উত্তর:(C) কুলি



7. চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার

                খ্রিস্টাব্দে আইন পাস করে।


(A) ১৮৫৬


(B) ১৮৫৮


(C) ১৮৫৭


উত্তর:(A) ১৮৫৬



Short Answer Question

প্রশ্ন1. ড. বি. আর. আম্বেদকর কবে কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?


উত্তর: ড. বি. আর আম্বেদকর ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রদেশের মাহার সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন।


প্রশ্ন2. ড. আম্বেদকর কবে কোথায় কোন মন্দিরে প্রবেশের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন?


উত্তর: ড. আম্বেদকর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে নাসিকের কলারাম মন্দিরে প্রবেশের দাবিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন।


প্রশ্ন3. কারা, কবে 'মন্দিরে প্রবেশ-সংক্রান্ত বিল' পাস করে?


উত্তর: বোম্বাই-এর প্রাদেশিক কংগ্রেস সরকার ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে 'মন্দিরে প্রবেশ-সংক্রান্ত বিলা পাস করে।


প্রশ্ন4. দক্ষিণ ভারতে দলিত শ্রেণির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন নেতার নাম লেখো।


উত্তর: দক্ষিণ ভারতে দলিত শ্রেণির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন নেতা ছিলেন শ্রীনারায়ণ গুরু, এন. কুমারন আসান এবং টি. কে. মাধবন।


প্রশ্ন5. বর্ণহিন্দুদের কোন্ কোন্ সংগঠন ভাইকম সত্যাগ্রহকে সমর্থন করে?


উত্তর: নায়ার সার্ভিস সোসাইটি', 'নায়ার সমাজম্', 'কেরালা হিন্দুসভা', 'যোগক্ষমা সভা' প্রভৃতি বর্ণহিন্দু সংগঠন ভাইকম সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে সমর্থন করে।


প্রশ্ন6. কেরালায় কে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন? [HS '16]


উত্তর: শ্রীনারায়ণ গুরু কেরালায় অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর সংস্কার আন্দোলনের মূলমন্ত্র ছিল "এক জাতি, এক ধর্ম ও এক ঈশ্বর"।


প্রশ্ন7. গুরুবায়ুর মন্দিরের প্রবেশ-সংক্রান্ত আন্দোলনে কাদের প্রচন্ড মারধর করা হয়?


উত্তর: গুরুবায়ুর মন্দিরের প্রবেশ-সংক্রান্ত আন্দোলনে পি. কৃয় পিল্লাই ও এ. কে. গোপালনকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়।


প্রশ্ন8. কেলাপ্পান কবে কেন অনশন আন্দোলন করেন?


উত্তর: কে. কেলাপ্পান সকল হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য গুরুবায়ু মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়ার দাবিতে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে (২১ সেপ্টেম্বর) অনশন আন্দোলন শুরু করেন।


প্রশ্ন9. দিকু কাদের বলা হত?

অথবা, দিকু কাদের বলা হয়? 


উত্তর: ব্রিটিশ শাসনকালে বহিরাগত জমিদার, জোতদার, বণিক, মহাজন, ঠিকাদার, দালাল প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী ব্রিটিশ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী এলাকায় ঢুকে পড়ে। আদিবাসীরা এই বহিরাগতদের 'দিকু' বলত।


প্রশ্ন10. সাঁওতাল বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম করো।


উত্তর: সাঁওতাল বিদ্রোহের দুজন নেতা হলেন সিধু ও কান্‌নু মুর্মু।


প্রশ্ন11. বাংলায় নমঃশূদ্রদের দুজন উল্লেখযোগ্য নেতার নাম লেখো।


উত্তর: বাংলার দুজন গুরুত্বপূর্ণ নমঃশূদ্র নেতা ছিলেন প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ও যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।


প্রশ্ন12. পুনা চুক্তিতে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়?


উত্তর: পুনা চুক্তির দ্বারা আম্বেদকর দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকারের দাবি থেকে সরে আসেন এবং গান্ধিজিও দলিতদের আরও বেশি সংখ্যক আসন সংরক্ষণের দাবি মেনে নেন।


প্রশ্ন13. মাহাদ মার্চ কী?


উত্তর: সর্বসাধারণের জলাশয় থেকে অস্পৃশ্যরা যাতে জল নেওয়ার অধিকার পায় সেই দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে দলিত নেতা ড. ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে (২০ মার্চ) বোম্বাইয়ের কোলাবা জেলায় চৌদার জলাশয়কে কেন্দ্র একটি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এটি 'মাহাদ মার্চ' নামে পরিচিত।


প্রশ্ন14. কে, কবে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস (All India Depressed Classes Congress) প্রতিষ্ঠা করেন?


উত্তর: ড. বি. আর. আম্বেদকর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস (All India Depressed Classes Congress) প্রতিষ্ঠা করেন।


প্রশ্ন15. সংস্কৃতায়ন আন্দোলন বলতে কী বোঝ?


উত্তর:




Long Answer Question

প্রশ্ন1. ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট আলোচনা করো।

অথবা, ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের কারণগুলি লেখো।


উত্তর: সূচনা: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তির জয়লাভের পরবর্তীকালে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। এই সময় মোটামুটি সচ্ছল আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যে শ্রেণির উদ্ভব ঘটে তাকে সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলা হয়।


ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট


1 সরকারি চাকরি: ভারতে প্রায় ১০০ বছর ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ধারাবাহিক প্রসারের সূত্রে এদেশে প্রশাসনের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য এত বিপুল সংখ্যক কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল যে, বিলেত থেকে তা আনা সম্ভব ছিল না। তাই প্রশাসনের নিম্নস্তরের বিপুল সংখ্যক চাকরির পদে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল এই ভারতীয় কর্মচারীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।


2 আইনজীবী: সাম্রাজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে পাশ্চাত্য ধাঁচের আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বহু ভারতীয় অত্যন্ত লাভজনক আইনের পেশা গ্রহণ করে। ব্রিটিশ- ভারতের আদালতগুলিতে আমলা, উকিল, মোক্তার, কেরানি, মুহুরি ও অন্যান্য বিভিন্ন কাজে শিক্ষিত ভারতীয়রা নিযুক্ত হতে থাকে। এই পেশায় প্রবেশ করে তাদের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে। শিক্ষিত ও সচ্ছল এই ভারতীয় সম্প্রদায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।


3 করণিকের কাজ: ইংরেজরা ভারতে তাদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর এদেশে প্রচুর স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে। এসব প্রতিষ্ঠানে করণিক পদে প্রচুর সংখ্যক ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। সরকারি বেতনভুক্ত এই নিম্নবর্গের করণিকগণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।


4 সামরিক বিভাগের কর্মী: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সামরিক বিভাগের উচ্চপদগুলি ইংরেজদের জন্য নির্ধারিত হলেও নিম্ন পদগুলিতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত ভারতীয় নিযুক্ত হয়। সরকারি বেতনভুক্ত সচ্ছল এই কর্মচারীরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়।


5 ব্যবসায়ী: বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ও ব্যক্তিগত ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা ভারতের দূরদূরান্তের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিশালাকার বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য প্রচুর কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল। ব্রিটিশ বণিক ও পুঁজিপতিরা তাদের বাণিজ্যিক কাজকর্ম সচল রাখতে বহু শিক্ষিত ভারতীয়কে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করে। বাণিজ্যের কাজে নিযুক্ত এসব ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়।


6 শিল্পের কাজ: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে শিল্পের যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। শিল্প ও শিল্পকারখানাগুলির কাজকর্ম পরিচালনার জন্য প্রচুর শিক্ষিত ভারতীয় কর্মচারী নিযুক্ত হয়। শিল্পের কাজে নিযুক্ত এসব শিক্ষিত ভারতীয়রা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম অংশ ছিল।


7 ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভোগী: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে কিছু জমিদার বা ভূস্বামী শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। তারা প্রধানত প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করত। ভূস্বামীর পক্ষ থেকে প্রজার কাছ থেকে কর আদায়ের কাজটি করত মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির বহু মানুষ। বিপুল অর্থের অধিকারী এই জমিদার, ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা ইংরেজদের অনুগত শ্রেণি হিসেবে নিজেদের পেশা ও উপার্জনকে সুনিশ্চিত করেছিল এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণেও এগিয়ে এসেছিল।


৪ মহাজন: ব্রিটিশ সরকার এদেশে চিরস্থায়ী, রায়তওয়ারি, মহলওয়ারি প্রভৃতি ভূমি বন্দোবস্ত চালু করলে ভূস্বামী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের রাজস্বের চাপে দরিদ্র কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। নগদ কর আদায়ের উদ্দেশ্যে কৃষকরা মহাজনদের কাছ থেকে অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ শাসনের অনুগামী এই মহাজন শ্রেণি ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ ছিল।


উপসংহার: ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে তারা সংখ্যায় খুবই অল্প হলেও দেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এই শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ এই শ্রেণিই মূলত ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেছিল। আবার উনিশ শতকে বাংলায় যে, 'নবজাগরণ' ঘটেছিল তার অগ্রভাগে ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা।


প্রশ্ন2. উনিশ শতকে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের কারণ কী? ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিকাশে এই শ্রেণির অবদান আলোচনা করো।


উত্তর: উনিশ শতকে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের কারণ



জাতীয়তাবাদ বিকাশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবদান:


1 মূল অবদান: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংখ্যার বিচারে খুব সামান্য হলেও তারাই পরবর্তীকালে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য এ আর দেশাই ভারতের মধ্যবিত্তদের 'আধুনিক ভারতের স্রষ্টা' বলে অভিহিত করেছেন। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের ফলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হয় এবং ব্রিটিশদের অপশাসনের বিরুদ্ধে তাদের জ্ঞানের চোখ খুলে যায়। মূলত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে তোলে। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে তারা প্রথম পর্বে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতের ব্রিটিশ শাসন ও সভ্যতার একনিষ্ঠ অনুরাগীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ভারতে সর্বপ্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সরব হয়ে প্রতিরোধের ডাক দেয় এবং গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। এইভাবেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাত ধরে জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়।


2 অন্য়ান্য়


i. জাতীয় ঐক্য: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের জাতীয় স্তরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যোগাযোগ ও ঐক্য স্থাপিত হয়। ইংরেজি ভাষা এই ঐক্যের বন্ধন হিসেবে কাজ করে। এর ফলে ইন্ডিয়ান লিগ এবং ইন্ডিয়ান বন্ধন হিসেবেনের মতো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উ


ii. প্রগতিশীলতা: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তিবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পটভূমি তৈরি হয়।


iii. নবজাগরণ: মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারা ছড়িয়ে পড়লে ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে বৈপ্লবিক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এই ঘটনাকে অনেকে উনিশ শতকের ভারতীয় নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলায় এই নবজাগরণের সর্বাধিক প্রভাব পড়ে।


iv. জাতীয় আন্দোলন: মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। মূলত তাদের নেতৃত্বেই ভারতে জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।


প্রশ্ন3 ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।


উত্তর: সূচনা: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে ভারতে পাঠশালা, টোল, মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি প্রাচীন ধাঁচের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান চলত। কিছু সাধারণ বিষয়ের প্রাথমিক জ্ঞান ও ধর্মীয় কাহিনি পাঠের মধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদান সীমাবদ্ধ ছিল।


 ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার


1 সরকারি অনিচ্ছা: ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মনে করত যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতীয়দের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠবে এবং এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটবে। এজন্য কোম্পানি এদেশে সংস্কৃত ও আরবি-ফারসি শিক্ষাকেই উৎসাহ দেয়। এই উদ্দেশ্যে কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮১ খ্রি.), এশিয়াটিক ৭ সোসাইটি (১৭৮৪ খ্রি.), বারাণসী সংস্কৃত কলেজ (১৭৯১ খ্রি.), ফোর্ট - উইলিয়াম কলেজ (১৮০০ খ্রি.) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।


2 বিদেশিদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ: ভারতে সর্বপ্রথম একটি সুসংবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানান কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী চালর্স গ্রান্ট। ক্রমে এদেশে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে সরকারি অফিস, আদালত, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি স্থাপিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ভারতীয়দের ইংরেজি জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। সরকারি চাকরি লাভের জন্য মধ্যবিত্ত বাঙালি ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই চাহিদা মেটানোর জন্য কলকাতায় কিছু বিদেশি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করে। এসব বিদ্যালয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শোরবোর্ন, মার্টিন, বাউল, আরটুন পিট্রাস, ডেভিড ড্রামন্ড প্রমুখের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়।


3 শ্রীরামপুর মিশনারিদের উদ্যোগ: ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারি বা ধর্মপ্রচারকগণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মার্শম্যান, ওয়ার্ড ও উইলিয়াম কেরি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের উদ্যোগে বাংলা-সহ মোট ২৭টি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনুদিত হয়। তাঁদের উদ্যোগে কলকাতা, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থান, এমনকি চুঁচুড়া, বর্ধমান, কালনা, বহরমপুর, মালদা এবং দক্ষিণ ভারতেও বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮১৮ খ্রি.)।


4 অন্যান্য মিশনারিদের উদ্যোগ: লন্ডন মিশনারি সোসাইটি ও চার্চ মিশনারি সোসাইটির। তাদের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন স্থান-সহ দক্ষিণ ভারতে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ বেশ কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল 'জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন' (১৮৩০ খ্রি.)। এ ছাড়া মিশনারিদের উদ্যোগে শিবপুরে 'বিশপ কলেজ' (১৮২০ খ্রি.), 'মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ' (১৮৩৭ খ্রি.), বোম্বাই-এ 'উইলসন কলেজ' (১৮৩২ খ্রি.) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।


5 অন্যান্যদের উদ্যোগ: কলকাতায় রামমোহন রায় ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে 'অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল' এবং ডেভিড হেয়ার ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় (হেয়ার স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগে কলকাতায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত 'ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি' (১৮১৭ খ্রি.) এবং 'ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি' (১৮১৮ খ্রি.) বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক রচনায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে গঠিত 'কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন' বা 'জনশিক্ষা কমিটি'র সদস্যরা কলকাতায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রামমোহন রায় তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে একটি চিঠি লিখে (১৮২৩ খ্রি.) সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানান।


6 সরকারি ঘোষণা: ব্রিটিশ সরকারের কয়েকটি ঘোষণা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সহায়তা করে, যেমন- [i] ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইনের দ্বারা ঘোষণা করে যে, ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ব্যয় করবে। [ii] জনশিক্ষা কমিটি'র সভাপতি মেকলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারি নীতি হিসেবে ঘোষণা করেন। [iii] উডের ডেসপ্যাচ (১৮৫৪ খ্রি.) অনুসারে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে।


উপসংহার: ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে, ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার আরও প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে হান্টার কমিশনের অনুসারে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান কমিয়ে দেয়। কিন্তু মধ্যবিত্তদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বিপুল চাহিদা থাকায় বেসরকারি উদ্যোগে সারা ভারতে একাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।


প্রশ্ন4. পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে ঔপনিবেশিক ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগ সম্পর্কে উল্লেখ করো। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের তাৎপর্য উল্লেখ করো। 


উত্তর:


প্রশ্ন5. মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে কী বোঝ? উনিশ শতকে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করো।


উত্তর:   



  👉Paid Answer ( For Membership User)


Editing by- Rita Moni Bora