অধ্যায়-৫
ঔপনিবেশিক
ভারতের শাসন
------------------------------
MCQs
1. মিরাট ষড়যন্ত্র ঘটে-
(A) ১৯২৯ খ্রি. ✔
(B) ১৯৩১ খ্রি.
(C) ১৯৪১ খ্রি.
(D) ১৯৩০ খ্রি.
2. ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়-
(A) কলকাতায়
(B) মাদ্রাজে
(C কানপুরে ✔
(D) লাহোরে
3. ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়-
(A) ১৯৩০ খ্রি.
(B) ১৯২৫ খ্রি. ✔
(C)১৯২৭ খ্রি.
(D) ১৯৯৯ খ্রি.
4. গান্ধিজি কোন্ আইনকে "উকিল নেহি, দলিল নেহি, আপিল নেহি" বলে উল্লেখ করেন-
(A) ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনকে
(B) ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো আইনকে
(C) ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের রাওলাট আইনকে ✔
(D) ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনকে
5. রাওলাট আইনকে 'ভয়াবহ ভ্রান্তি' বলে অভিহিত করে-
(A) আনন্দবাজার পত্রিকা
(B) অমৃতবাজার পত্রিকা ✔
(D) হিন্দু পত্রিকা
(D) কেশরী পত্রিকা
6. রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে যে 'সত্যাগ্রহ সভা' প্রতিষ্ঠিত হয় তার সভাপতি হয়েছিলেন-
(A) সিডনি রাওলাট
(B) ড. সত্যপাল ✔
(C) মহাত্মা গান্ধি
(D) মহম্মদ ইকবাল
7. গান্ধিজি রাওলাট সত্যাগ্রহ প্রত্যাহার করে নেন-
(A) এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে
(B) মে, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে
(C) জুন, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে
(D) জুলাই, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ✔
8. আর্চিবোল্ড, থিওডোর বেক, মরিসন প্রমুখ কোন্ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলিমদের মনে বিচ্ছিন্নতার
(A) হিন্দু ✔
(B) শিখ
(C) বৌদ্ধ
(D) ইঙ্গ-ভারতীয়
9. ভারতে অনগ্রসর শ্রেণির আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন-
(A) প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ✔
(B) যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল
(C) গান্ধিজি
(D) ড. আম্বেদকর
10. ভারতে কোন্ আইনের মাধ্যমে প্রথম সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের নীতি চালু হয়?
(A) রাওলাট আইন
(B) মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন
(C) মর্লে-মিন্টো আইন
(D) লর্ড ক্রসের আইন ✔
11. ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সিমলা দৌত্যের উদ্যোগ নিয়েছিলেন-
(A) চিত্তরঞ্জন দাস
(B) মোতিলাল নেহরু
(C) আগা খাঁ ✔
(D) মহম্মদ আলি জিন্না
12. মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠা করেন-
(A) ঢাকার নবাব সলিমউল্লাহ ✔
(B) আগা খাঁ
(C) মহম্মদ আলি জিন্না
(D) লর্ড মিন্টো
13. কোন্ বড়োলটি বঙ্গভঙ্গ রদের কথা ঘোষণা (১৯১১ খ্রিস্টাব্দ) করেন?
(A) লর্ড মিন্টো
(B) লর্ড কার্জন
(C) লর্ড হার্ডিঞ্জ ✔
(D) লর্ড ওয়াভেল
14. মুসলিম লিগের কোন অধিবেশনে পাকিস্তান দাবি করা হয়?
(A) লাহোর ✔
(B) লক্ষ্ণৌ
(C) মাদ্রাজ
(D) পাঞ্জাব
15. কোন ঘটনার প্রতিবাদে গান্ধিজি অনশন করেন?
(A) রাওলাট আইন
(B) জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড ✔
(C) সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি
(D) গোলটেবিল বৈঠক
16. মুসলিম লিগের প্রথম সভাপতি ছিলেন-
(A) সলিমুল্লাহ
(B) মহম্মদ আলি জিন্না
(C) আগা খাঁ ✔
(D) রহমত আলি
17. 'Now or Never' শীর্ষক পুস্তিকাটি লেখেন-
(A) আগা খাঁ
(B) মহঃ আলি জিন্না
(C) বাল গঙ্গাধর তিলক
(D) চৌধুরি রহমত আলি ✔
18. অসবর্ণ হিন্দুদের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়ার দাবিতে অনশন করেন-
(A) রাজা গোপালাচারি
(B) কেশব মেনন ✔
(C) এ. কে. গোপালন
(D) কেলাপ্পন
19. আম্বেদকর জন্মগ্রহণ করেন-
(A) জুলায়া সম্প্রদায়ে
(B) মাহার সম্প্রদায়ে ✔
(C) তিনদাল সম্প্রদায়ে
(D) ইঝাবা সম্প্রদায়ে
20. অস্পৃশ্যরা যাতে জনসাধারণের জলাশয় থেকে জল নিতে পারে সেই উদ্দেশ্যে
ড. আম্বেদকর কোন্ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন?
(A) মাহাদ মার্চ ✔
(B) খেদা সত্যাগ্রহ
(C) খিলাফৎ আন্দোলন
শূন্যস্থান পূরণ করো
1. সিমলা বৈঠকে মুসলিম প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দেন।
(A) ভিকার উল-মূলক
(B) সালিমুল্লাহ
(C) লিয়াকৎ হোসেন।
(D) আগা খাঁ✔
প্রশ্ন 2. হরিজন পত্রিকা প্রকাশ করেন।
(A) গান্ধিজি✔
(B) নেহর্
(C) বল্লভভাই প্যাটেল
(D) বি. আর. আম্বেদকর
3. মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিস্টাব্দে।
(A) ১৯০৬✔
(B) ১৯০৮
(C) ১৯০২
(D) ১৯০৫
4. জিন্না তাঁর চোদ্দো দফা দাবি মুসলিম লিগের অধিবেশনে ঘোষণা করেন।
(A) লাহোর
(B) দিল্লি✔
(C) কানপুর
5. ভাইকম সত্যাগ্রহের সাথে যুক্ত ছিলেন।
(A) রামমোহন
(B) জ্যোতিবা ফুলে
(C) নারায়ণ গুরু✔
(D) বীরসালিঙ্গম
6. 'পুনা চুক্তি' স্বাক্ষরিত হয় খ্রিস্টাব্দে।
(A) ১৯১৬
(B) ১৯১৮
(C) ১৯৩০
(D) ১৯৩২✔
7. র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড ছিলেন |
(A) ব্রিটিশ রাজা
(B) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী✔
(C) ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল
(D) ভারত-সচিব
8. এদেশে সর্বপ্রথম পাঞ্জাবের সেনাবাহিনীতে 'বিভাজন ও শাসননীতি' কার্যকরী করেন
|
(A) লর্ড কার্জন
(B) জন লরেন্স✔
(C) ওয়েলেসলি
(D) ওয়ারেন হেস্টিংস
9. গান্ধিজি 'হরিজন' নামে ডাকতেন |
(A) ব্রাহ্মণদের
(B) ক্ষত্রিয়দের
(C) বৈয়বদের
(D) দলিত হিন্দুদের✔
10. কলারাম মন্দিরে প্রবেশের জন্য আন্দোলন করেছিলেন |
(A) গান্ধিজি
(B) ড. আম্বেদকর✔
(C) বীরসালিঙ্গম
(D) কেশবচন্দ্র সেন
Short Answer Question
1. পঞ্চাশের মন্বন্তরের দুটি কারণ উল্লেখ করো।
উত্তর: পঞ্চাশের মন্বন্তরের দুটি কারণ ছিল-[i] প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া। [ii] খাদ্য সংকটের সময় বার্মা-সহ বাইরের বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলায় খাদ্য আমদানিতে বাধা।
2. পঞ্চাশের মন্বন্তরের পর সরকার কী কমিশন গঠন করে এবং কবে এর রিপোর্ট জমা পড়ে?
উত্তর: পঞ্চাশের মন্বন্তরের পর সরকার 'দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধান কমিশন' গঠন করে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে এই কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়ে।
3. বারদৌলি আন্দোলনের দুটি ফল উল্লেখ করো।
উত্তর: বারদৌলি আন্দোলনের দুটি প্রধান ফল ছিল-[i] রাজস্ব বৃদ্ধিজনিত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। [ii] তদন্ত কমিশন বারদৌলিতে ৩০ শতাংশের পরিবর্তে ৬.০৩ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি অনুমোদন করে।
4. 'Gold Exchange Standard' নীতি কী?
উত্তর: টাকার সঙ্গে সোনার একটি সামঞ্জস্য বজায় রাখার নীতিকে 'Gold Exchange Standard' নীতি বলা হয়।
5. 'Royal Commission on Indian Currency' কবে গঠিত হয়?
উত্তর: ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে 'Royal Commission on Indian Currency' গঠিত হয়।
6. TISCO-এর পুরো নাম কী? অথবা, TISCO-র পুরো কথা কী?
উত্তর: TISCO-এর পুরো নাম Tata Iron and Steel Company |
9. কত খ্রিস্টাব্দে TISCO প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে TISCO প্রতিষ্ঠিত হয়।
10. কবে, কোথায় ভারতের প্রথম কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়?
উত্তর: ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে রানিগঞ্জে ভারতের প্রথম কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়।
11. কুনবি বা পতিদার নামে কারা পরিচিত?
উত্তর: ব্রিটিশ শাসনকালে গুজরাটের খেদা জেলায় একশ্রেণির কৃষক পতিদার নামে পরিচিত ছিল। পূর্বে এরাই কুনবি নামে পরিচিত ছিল। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি রিপোর্টে এদের পতিদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এদের প্রধান কাজ ছিল রাজস্ব আদায় করা।
12. হল্যান্ড কমিশন কখন গঠিত হয়?
উত্তর: ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে হল্যান্ড কমিশন গঠিত হয়।
13. হল্যান্ড কমিশনের সভাপতি কে ছিলেন?
উত্তর: হল্যান্ড কমিশনের সভাপতি ছিলেন টি. এইচ. হল্যান্ড।
14. ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের শিল্প কমিশনের দুটি সুপারিশ উল্লেখ করো।
উত্তর: ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের শিল্প কমিশন সুপারিশ করে যে, ভারতে শিল্পের অগ্রগতির প্রয়োজনে- [i] যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। [ii] দেশে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
Long Answer Question
1. বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলাফলগুলি কী ছিল?
উত্তর: সূচনা: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অন্যতম প্রত্যক্ষ ফল ছিল ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ যা 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' নামে বেশি পরিচিত। সরকারি শোষণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে শস্যহানি, বাইরে থেকে বাংলায় খাদ্য আমদানিতে বাধা, খাদ্যের মজুতদারি, মুদ্রাস্ফীতি প্রভৃতি বিভিন্ন ঘটনা পঞ্চাশের মন্বন্তরকে ভয়াবহ করে তোলে।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলাফল
1. ব্যাপক প্রাণহানি: পঞ্চাশের মন্বন্তরে অনাহার ও বিভিন্ন রোগের প্রকোপে বাংলায় প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ না করলেও দুর্ভিক্ষে অন্তত ৪০ লক্ষ থেকে ৭০ লক্ষ বা আরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। মৃতদেহগুলি রাস্তাঘাটে, বনেবাদাড়ে স্তূপাকারে পড়ে থাকতে দেখা যেত। মৃতদেহ সৎকারের মানুষ ছিল না। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মৃতদেহের দখল নিয়ে শিয়াল আর কুকুরের মধ্যে লড়াই চলত। দিনে দিনে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলে মৃতদেহের মাংসের প্রতি শিয়াল, কুকুর, শকুনেরও অরুচি ধরে। পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলায় যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও তত মানুষের মৃত্যু হয়নি। এই মন্বন্তরের ভয়াবহতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও বেশি ছিল।
2 অর্থনৈতিক বিপর্যয়: মন্বন্তরের সময় বাংলায় চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। দরিদ্র মানুষের দীর্ঘদিন ধরে জমানো অর্থসম্পদ দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য কিনতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এরপর নিঃস্ব, রিক্ত, অভুক্ত মানুষগুলি থালা-বাটি হাতে রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তিতে বেড়িয়ে পড়ে। "মা, একটু ফ্যান দাও" বলে কাতরাতে কাতরাতে কলকাতার বুভুক্ষু মানুষের দল দিশাহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং পরে অভুক্ত, শীর্ণ, কঙ্কালসার এই মানুষগুলি রাস্তার ধারে মরে পড়ে থাকছে-এই দৃশ্য কলকাতা-সহ বাংলার সর্বত্র দেখা যেত।
3 মানবিক বিপর্যয়: ভয়াবহ পঞ্চাশের মন্বন্তর বাংলায় চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় ঘটায়। খিদের জ্বালায় মানুষ অখাদ্য পশু ও কীটপতঙ্গ, লতাপাতা, এমনকি দুর্বাঘাস প্রভৃতি অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে শুরু করেছিল। কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে অভুক্ত মানুষ শহরের ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। মানুষ তার প্রিয়জনকে মৃত্যুমুখে ফেলে রেখে নিজে বাঁচার তাগিদে অন্যত্র চলে যায়। অভাবের তাড়নায় অনেকে স্ত্রী-সন্তানদের বিক্রি করে দেয়।
4 সরবরাহ: খাদ্য দেরিতে হলেও সরকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে খাদ্য সরবরাহের উদ্যোগ নেয়। শহরে কয়েকটি ন্যায্য মূল্যের দোকান খুলে মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার সামান্য প্রয়াস দেখা যায়। বাইরে থেকে বাংলায় ২৬৪ হাজার টন চাল, ২৫৮ হাজার টন গম এবং ৫৫ হাজার টন মিলেট বাংলায় আমদানি করা হয়। অবশ্য খাদ্য আমদানির আগেই বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে গেছে।
5 কমিশন গঠন: দুর্ভিক্ষের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে সরকার দুর্ভিক্ষের পর 'দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধান কমিশন' গঠন করে। এই কমিশন দীর্ঘ তদন্ত করে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারকে তার রিপোর্ট জমা দেয়। এই কমিশনের রিপোর্ট মন্বন্তরের সময় সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক, পৌর ও সামরিক নীতির ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল যে, অন্য কোনো দুর্ভিক্ষ-পীড়িত দেশের সরকার নিজের বিরুদ্ধে এরূপ সমালোচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।
6 শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি: পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিভিন্ন সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। চিত্তপ্রসাদ তাঁর 'ক্ষুধার্ত বাংলা: ১৯৪৩-এর নভেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় ভ্রমণ'-এ, বিজন ভট্টাচার্য তাঁর 'নবান্ন' নাটকে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'অশনি সংকেত' উপন্যাসে পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহ কাহিনি তুলে ধরেন। উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপ দেন বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়। এ ছাড়া ভবানী ভট্টাচার্যের 'So Many Hungers', অমলেন্দু চক্রবর্তীর 'আকালের সন্ধানে' (যা পরে চলচ্চিত্রে রূপ দেন মৃণাল সেন), কে. এ. আব্বাস পরিচালিত 'ধরতি কে লাল' ও বিমল রায় পরিচালিত 'Bengal Famine' চলচ্চিত্র, জয়নুল আবেদিনের আঁকা বিভিন্ন চিত্র প্রভৃতিতে পঞ্চাশের মন্বন্তরের করুণ কাহিনি ধরা পড়েছে।
7 গ্রন্থ নিষিদ্ধকরণ: চিত্তপ্রসাদ তাঁর 'ক্ষুধার্ত বাংলা: ১৯৪৩-এর নভেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় ভ্রমণ' গ্রন্থে দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর মেদিনীপুর সফরের একটি অসামান্য বিবরণ তুলে ধরেন। তাঁর বর্ণিত জীবন্ত করুণ চিত্রে সরকারের মুখোশ খুলে যায়। এতে সরকার যথেষ্ট বিব্রত হয় এবং সরকারকে বিভিন্ন সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে এর ৫০০০ কপি বাজেয়াপ্ত করে। এই বইয়ের একটি কপি লুকোনো অবস্থায় চিত্তপ্রসাদের পারিবারিক সংগ্রহে থেকে গিয়েছিল, যেটি বর্তমানে দিল্লির আর্ট গ্যালারিতে রাখা আছে।
উপসংহার: পঞ্চাশের ভয়াবহ মন্বন্তর সম্পর্কে চর্চা ও গবেষণা আজও চলছে। মেদিনীপুর সফরের সময় চিত্তপ্রসাদ ও তার সঙ্গীরা ধানখেত থেকে বছর ছ'য়েকের এক শিশুকে উদ্ধার করেন-চিত্তপ্রসাদের ভাষায়: 'হাড়ের তৈরি কালো পুতুল!' এ চিত্র শুধু মেদিনীপুরের নয়, এ ছিল দুর্ভিক্ষের সময় সারা বাংলার চিত্রের প্রতীক।
2.পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহতা কীরূপ ছিল? মন্বন্তরের পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা কীরূপ ছিল? 4+4
উত্তর:
3. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণগুলি কী ছিল? অথবা, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় 'পঞ্চাশের মন্বন্তর'-এর কারণ কী ছিল?
উত্তর: সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের তীব্র অর্থনৈতিক শোষণের ফলে অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৩৫০ বঙ্গাব্দে) এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ দুর্ভিক্ষ চরম আকার ধারণ করে। প্রায় এক বছর ধরে সারা বাংলায় দাপিয়ে বেড়িয়ে এই মন্বন্তর বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে। অনাহারে ও অপুষ্টিতে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল বলে এই মন্বন্তর 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' নামে পরিচিত।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ
1 খাদ্য উৎপাদন হ্রাস: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলস্রোতে বাংলার আমন ধানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। ধানের উৎপাদন ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ কমে যায়। মানুষের হাতে সঞ্চিত খাদ্য ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শেষ হয়ে গেলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে খাদ্য সংকট চরমে ওঠে।
2 বাণিজ্য গণ্ডি: ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্য গণ্ডি প্রথা চালু করায় ব্যবসায়ীরা অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলায় খাদ্যশস্য আমদানি করতে পারেনি। বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকারগুলিও তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিজ প্রদেশের বাইরে খাদ্যশস্য রপ্তানিতে বাধার সৃষ্টি করে।
3 খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের বন্যায় গ্রামীণ রাস্তাগুলি ভেঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এই অবস্থায় বাংলার দূরদূরান্তের গ্রামগুলিতে খাদ্য, ত্রাণ ও চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছে দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।
4 বার্মা থেকে চাল আমদানি ব্যাহত: জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের হাত থেকে বার্মা দখল করে নিলে বার্মা থেকে বাংলায় পূর্বপ্রচলিত চাল আমদানি প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত নেতাজি সুভাষ চন্দ্র জাপানের সহযোগিতায় বার্মা থেকে বাংলায় চাল পাঠানোর প্রস্তাব দিলেও সরকার এতে সাড়া দেয়নি।
5 জাপানের আক্রমণের আশঙ্কা: জাপান কর্তৃক বার্মা দখলের পর ব্রিটিশ সরকার আশঙ্কা করেছিল যে, জাপান হয়তো বাংলা হয়ে ব্রিটিশ ভারতে অভিযান চালাতে পারে। এজন্য পোড়ামাটির নীতি অনুসারে বার্মার নিকটবর্তী চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় সরকার সেখানকার মানুষের মাছ ধরার সামগ্রী, নৌকা, মোটর যান, গোরুর গাড়ি প্রভৃতি বাজেয়াপ্ত করে সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়। জাপানিরা সাগরপথে বাংলার উপকূলে এসে নামতে পারে-এই আশঙ্কায় সরকার কলকাতার ২০ মাইল দক্ষিণ থেকে উপকূল অঞ্চলের সব নৌকা ধ্বংস করে। ফলে বাংলার সীমান্তে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
6 চার্চিলের ভূমিকা: বাংলার মন্বন্তরের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল যথেষ্ট দায়ী ছিলেন। বাংলার চরম খাদ্যাভাবের সময় অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা বা কানাডা জাহাজে করে বাংলায় খাদ্যশস্য পাঠাতে চাইলেও চার্চিল যুদ্ধের কাজে জাহাজ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে খাদ্য পরিবহণে কোনো জাহাজ ছাড়তে রাজি হননি। তিনি জাহাজে করে বাংলায় খাদ্য পাঠানোর পরিবর্তে গ্রিসের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে খাদ্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
7 সেনার জন্য খাদ্য রপ্তানি: বাংলায় খাদ্যাভাব সত্ত্বেও সরকার যুদ্ধের সময় ভারত থেকে প্রচুর খাদ্যশস্য বাইরে রপ্তানি করে। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত শস্য সরবরাহ করে সেনাদের চাহিদা নিশ্চিত করতে গিয়ে সেখানে বহু খাদ্যের অপচয় হত। ফলে খাদ্য সংকট আরও বৃদ্ধি পায়।
৪ মজুতদারি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বাংলায় জাপানি আক্রমণের মার পরিস্থিতিতে সরকার সেনাবাহিনীর জনার্ভেলেম জুথকে প্রচুর আশকারা ল মজুত করে। কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে মজুত করা ১০ হাজার টন চাল দুর্ভিক্ষের পরে পচে যাওয়ায় তা জলে ফেলে দিতে হয়েছিল। হাজা সংকটের আঁচ করে ব্যবসায়ীরাও প্রচুর চাল কিনে গুদামে মজুত করে এবং দুর্ভিক্ষের সময় বহুগুণ বেশি দামে তা বিক্রি করে। বাংলার দরিদ্র মানুষ ব্দেরএই আকাশছোঁয়া দামে এই খাদ্য কিনতে ব্যর্থ হয়।
9 সরকারের অবহেলা: বাংলার নেতা ফজলুল হক খাদ্য সংকটের মা বিষয়ে সরকারকে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে হুঁশিয়ারি দিলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় খাদ্য সংকট শুরু হলে বাংলার প্রাদেশিক সরকার এর মোকাবিলায় মোটেই তৎপরতা দেখায়নি। যখন মৃত্যুর মিছিল শুরু হয় সরকার তখন অতি ধীর গতিতে ত্রাণকার্য শুরু করে।
10 ড. অমর্ত্য সেনের অভিমত: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন মনে করেন যে, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে যখন দুর্ভিক্ষ ছিল না তখনকার তুলনায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় খাদ্যের জোগান বেশি ছিল। কিন্তু এই সময়কার মুদ্রাস্ফীতির ফলে একশ্রেণির মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যায়। তারা বেশি করে খাদ্য ক্রয় করলে বাজারে খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হয়। অবশ্য ড. সেনের শ ব্যাখ্যার সঙ্গে অনেকেই একমত নন।
2. ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।
সূচনা: ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধ-পরিস্থিতির কারণে ব্রিটেনের শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হলে ভারতে শিল্পায়নের সুযোগ আসে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটে।
ভারতে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ (১৯১৪-৪৫ খ্রি.)
1 সুতিবস্ত্র: ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত বস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছিল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বস্ত্রশিল্পে মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণ অন্তত ৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বোম্বাইয়ে ৮৫টি এবং আমেদাবাদে ৪৯টি কাপড়ের কল স্থাপিত হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে মোট ৩৩৫টি সুতোকলের মধ্যে ৩২২টিই ছিল ভারতীয় মালিকানাধীন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বস্ত্রশিল্পে অন্তত ৪৬ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
2 লৌহ-ইস্পাত: [i] জামশেদপুরের 'টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি' (TISCO)-তে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশুদ্ধ ইস্পাত উৎপাদন শুরু হয়। এই কোম্পানিতে ইস্পাতের উৎপাদন ১৯১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৩১ হাজার টন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এই কারখানার সম্প্রসারণ ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে এই সংস্থার উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৮ লক্ষ টন। [ii] আসানসোলের বার্ণপুরের কাছে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে 'ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি' (IISCO) প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে উৎপাদন শুরু হয়। [iii] এ ছাড়া এই সময় 'মহীশূর আয়রন অ্যান্ড স্টিল ওয়ার্কস' (১৯২৩ খ্রি.) এবং 'দ্য স্টিল কর্পোরেশন অব বেঙ্গল' (১৯৩৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়।
3 পাট: [i] ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পাটকলের সংখ্যা ছিল ৬৪। এগুলিতে প্রায় ২ লক্ষ ১৬ হাজার কর্মী কাজ করত। ১৯৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে পাটকলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৩টি। [ii] প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের প্রয়োজনে পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে ২ কোটি ৫ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের পাট এদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি হয়।
4 বাগিচা শিল্প
1. চা শিল্প: আসাম, বাংলা, কাছাড়, তরাই অঞ্চল, ডুয়ার্স, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাবের কাংড়া, দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি ও অন্যান্য অঞ্চলে চা শিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে চা বাগিচার মোট আয়তন ছিল ৭ লক্ষ ৭ হাজার ৭৩৩ একর।
ii. কফি: দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক, কেরালা ও তামিলনাডুতে যথেষ্ট শিল্প কফি উৎপাদিত হত। ১৯১০-১২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রায় ২ লক্ষ ৩ হাজার একর জমিতে কফি চাষ হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়।
iii. আখ: ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের ৩০টি চিনিকলে ১ লক্ষ ৫৮ হাজার টন চিনি উৎপন্ন হত। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে চিনি শিল্প সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়ায় তা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে চিনিকলের সংখ্যা ছিল ১৬১টি।
5 কয়লা: ভারতে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে রানিগঞ্জে সর্বপ্রথম কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়। বাংলা, বিহার ও ওড়িশার বিভিন্ন কয়লা খনি নিয়ে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে 'ইন্ডিয়ান মাইনিং ফেডারেশন' গড়ে ওঠে। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে মোট উৎপাদিত কয়লার প্রায় ৫৪.০৫ শতাংশ পূর্ব ভারতের কয়লা খনিগুলি থেকেই উৎপাদিত হত।
6 কাগজ শিল্প: বিংশ শতকের প্রথমদিকে কাগজ শিল্পে আধুনিক- প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় এবং নতুন নতুন কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ভদ্রাবতীর 'মহীশূর পেপার মিল' (১৯৩৭খ্রি.) এবং হায়দ্রাবাদের 'শিরপুর পেপার মিল' (১৯৩৮ খ্রি.)। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ভারতে ১৬টি কাগজের কল ছিল। তাদের বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২০ লক্ষ হন্দর।
7 জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্র পরিবহণ: লোহা ও ইস্পাত এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের প্রসার ঘটলে তার ওপর ভিত্তি করে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারতে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অগ্রগতি ঘটে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় মালিকানায় 'সিম্বিয়া নেভিগেশন কোম্পানি' গড়ে ওঠে। বিশিষ্ট গুজরাটি শিল্পপতি ওয়ালচাঁদ হীরাচাঁদ জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্র পরিবহণে প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করেন।
৪ সিমেন্ট শিল্প: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে সিমেন্টের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে উৎপাদনও বাড়ে। ভারতে সিমেন্টের উৎপাদন ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ছিল ২ লক্ষ ৬৪ হাজার টন। এই উৎপাদন বেড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দাঁড়ায় ১২ লক্ষ টন। ১০টি সিমেন্ট কোম্পানি একত্রিত হয়ে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে 'অ্যাসোসিয়েটেড সিমেন্ট কোম্পানি' (ACC) গড়ে তোলে। ফলে এই শিল্পের পরিচালনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার: আলোচ্য সময়কালে ভারতে চর্বি, পশম, মদ, দেশলাই, রাসায়নিক, অ্যালুমিনিয়াম ও বিভিন্ন যন্ত্রশিল্প প্রভৃতিরও অগ্রগতি ঘটে।
জি. ডি. বিড়লার উদ্যোগে ভারতে প্রথম দেশীয় মালিকানায় পাটকল তৈরি হয় (২৫ রাখো আগস্ট, ১৯১৯ খ্রি.)। আর হুকুমচাঁদ 22 জৈনের উদ্যোগে দেশীয় মালিকানায় এদেশে দ্বিতীয় ভারতীয় পাটকলটি গড়ে ওঠে (১৯৯২ খ্রি.)।
3.প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ভারতীয় শিল্পোদ্যোগের বিচ্ছি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো। এই সময় শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন ভারতীয় শিল্পোদ্যোগীদের পরিচয় দাও।
উত্তর: ভারতীয় শিল্পোদ্যোগের বৈশিষ্ট্য:
বিংশ শতকের প্রথম থেকে ইংরেজ শিল্পপতিদের সঙ্গে ভারতীয় কোও শিল্পপতিরাও সমানতালে শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করতে থাকেন।
1.শিল্পপতি ও শ্রমিকশ্রেণির উদ্ভব: ভারতের শিল্পের বিকাশে এই সময় যথেষ্ট সংখ্যক ভারতীয় শিল্পপতি ও মালিকশ্রেণি যুক্ত হয়। ফলে একার ভারতীয় সমাজে শিল্পপতিশ্রেণির উদ্ভব ঘটে। পাশাপাশি তাদের শিল্পকারখানায় কাজ করে গড়ে ওঠে শ্রমিকশ্রেণি।
2.প্রযুক্তি শিক্ষার অভাব: বিংশ শতকের শুরুতে ভারতীয় প্রাপ শিল্পোদ্যোগীরা শিল্পস্থাপন শুরু করলেও ভারতীয়দের মধ্যে শিল্প-প্রযুক্তি কো এবং বিজ্ঞান-বিষয়ক পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব ছিল। ভারতীয় শিল্পপতিদের গো মধ্যে এবিষয়ে শিক্ষার প্রসারে সরকার বিশেষ চেষ্টা করেননি।
3.ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে অনগ্রসরতা: ভারতীয় শিল্পো-দ্যোগীদের - পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান-বিষয়ক জ্ঞানের অভাবে ভারতীয় মালিকানায় ল ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের অগ্রগতি যথেষ্ট ব্যাহত হয়। এজন্য তারা রেল-ইঞ্জিন, মোটরগাড়ি, জাহাজ, এরোপ্লেন প্রভৃতি শিল্পের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি।
4. পশ্চিম ভারত-কেন্দ্রিকতা: শিল্পক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বোম্বাই-এর পারসি, গুজরাটি, মাড়োয়ারি প্রভৃতি বণিকরা যে সাহস ) দেখাতে পেরেছিল তা পূর্ব ভারতের ধনী পুঁজিপতিরা দেখাতে পারেনি। র ফলে পশ্চিম ভারতে শিল্পের অধিক প্রসার ঘটলেও পূর্ব ভারতে তা ণ ঘটেনি। ফলে বোম্বাই-সহ পশ্চিম ভারতে দেশীয় শিল্পের অধিক প্রসার ঘটে।
5.বস্ত্রশিল্পের প্রাধান্য: ভারতীয় শিল্পপতিরা যেসব শিল্পে প্রচুর মূলধন এর বিনিয়োগ করে তার মধ্যে প্রধান ছিল বস্ত্রশিল্প। মূলত পশ্চিম ভারতে এই য় শিল্পের প্রসার ঘটে।
6.পূর্ব ভারতে কম বিনিয়োগ: ভারতীয় পুঁজিপতিদের মূলধন পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে কলকাতা ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে কম বিনিয়োগ হয়। এখানকার পুঁজিপতিরা জমিতে অর্থ বিনিয়োগকেই বি নিরাপদ মনে করে।
বিভিন্ন ভারতীয় শিল্পোদ্যোগী
1 পারসি শিল্পোদ্যোগী: পারসি শিল্পপতি জামশেদজি টাটা (১৮৩৯- ১৯০৪ খ্রি.) ছিলেন ভারতীয় শিল্পপতিদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। ভারতীয়দের মধ্যে তিনি লোহা ও ইস্পাত শিল্প গঠনে সর্বাধিক সাফল্য ই, দেখিয়েছেন।
2 গুজরাটি শিল্পোদ্যোগী: গুজরাটি শিল্পপতিরা শিল্পস্থাপনে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ওয়ালচাঁদ হীরাচাঁদ, পুরুষোত্তম দাস ঠাকুরদাস, আম্বালাল সারাভাই প্রমুখ। ওয়ালচাঁদ হীরাচাঁদ খনি, বীমা, সিমেন্ট, মোটরগাড়ি নির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগ করেন।
3 মাড়োয়ারি শিল্পোদ্যোগী: ভারতে শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা মাড়োয়ারি শিল্পপতিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্বরূপচাঁদ হুকুমচাঁদ, বিড়লা-ডালমিয়া, সিংহানিয়া প্রমুখ। মাড়োয়ারি শিল্পপতিদের মধ্যে সর্বাধিক
উল্লেখযোগ্য হুকুমচাঁদ আফিম ও খাদ্যশস্যের ব্যাবসায় যুক্ত ছিলেন। পরে তিনি হুগলি নদীর তীরে একটি পাটকল স্থাপন করেন।
4.বাঙালি শিল্পোদ্যোগী: বাঙালি শিল্পপতিদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্যার ব্রজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্রজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লৌহ-ইস্পাত শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করেন।
5.দেশীয় রাজ্যের শিল্পোদ্যোগ: ব্রিটিশ-ভারতের বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যও শিল্পস্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এবিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয় কাছে মহীশূর, বরোদা, কোচিন প্রভৃতি দেশীয় রাজ্য। মহীশূরের দেওয়ান বিশিষ্ট ভারতীয় প্রযুক্তিবিদ এম. বিশ্বেশ্বরাইয়া-র উদ্যোগে মহীশূরে শিল্পের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। ভদ্রাবতী লৌহ ও ইস্পাত কারখানার প্রতিষ্ঠা তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
6 ইংরেজদের সহযোগী ভারতীয় শিল্পোদ্যোগী: বিংশ শতকে এবার এদেশে শিল্পের প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন। শ ওয়ালেস ইংরেজ শিল্পপতিদের সহযোগী হিসেবে কয়েকজন ভারতীয় শিল্পপতি তিন কোম্পানির সহযোগী তারাচাঁদ ঘনশ্যাম দাস, ব্যালি ব্রাদার্সের সহযোগী বিয়ার গোয়েঙ্কা, গ্রাহাম ব্রাদার্সের সহযোগী ঝুনঝুনওয়ালা, অ্যান্ড ইউলসের সহযোগী ভাটিয়া প্রমুখ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
4.প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু। হওয়ার পর ভারতে শিল্পের অগ্রগতির কারণ কী ছিল? এই সময় শিল্পের বিকাশে সরকার কী কী উদ্যোগ নিয়েছিল?
উত্তর: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর থেকে ভারতে শিল্পে অগ্রগতির কারণ:
1 পুঁজিপতিদের সুবিধাদান: ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেনের কলকারখানাগুলি যুদ্ধ-সংক্রান্ত কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পর্যাপ্ত ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে এবং ভারতে পর্যাপ্ত শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করতে ব্রিটেন ব্যর্থ হয়। এই শূন্যতার সুযোগে ভারতের বাজার মে পঠি দখলের উদ্দেশ্যে আমেরিকা ও জাপান তৎপরতা শুরু করে। আমেরিকা ও বয় করা সরকার ভারতীয় পুঁজিপতিদের শিল্পস্থাপনে কিছু কিছু সুযোগসুবিধা দিতে শুরু করে।
2 সংরক্ষণ নীতি: ব্রিটিশ সরকার ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পর এদেশে দুটি ৮ বিভিন্ন শিল্পের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নীতি অর্থাৎ সেসব শিল্পের ক্ষেত্রে করা। ভারতীয়দের বিশেষ কিছু সুবিধাদানের নীতি গ্রহণ করে। ফলে বিদেশি শিল্পপণ্যের অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে ভারতীয় শিল্প কিছুটা রক্ষা পায়। এই পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরে হলেও ভারতে শিল্পায়নের সুবিধা সরকা হয়।
3 অর্থনৈতিক মহামন্দা: ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট বা মহামন্দা দেখা দেয়। এতে ব্রিটিশ শিল্পের অগ্রগতিও যথেষ্ট ব্যাহত হয়। এই সুযোগে ভারতে শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করে।
4 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব: ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু বন্ধ হলে যুদ্ধের প্রয়োজনে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ব্রিটেন-সহ বিভিন্ন দেশ বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ইউরোপে শিল্পের উৎপাদন ও অগ্রগতি এলান দারুণভাবে ব্যাহত হয়। ইউরোপীয় শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সুযোগে দ্য ভারতে শিল্পের বিকাশ সম্ভব হয়।
5 দেশীয় পুঁজিপতিদের ভূমিকা: শিল্পের বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত মূলধনের বিনিয়োগ একান্ত অপরিহার্য। ইতিপূর্বে ভারতের শিল্পায়নের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় মূলধনের বিনিয়োগ হয়েছিল। কিন্তু বিংশ শতকের প্রথম থেকে এদেশের শিল্পায়নে ভারতীয় পুঁজিপতি ও শিল্পপতিরাও যথেষ্ট পরিমাণে মূলধন বিনিয়োগ করতে থাকে।
শিল্পের অগ্রগতিতে সরকারি উদ্যোগ
1 শিল্প কমিশন নিয়োগ: ভারত সরকার ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে স্যার টমাস হল্যান্ড-এর নেতৃত্বে একটি শিল্প কমিশন গঠন করে। এই কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে শিল্পের প্রসার ও ব্যাবসাবাণিজ্যে ভারতীয় মূলধন বিনিয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা।
12 কমিশনের সুপারিশ: সরকার কর্তৃক নিযুক্ত শিল্প কমিশন ভারতে শিল্পের প্রসারের জন্য সরকারকে 'উৎসাহমূলক হস্তক্ষেপ' নীতি গ্রহণের সুপারিশ করে। ভারতে শিল্পের অগ্রগতির প্রয়োজনে কমিশন সরকারকে যেসব বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেয়, সেগুলি হল-[i] যানবাহন ও যোগাযোগ, [ii] সর্বভারতীয় ও প্রাদেশিক শিল্পবিভাগ প্রতিষ্ঠা, [iii] কারিগরি শিক্ষার প্রসার, [iv] বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি চাকরিগুলির সুষ্ঠু সমন্বয় প্রভৃতির উদ্যোগ নিতে হবে।
3 সরকারি রিপোর্টের ভুমিকা: ব্রিটিশ সরকার ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে ভারতে শিল্পের বিকাশের সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। যদিও মন্টেগু-চেমসফোর্ডের সুপারিশ আইন হিসেবে গৃহীত হয়েছিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে।
4 সংরক্ষণ নীতি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের শিল্পগুলিকে বিদেশি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এদেশের শিল্পপতি ও জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে। ফলে সরকার ভারতের শিল্পক্ষেত্রে কিছু কিছু সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করে। লোহা, ইস্পাত, কাগজ, সুতিবস্ত্র, চিনি, লবণ, দেশলাই প্রভৃতি শিল্পপণ্যের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক কিছুটা কমানো হয়। এর ফলে ভারতে শিল্পের বিকাশ শুরু হয়।
👉Paid Answer ( For Membership User)
Editing by- Rita Moni Bora