Lesson 1
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
-----------------------------------
Long Answer Question
উত্তরঃ বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতার ধারণা: বিশ্বায়ন বা 'Globalisation' বিষয়টিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট বাক্যে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। বিশ্বায়ন একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। তবে বিশ্বায়ন কোনো আকস্মিক প্রক্রিয়া নয়; তা বহু পূর্ব থেকেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল।
বিশ্বায়নের ধারণা
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তির পরে বিশ্বায়ন পরিভাষাটির প্রয়োগ নতুন মাত্রা পায়। জোসেফ স্টিগলিৎস-এর মতে, বিশ্বায়ন হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়া। অনেকে একে নয়া উদারনৈতিক বিশ্বায়ন (Neo-Liberal Globalisation) বলে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নকে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। রোলান্ড রবার্টসনের মতে, বিশ্বায়ন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা সম্প্রসারণের ধারণার সঙ্গে জড়িত। এককথায় বলতে গেলে বিশ্বায়ন হল বিশ্বব্যবস্থা সম্প্রসারণের এমন এক প্রক্রিয়া যার দ্বারা রাষ্ট্র-সংক্রান্ত সমস্ত সংকীর্ণ ধারণার অবসান ঘটে এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অবাধ আদানপ্রদানের পথ সুগম হয়। পুঁজির অবাধ চলাচল, মুক্ত বাজার অর্থনীতি, উদারীকরণ এবং বেসরকারিকরণ প্রভৃতি বিষয় বিশ্বায়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
সার্বভৌমিকতার ধারণা
আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক ও তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান হল সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা বোদাঁর মতে, "Sovereignty is the supreme and perpetual power of state"। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা চরম, অবাধ, অসীম এবং অবিভাজ্য। রাষ্ট্র ছাড়া কোনো সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ভোগ করার অধিকার নেই। সার্বভৌমিকতার দুটি দিক রয়েছে। একটি হল অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা এবং অপরটি হল বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা অনুসারে রাষ্ট্র তার সীমানার মধ্যে চরম ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের নিজস্ব ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ বা নির্দেশ অনুসারে আইন ব্যক্তি, সংঘ বা প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে সবার ওপর প্রযোজ্য হয়। অন্যদিকে, বাহ্যিক সার্বভৌমিকতার ধারণায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্রের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তার কথা তুলে ধরা হয়।
সার্বভৌমিকতার ধারণার ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব
[1] জাতি-রাষ্ট্রের সংকট: রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের (Nation State) সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। জাতি-রাষ্ট্রগুলির সাবেকি চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি 'বাজারকেন্দ্রিক সংগঠনে' পরিণত করেছে।
[2] সার্বভৌমিকতার চিরাচরিত ধারণার অবসান: অধ্যাপক হলটন তাঁর Globalisation and the Nation Stateগ্রন্থে জাতি-রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, জাতি-রাষ্ট্রগুলি যে পৃথিবীতে বাস করে তার পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিশ্বায়ন হল এই পরিবর্তনের একটি প্রধান উৎস। বিশ্বায়নের বিভিন্ন দিক জাতি-রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা ও পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন সাধন করেছে। এই ধরনের পরিবর্তন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমত্বের চিরাচরিত ধারণার অবসান ঘটাতে পারে।
[3] রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ: জোশেফ এস নাই এবং জন ডি জোনাহিউ তাঁদের Governance as a Globalisation World নামক এক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, বিশ্বায়নের যুগে মূলধনের সচলতা(Mobility of Capital), এক দেশ থেকে অন্য দেশে দক্ষ শ্রমিকের নির্গমন, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অর্থ ও শেয়ার হস্তান্তর ইত্যাদি বিষয়গুলির আধিক্য লক্ষ করা যায়। এই বিষয়গুলি সরকারের কর আরোপ করার চিরাচরিত ক্ষমতাকে ব্যাহত করেছে।
[4] স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতির বিপন্নতা: অনেকে মনে করেন, বিশ্বায়নের ফলে সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রভাবে সমস্ত দেশের অর্থনীতি পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। মূলধন ও প্রযুক্তির বিশাল প্রবাহ পণ্য ও পরিসেবার বাণিজ্যকে সমৃদ্ধতর করেছে। ফলে বিভিন্ন জাতীয় রাষ্ট্রের অর্থনীতি পরস্পরের সঙ্গে সংযোজিত হয়ে সমগ্র বিশ্বে এক অখণ্ড বাজারের প্রবর্তন করেছে। বহুজাতিক সংস্থা, শক্তিশালী আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বৃহদাকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যব্যবস্থা একুশ শতকের বিশ্ব-অর্থনীতির মুখ্য পরিচালক ও নিয়ন্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যেবিশ্বব্যাংক,আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলির অর্থনীতি ও উন্নয়ন এদের নীতি ও নির্দেশিকার ওপর নির্ভরশীল। এভাবে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ফলে জাতি- রাষ্ট্রের স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি বিপন্নতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি কাঠামোগত সংস্কার, সরকারি ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণ, ভরতুকি প্রত্যাহার, কর্মী সংকোচন প্রভৃতি নীতির রূপায়ণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
[5] রাষ্ট্রব্যবস্থার মর্যাদা হ্রাস: বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থা তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা নয়া আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অবলুপ্ত হতে বসেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। বস্তুত, বিশ্বায়নের প্রভাবে একদিকে পৃথিবীতে ক্রমাগত আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে, জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থাগুলির সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এই পটভূমিকায় সার্বভৌমত্বের সাবেকি ব্যাখ্যা অচল হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হল, বিশ্বায়ন শুধুমাত্র স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করেনি, বিশ্বায়ন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক, সামাজিক, জাতীয় এবং আঞ্চলিক পরিকাঠামোকে পরিবর্তিত করেছে। নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের চিরাচরিত ক্ষমতা বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
প্রশ্ন 2. বিশ্বায়নের প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল আলোচনা করো।
উত্তরঃ বিশ্বায়নের প্রতিক্রিয়া: বিশ্বায়ন বা 'Globalisation' সম্পর্কে সারা বিশ্ব জুড়ে বিতর্ক এখনও বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি সর্বজনীন নীতি হিসেবে বিশ্বায়ন রাজনীতির চিন্তাবিদদের কাছে সর্বসম্মতভাবে আজও গৃহীত হয়নি। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরেই এক প্রবল প্রতিরোধের উদ্ভব ঘটে। বস্তুত বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়ার কথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে-① রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া বা বিশ্বায়ন-সংক্রান্ত নীতির প্রবল বিরোধিতা, ② উদারনৈতিক ও নয়া উদারনৈতিক প্রতিক্রিয়া, ও সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া। উদারনৈতিক ও নয়া উদারনৈতিক প্রতিক্রিয়া উদারনৈতিক ও নয়া উদারনৈতিক চিন্তাবিদরা বিশ্বায়ন সংক্রান্ত নীতিকে সমর্থন জানিয়ে এক মুক্ত সমাজের কথা প্রচার করেন। তাঁদের মতে, বিশ্বায়ন হল সীমারেখাহীন মুক্ত সমাজের স্বপ্নের বাস্তবরূপ (Globalisation is the fulfilment of the dream of a free society without boundaries.)। বস্তুত উনিশ শতকের যে সকল ইউরোপীয় চিন্তাবিদ অন্ধবিশ্বাস ও প্রচলিত ধারণার বদলে যুক্তির আলো দিয়ে মানবসমাজের প্রকৃতি উন্মোচন করতে গিয়ে Enlightenment বা আলোকপ্রাপ্তির কথা বলেন, বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের উদারনৈতিক চিন্তাবিদরা অনুরূপভাবে বিশ্বায়নের মাধ্যমে এক মুক্ত দুনিয়ার স্বপ্ন দেখেন।
রক্ষণশীল ও সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া
বিশ্বায়ন বা Globalisation-এর বিরোধিতা শুরু হয় ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে সিয়াটেলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের তৃতীয় সম্মেলনে। পরবর্তীকালে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে কাতারের রাজধানী দোহায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার চতুর্থ সম্মেলনে এবং সাম্প্রতিককালে মেক্সিকোর রাজধানী কানকুনে পঞ্চম সম্মেলনে এই বিরোধিতা প্রবল আকার ধারণ করে। সমগ্র বিশ্বের প্রতিবাদী সংগঠনগুলিকে নিয়ে বিশ্ব সামাজিক মঞ্চ (World Social Forum) গঠিত হয়। অতি সম্প্রতি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে বিশ্ব সামাজিক মঞ্চের সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়ে Globalisation and its Discontents শীর্ষক গ্রন্থের লেখক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোশেফ স্টিগলিৎস (Joseph Sti- glitz) নয়া উদারনীতিবাদী বিশ্বায়নকে কার্যত 'দারিদ্র্যের বিশ্বায়ন' আখ্যা দিয়ে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, 'নয়া উদারনৈতিক বিশ্বায়ন শুধু যে অর্থনৈতিক বিকাশের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, এই বিশ্বায়ন অনিশ্চয়তাও সৃষ্টি করেছে' (Neo-liberal Globalisation has not only failed to pro- duce the economic growth it set out to achieve but also increased insecurity)।
স্টিগলিৎস-এর মতে, বিশ্বায়নের নীতি বাজার মৌলবাদের লক্ষ্যে পরিচালিত, এখানে পণ্য ও বাজার হল শেষ কথা। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank), বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization) দরিদ্রদের জন্য নিরাপত্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করার কথা বললেও এই সংস্থাগুলি যে নীতি নিয়ে চলেছে তাতে গরিবরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই এই বিশ্বায়ন হল দারিদ্র্যের বিশ্বায়ন।
বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব পর্যালোচনা করতে গিয়ে নিম্নলিখিত উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলির কথা তুলে ধরা যেতে পারে-
[1] উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য: বিশ্বায়নের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বিশ্বায়নের নীতি উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ উন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এডওয়ার্ড এস হারমানের মতে, বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশে বসবাসকারী পৃথিবীর ২০ শতাংশ জনগণের আয়ের ফারাক ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ৩০:১ থেকে বেড়ে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ৮২:১ হয়েছে।
[2] বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের (TRIPS) প্রয়োগ:বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার জন্য বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের যে চুক্তি বলবৎ করেছে তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি এই অধিকার অনুযায়ী পেটেন্ট,কপিরাইট,ট্রেডমার্ক,ব্যাবসায়িক গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয়গুলি কতটা নিজেদের এক্তিয়ারে সংরক্ষিত রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও তারা টিকে থাকতে পারছে না।
[3] কর্পোরেট বিশ্ব বা বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য: বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা (Trade Related Investment Mea- sures or TRIMS) গৃহীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে এই ব্যবস্থা অনুযায়ী এমন কতকগুলি বিধান পালন করতে হয় যার ফলে বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের কর্তৃত্ব বিস্তারের সুযোগ লাভ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নত দেশসমূহের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের বৃহত্তম বহুজাতিক সংস্থাগুলির মধ্যে ৬১ শতাংশ মার্কিনি সংস্থা, ৩৩ শতাংশ ইউরোপীয় এ সংস্থা এবং ২ শতাংশ জাপানি সংস্থা।সারা বিশ্বজুড়ে এই বৃহত্তম বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশসমূহের ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ বা সংযুক্তির ও মাধ্যমে দখল করে নিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে।
[4] নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং উত্তর-দক্ষিণ সংঘাত: বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা উন্নত ও ধনী দেশগুলির কুক্ষিগত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং উত্তর-দক্ষিণ সংঘাতের উদ্ভব ঘটেছে। উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। এর ফলে ধনী দেশগুলি কর্তৃক গরিব দেশগুলির শোষণ অব্যাহত রয়েছে। উন্নত দেশসমূহের কর্তৃত্বাধীন বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর শ্রমখরচ (Labour Cost) সংক্রান্ত বিধান, অভিন্ন - শ্রমিক স্বার্থ সম্পর্কিত নীতিগ্রহণ, কৃষিক্ষেত্রে ভরতুকি কমানো প্রভৃতি বিষয়ে - চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, তার ফলে উত্তর (উন্নত) বনাম দক্ষিণ (উন্নয়নশীল) সংঘাত দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মোগেনস বুদ্ধ হানসেনের মতে, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা নির্দেশিত উদার অর্থনৈতিক পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে।
[5] কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের ফলাফল: আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে উন্নয়নশীল দেশসমূহ যে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস (Structural Adjustment)-এ হাত দেয়, তার ফলে ব্যাপকভাবে কর্মী সংকোচন, ছাঁটাই, লে অফ, লক আউট, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ, জাতীয় ব্যয়ের সংকোচন ইত্যাদি করা হয়। কাঠামোগত এই পুনর্বিন্যাসের ফলে বেকারি, দারিদ্র্য, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সমাজের অনগ্রসর ও দুর্বল শ্রেণির মানুষরা।
[6] সাংস্কৃতিক সমতার প্রভাব: বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক সমতা তৈরির চেষ্টা চলেছে। ইনটারনেট-সহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির নিরন্তর প্রচারের ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হতে বসেছে। বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সমতা চাপিয়ে দিতে চায়। অনেকে একে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।
[7] জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সংকট: বিশ্বায়নের প্রভাবে জাতি-রা (Nation State)-এর সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তার নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নাগরিকবৃন্দের ওপর চূড়ান্তভাবে প্রযোজ্য হয়। বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের এই ভূখণ্ডকেন্দ্রিক সর্বব্যাপী ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি বাজারকেন্দ্রিক সংগঠনে পরিণত সা করেছে বলে মনে করা হয়। বস্তুত বিশ্বায়নের পটভূমিকায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অ প্রতিষ্ঠানগুলি রাষ্ট্র কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ সা লাভ করেছে। আধুনিক লেখকদের মতে, বিশ্বায়ন ক্রমশ রাজনৈতিক, সামাজিক is জাতীয় এবং আঞ্চলিক কর্তৃত্বের পরিকাঠামোকে পরিবর্তন করতে সক্ষম চর হয়েছে। এর ফলে সার্বভৌমত্বের ধারণার বদল ঘটেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভে লেখক হলটন (R Holton) তাঁর Globalisation and the Nation Stat অভ শীর্ষক গ্রন্থে এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন, "জাতি-রাষ্ট্র (Nation সাক State)-এর যে পৃথিবী তা বদলে যাচ্ছে, বিশ্বায়ন এক্ষেত্রে পরিবর্তনের বড়ে রাষ্ট্রে উৎস হিসেবে কাজ করছে, বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জাতি-রাষ্ট্রের ভূমিকাও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অন্যান্য ধারণাসমূহ বিশ্বায়নের প্রভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমত্বের সাবেরি স্বাধী ধারণাও বদলে যাচ্ছে।"
প্রশ্ন 3. নয়া বিশ্বব্যবস্থা বলতে কী বোঝায়? বিশ্বায়ন কীভাবে বিশ্বব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে চায়?
উত্তরঃ
প্রশ্ন 4. বর্তমান যুগে বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনা করো।
উত্তরঃ বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফলসমূহ:বিশ্বায়ন (Globalisation) একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। জোশেফ স্টিগলিৎস- এর মতে, বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনায় উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হল-
[1] উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বৈষম্যমূলক নীতির ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি উন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এডওয়ার্ড এস হারমানের মতে বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশে বসবাসকারী মানুষের আয়ের ফারাক ১৯৬০ সালে ৩০:১ থেকে বেড়ে ১৯৯৫ সালে ৮২:১-এ দাঁড়িয়েছে।
[2] বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের (TRIPS) প্রয়োগ: বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার জন্য বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের যে চুক্তি বলবৎ করেছে তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি এই অধিকার অনুযায়ী পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, ব্যাবসায়িক গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয় কতটা নিজেদের এক্তিয়ারে সংরক্ষিত রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও তারা টিকে থাকতে পারছে না।
[3] বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য বিস্তার: বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা (Trade Related Investment Measures or TRIMS) গৃহীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে। সারা বিশ্ব জুড়ে বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে দখল করে নিয়ে তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। কোনো কোনো বহুজাতিক সংস্থার বার্ষিক আয় একটি রাষ্ট্রের জাতীয় আয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, মার্কিনি বহুজাতিক সংস্থা জেনারেল মোটরসের বার্ষিক আয় নরওয়ের জাতীয় আয়কে অতিক্রম করেছে। আবার মার্কিনি তেল সংস্থা এক্সনের বার্ষিক আয় ভেনেজুয়েলার জাতীয় আয়ের চেয়ে অনেক বেশি।
[4] নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতির এবং উত্তর-দক্ষিণ সংঘাতঃ বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা উন্নত ও ধনী দেশগুলির কুক্ষিগত হওয়ায় রা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং 'উত্তর-দক্ষিণ' সংঘাতের অ উদ্ভব ঘটেছে। উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে সম্পূর্ণ বি নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছে। উন্নত দেশগুলির কর্তৃত্বাধীন বিশ্ববাণিজালে সংস্থা যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর শ্রমখরচ (Labour Cost) সংক্রান্ত বিধান, অভিন্ন শ্রমিক স্বার্থ সম্পর্কিত নীতিগ্রহণ, কৃষিক্ষেত্রে ভরতুকি কমানো প্রভৃতি বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, তার ফলে উত্তর (উন্নত) বনাম দক্ষিণ (উন্নয়নশীল) সংঘাত তীব্রতর হয়ে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মোগেনস বুখ হানসেনের মতে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নি নির্দেশিত উদার অর্থনৈতিক পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে- অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে।
[5] সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে উন্নয়নশীল দেশগুলি যে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস (Structural Adjustment)-এ হাত দিয়েছে তার ফলে ব্যাপকভাবে কর্মী সংকোচন, ছাঁটাই, লে অফ, লক আউট, রাষ্ট্রায়ত ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ, জাতীয় ব্যয়ের সংকোচন ইত্যাদি পন্থা অনুসৃত হচ্ছে। কাঠামোগত এই পুনর্বিন্যাসের ফলে বেকারত্ব, দারিদ্র্য প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছে।
[6] সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংকট: বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক সমতা তৈরির চেষ্টা চলেছে। ইনটারনেট-সহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির নিরন্তর প্রচারের ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হতে বসেছে। বিশ্বায়ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সমতা চাপিয়ে দিতে চায়। অনেকে একে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতির আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।
[7] জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সংকট: বিশ্বায়নের প্রভাবে জাতি-রাষ্ট্রের (Nation State) সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তার নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নাগরিকবৃন্দের ওপর চূড়ান্তভাবে প্রযোজ্য হয়। বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের এই ভূখণ্ডকেন্দ্রিক সর্বব্যাপী ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি 'বাজারকেন্দ্রিক সংগঠনে' পরিণত করেছে। এর ফলে সার্বভৌমত্বের ধারণার বদল ঘটেছে।
[৪] পরিবেশদূষণ: বিশ্বায়নের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বহুজাতিক সংস্থাগুলি এই সমস্ত এলাকায় যেসব শিল্প গড়ে তুলছে, সেগুলির কারণে যথেচ্ছভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বস্তুত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে - পরিবেশের ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের মতো কোনো কঠোর আইন এখানে না থাকায় বহুজাতিক সংস্থাগুলি খুব সহজেই এখানে পরিবেশদূষণকারী শিল্প গড়ে তুলতে পারছে। তা ছাড়া বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার অবাধ বাণিজ্যনীতির সুযোগে উন্নত দেশগুলির উৎপাদন কেন্দ্রের বর্জ্য পদার্থ উন্নয়নশীল দেশে পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে সেখানকার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
5. বিশ্বায়নের প্রকৃতি আলোচনা করো।
উত্তরঃ
6. বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
উত্তরঃ বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যাবলি: বিশ্বায়নের কতকগুলি অপরিহার্য ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
[1] বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংহতিসাধন: বিশ্বায়ন বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে নিবিড় সংহতি গড়ে তুলতে চায়। আধুনিক বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে একাকী বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বিশ্বায়ন এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটি অভিন্ন যোগসূত্র গড়ে তুলতে চায়।
[2] পারস্পরিক নির্ভরশীলতা: বিশ্বায়ন অত্যন্ত সচেতনভাবে সমগ্র বিশ্বে উন্নত ও উন্নয়নশীল
দেশ নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশের মধ্যে একটি পারস্পরিক নির্ভরশীলতার পরিবেশ গড়ে তোলার পক্ষপাতী। নোয়াম চমস্কির মতে, বিশ্বায়নের উদ্দেশ্য হল বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রের মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতা স্থাপন করে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে দৃঢ়তর করে তোলা।
[3] বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা: বিশ্বায়নের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট দুনিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে সুনিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকরা মনে করেন, বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পাশাপাশি কর্পোরেট সংস্থাগুলির ভূমিকাও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
[4] পুঁজি ও প্রযুক্তির অবাধ চলাচল: বিশ্বায়নের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে আধুনিক বিশ্বে পুঁজি ও প্রযুক্তির অবাধ চলাচলের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। বিশ্বায়নের যুগে পুঁজি, প্রযুক্তি ও কারিগরি কৃৎকৌশল কোনো একটি দেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে সীমায়িত হয়ে থাকেনি। বিশ্ববাণিজ্যের অবাধ গতি এই বিষয়টিকে আরও সহজ করে তুলেছে।
[5] মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা: বিশ্বায়নের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মুক্ত
বাজার অর্থনীতি। বিশ্বায়ন সারা বিশ্বের বাজারকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখতে চায়।
বিশ্বায়ন মনে করে যে, বাণিজ্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে অবাঞ্ছিত।
[6] রাষ্ট্রের সাবেকি সার্বভৌমত্বের পরিবর্তন: রাষ্ট্রের সাবেকি সার্বভৌম ক্ষমতার পরিবর্তনকে বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে মনে করা হয়। বাহ্যিক ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রের যে অসীম বা চরম ক্ষমতা রয়েছে সাবেকি সার্বভৌমিকতায় মনে করা হয়, বিশ্বায়ন তাকে অস্বীকার করে। বিশ্বায়নের যুগে বাহ্যিক ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রই অসীম ক্ষমতার অধিকারী নয়। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার আধুনিক বিশ্বে নয়া বিশ্বব্যবস্থার সদস্য হিসেবে ছোটো বড়ো সব রাষ্ট্রকেই বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (WTO) মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার নীতি নির্দেশ মেনে চলতে হয়। এই বাধ্যবাধকতা বিশ্বায়নের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
[7] তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি: বিশ্বায়নের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি। বিশ্বায়নের যুগে ইনটারনেট-সহ তথ্য প্রযুক্তির অবাধ বিচরণে জাতি-রাষ্ট্রের নিয়মকানুন কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে না। অনেকে মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়ে ইনটারনেট বিপ্লবের মাধ্যমে জাতি-রাষ্ট্রের সীমারেখাকে নিশ্চিহ্ন করে বিশ্বায়ন এক জাতি এক বিশ্বের এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে।
7.বর্তমান যুগে বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনা করো।
উত্তরঃ বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফলসমূহ: বিশ্বায়ন (Globalisation) একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। জোশেফ স্টিগলিৎস- এর মতে, বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনায় উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হল-
[1] উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বৈষম্যমূলক নীতির ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি উন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এডওয়ার্ড এস হারমানের মতে বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশে বসবাসকারী মানুষের আয়ের ফারাক ১৯৬০ সালে ৩০:১ থেকে বেড়ে ১৯৯৫ সালে ৮২:১-এ দাঁড়িয়েছে।
[2] বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের (TRIPS) প্রয়োগ: বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার জন্য বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের যে চুক্তি বলবৎ করেছে তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি এই অধিকার অনুযায়ী পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, ব্যাবসায়িক গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয় কতটা নিজেদের এক্তিয়ারে সংরক্ষিত রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও তারা টিকে থাকতে পারছে না।
[3] বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য বিস্তার: বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা (Trade Related Investment Measures or TRIMS) গৃহীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে। সারা বিশ্ব জুড়ে বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে দখল করে নিয়ে তাদের
ওপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। কোনো কোনো বহুজাতিক সংস্থার বার্ষিক আয় একটি রাষ্ট্রের জাতীয় আয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, মার্কিনি বহুজাতিক সংস্থা জেনারেল মোটরসের বার্ষিক আয় নরওয়ের জাতীয় আয়কে অতিক্রম করেছে। আবার মার্কিনি তেল সংস্থা এক্সনের বার্ষিক আয় ভেনেজুয়েলার জাতীয় আয়ের চেয়ে অনেক বেশি।
8. জাতীয় স্বার্থের উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ করো। জাতীয় স্বার্থরক্ষার পদ্ধতিগুলি কী কী?
উত্তরঃ জাতীয় স্বার্থের উপাদানসমূহ:আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকদের মতে, জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত ধারণাটি একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। জাতীয় স্বার্থের উপাদানগুলিও তাই। কোনো
একটিমাত্র উপাদানের সাহায্যে জাতীয় স্বার্থ তৈরি হয় না। জাতীয় স্বার্থের বহুবিধ উপাদান রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
[1] ভৌগোলিক অখণ্ডতা: দেশের প্রতিরক্ষা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে নিয়ে জাতীয় স্বার্থের
প্রধান উপাদান গঠিত হয়। অনেকে একে জাতীয় নিরাপত্তা বলে অভিহিত করেছেন। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে একটি দেশ সমস্ত রকমেরবৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে চায়। এই কারণে যে-কোনো মূল্যে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার বিষয়টিকেই আধুনিক বিশ্বের দেশগুলি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।
[2] আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান: জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান। বিশ্বের ছোটো বড়ো বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে মেলবন্ধন করাই হল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ, সে ছোটো-বড়ো যাই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বাইরে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকতে পারে না। তাই জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিকে সামনে রেখে বিদেশনীতি অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে চায়।
[3] অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে অর্থনীতির ক্ষেত্রটি নতুন মাত্রা লাভ করেছে। প্রতিযোগিতানির্ভর বিশ্ববাণিজ্যে নিজের স্থান অক্ষুণ্ণ রাখা, বহির্বাণিজ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার অর্জন করা, অবাধ বাণিজ্য ও বিদেশি পুঁজি লগ্নির সুযোগ গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়ে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রের বিপুল আগ্রহ লক্ষ করা যায়।
[4] সাংস্কৃতিক বিনিময়: জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন
রাষ্ট্রের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান যুগে কূটনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষার পরে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বায়নের নয়া ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের বিষয়টি আরও সহজতর হয়েছে। বিদেশের মাটিতে মেলা, উৎসব, প্রদর্শনী, আলোচনাচক্র ইত্যাদিঅনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথ প্রশস্ত করা হয়। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সাহায্যে এক দেশ অন্য দেশের কাছে তার সংস্কৃতির প্রচারের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত
করে জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্য পূরণ করতে চায়।
[5] আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি দেশ বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সংগঠনে কতখানি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছে তার ওপর সেই দেশের জাতীয় স্বার্থপূরণের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভরশীল।এই কারণে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান বিশ্বে যেসব আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে উঠেছে, সেখানে জাতীয় স্বার্থপূরণের বিষয়টি একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন,
আসিয়ান, সার্ক, ওপেক, আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়।
[6] বিশ্বজনমত: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিশ্বজনমতের কথা উল্লেখ করা হয়। আন্তর্জাতিক সংকটের মোকাবিলায় বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশ্বজনমত গঠনের মাধ্যমে নিজেদের জাতীয় স্বার্থপূরণের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে এই ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাসবাদ কবলিত বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বিশ্বজনমত গঠনে প্রয়াসী হয়েছে। এই প্রসঙ্গে, ২০১১ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাই বিস্ফোরণের পরে পাক সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো বৃহৎ শক্তিগুলির কাছে ভারত বারে বারে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের স্বরূপ তুলে ধরতে চেয়েছে।পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় স্বার্থের উপাদানগুলিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ছোটো-বড়ো সব রাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্ব দিলেও কখন কোন্ উপাদানকেপ্রাধান্য দেওয়া হবে তা অনেকটাই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। তবে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে জাতীয় স্বার্থের উপাদান একমুখী নয়, বহুমুখী।
তাই এক্ষেত্রে একটিমাত্র উপাদানের ভূমিকা যথেষ্ট নয়।
জাতীয় স্বার্থরক্ষার পদ্ধতিসমূহ
জাতীয় স্বার্থরক্ষার কতকগুলি বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
[1] পররাষ্ট্রনীতি: ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক নির্ধারক হল জাতীয় স্বার্থ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্র নিঃস্বার্থভাবে অপর কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না। মূলত জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
[2] প্রচার: প্রচারের সাহায্যে একটি দেশ তার জাতীয় স্বার্থসমন্বিত পররাষ্ট্রনীতির অনুকূলে অন্যান্য দেশের মতামত গড়ে তোলে। পররাষ্ট্রনীতি রূপায়ণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হল রাজনৈতিক প্রচার। প্রচারের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র তার গৃহীত নীতিকে বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চায়।
[3] জোটগঠন: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থরক্ষার অন্যতম একটি উপায় বা পদ্ধতি হল জোটগঠন। মূলত, জাতীয় স্বার্থপূরণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রগুলি জোটগঠন করে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির জোট ন্যাটো(NATO) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে গঠিত ওয়ারশ (Warsaw) জোটের কথা উল্লেখ করা যায়।
[4] অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ঋণ: অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলি তাদের জাতীয় স্বার্থপূরণের লক্ষ্যে কাজ করে। প্রধান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থরক্ষার কৌশল হিসেবে উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলিকে অর্থনৈতিক সাহায্য ও ঋণ প্রদান করে থাকে। এভাবে উন্নত দেশগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে ঋণগ্রহীতা উন্নয়নশীল দেশগুলির সমর্থন অতি সহজেই অর্জন করতে সক্ষম হয়।
[5] বলপ্রয়োগ: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিধর ও অতিবৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি অনেক সময় নিজেদের জাতীয় স্বার্থপূরণে অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর বলপ্রয়োগ বা বলপ্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন করে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, অতীতে নিকারাগুয়া, অ্যাঙ্গোলা, গ্রেনাডার ওপর এবং সম্প্রতি ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের ওপর মার্কিনি আগ্রাসনের কথা বলা যায়।
9. ক্ষমতা বা শক্তির (Power) সংজ্ঞা দাও। ক্ষমতার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো। ই এইচ কার শক্তিকে ক-টি ভাগে ভাগ করেছেন? আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ ক্ষমতা বা শক্তির সংজ্ঞা:আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার (Power) ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মুখ্য উপাদান হল শক্তি। সাধারণভাবে শক্তি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নয়া উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করা হয়।
[3] বহুত্ববাদ: আন্তর্জাতিক উদারনীতিবাদের একটি নতুন ধারা হল বহুত্ববাদ। ১৯৭০-এর দশকে বহুত্ববাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি মৌলিক তত্ত্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। বহুত্ববাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একক প্রাধান্যের জায়গায় বিভিন্ন ধরনের অ-রাষ্ট্রীয় (Non-state) আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ওপরে গুরুত্ব দেয়। বহুত্ববাদ মনে করে, আধুনিক সমাজে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সব ধরনের কাজকর্ম রাষ্ট্র একা করে উঠতে পারে না, রাষ্ট্রের পক্ষে এককভাবে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পরিসেবা দেওয়া সম্ভব নয়। বহুত্ববাদী লেখকদের মতে, আধুনিক আন্তর্জাতিক সমাজে এমন অনেক সমস্যা রয়েছে যার সমাধান রাজনীতিবিদের পক্ষে করে ওঠা দুষ্কর, এর জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞদের। বহুত্ববাদের অন্যতম প্রবক্তা ডে ভিড মিত্রানি এবং আর্নস্ট হাস আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিপূরক সত্তা হিসেবে দেখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট কেওহেন এবং জোশেফ নাই তাঁদের রচনায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাময়িক রাজনৈতিক দিকের বদলে অর্থনৈতিক সম্পর্কের দিকটির ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। বহুত্ববাদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি বা অতিবৃহৎ শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার দিকটিকেই তুলে ধরতে চায়। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপাদান হিসেবে রাষ্ট্রের পাশাপাশি অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থার ভূমিকা গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষণ করাই বহুত্ববাদের মূল উদ্দেশ্য।
[4] বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্ব: বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা হলেন ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন। এ ছাড়া এই তত্ত্বের সঙ্গে আরও যাঁদের নাম যুক্ত রয়েছে তাঁরা হলেন আন্দ্রে ফ্রাঙ্ক, রউল প্রেবিশ প্রমুখ। মূলত মার্কসবাদের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্ব পৃথিবীব্যাপী উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের মূল কারণ অনুসন্ধান করতে চায়। এর পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটনেও তাঁদের সমান আগ্রহ।
বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্ব মনে করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতার স্তরবিন্যাস মূলত অর্থনৈতিক কাঠামোর দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে থাকে। বিশ্বব্যবস্থা হল-বিশ্ব-অর্থনীতির এক প্রতিভূ মাত্র। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় অঞ্চল এবং প্রান্তিক অঞ্চলের পাশাপাশি সহাবস্থানের দিকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলি উন্নত অর্থনৈতিক কাজকর্মের ভরকেন্দ্র। এখানকার শিল্প, পরিসেবা, কৃষি সব কিছুই খুব উন্নত। অন্যদিকে প্রান্তিক অঞ্চলগুলি স্বভাবতই অনুন্নত। এদের ভূমিকা কাঁচামাল এবং সস্তা শ্রম বা শ্রমিক সরবরাহ করা। ওয়ালারস্টাইনের মতে, কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক অঞ্চলের সম্পর্ক প্রধানত শোষণমূলক। তবে বিশ্ব-ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্বের প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন, বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একদিন এমন এক সংকটে এসে দাঁড়াবে যেখানে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলির বিকল্প হিসেবে উঠে আসবে উন্নয়নশীল দুনিয়া। কাজেই | বিশ্বব্যবস্থার পুঁজিবাদী কাঠামো চিরস্থায়ী নয়, তার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
বা ক্ষমতা বলতে কোনো কিছু করার সামর্থ্যকে বোঝায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদ হ্যান্স জে মর্গেনথাউ তাঁর Politics Among Nations গ্রন্থে শক্তি বা ক্ষমতার সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন, শক্তি বা ক্ষমতা বলতে অন্যের মন ও কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণকে বোঝায়। তাঁর মতে, এক জাতির মন ও কাজের ওপর অন্য জাতির ক্ষমতা বা শক্তি প্রয়োগ হল জাতীয় শক্তি (National power)।
ক্ষমতা বা শক্তির প্রকৃতি:
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ কৌলম্বিস এবং উল্ল্ফ তাঁদের An Intro- duction to International Relations গ্রন্থে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, অবনতিতে সম্পদের যেমন গুরুত্ব, রাজনীতিতে ক্ষমতা বা শক্তির সেইরূপ গুরুত্ব। অবশ্য শক্তি ও বলপ্রয়োগ সমার্থক নয়। বলপ্রয়োগ বলতে কোনো জাতির সামরিক সামর্থ্যকে বোঝানো হয়। কিন্তু শক্তি বা ক্ষমতা আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। শক্তির সঙ্গে শুধুমাত্র বলপ্রয়োগের মতো নেতিবাচক ধারণা জড়িত থাকে না, অনেক ইতিবাচক ধারণাও যুক্ত থাকে। যেমন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অথবা অর্থনৈতিক সাহায্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে সহযোগিতামূলক কাজকর্মের মাধ্যমে নিজের বক্তব্যের অনুকূলে অন্যকে নিয়ে আসা ইত্যাদি। অনেকে শক্তি ও প্রভাবকে সমার্থক মনে করেছেন। কিন্তু প্রভাব ও শক্তি সমার্থক নয়। কৌলম্বিস এবং উল্ফের মতে, শক্তি বা ক্ষমতা হল প্রভাব ও বলপ্রয়োগের মধ্যবর্তী একটি ধারণা। শক্তি বা ক্ষমতার সঙ্গে সামর্থ্যের বিষয়টিও জড়িত।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার ধারণার সঙ্গে দুটি অনুমান যুক্ত রয়েছে। সেগুলি হল-① ক্ষমতা বা শক্তি বলতে যুদ্ধ করার ক্ষমতা বা সামরিক সামর্থ্যকে বোঝায়। ② শক্তি বা ক্ষমতাকে পরিমাপ করা যায়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক পারমাণবিক যুগে এই দুটি অনুমান অচল। অর্গানস্কি প্রমুখের মতে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু বোধগম্যহীন উপাদান ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত থাকায় এর পরিমাপ করা কষ্টসাধ্য। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশের সরকারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক ক্ষমতার গুরুত্ব থাকলেও অসামরিক উপাদানের গুরুত্বও কম নয়।
বিশ্বরাজনীতিতে শক্তি বা ক্ষমতার ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই বিশ্বরাজনীতি আবর্তিত হয়। আর এই ক্ষমতার মাপকাঠিতেই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে অতিবৃহৎ শক্তি, বৃহৎ শক্তি, মাঝারি শক্তি, ক্ষুদ্র শক্তি ইত্যাদি স্তরে বিন্যস্ত করা হয়।
শক্তি বা ক্ষমতার শ্রেণিবিভাজন: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার শ্রেণিবিভাজন করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিখ্যাত লেখক ই এইচ কার তিনটি প্রধান ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল- [1] সামরিক শক্তি, [2] অর্থনৈতিক শক্তি এবং [3] জনমত গঠনের শক্তি।
[1] সামরিক শক্তি: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্র কতটা শক্তিশালী তা প্রধানত রাষ্ট্রের সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। অতীতের মতো বর্তমানেও যে রাষ্ট্র সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী সেই রাষ্ট্রকে অতিবৃহৎ শক্তির (Super Power) মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। জোশেফ ফ্র্যাঙ্কেল তাঁর International Relations গ্রন্থে বলেছেন যে, কোনো রাষ্ট্রের কামান ও বিমানের সামর্থ্য না থাকলে নরম ধাঁচের কূটনীতিও সফল হতে পারে না।
[2] অর্থনৈতিক শক্তি: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামরিক শক্তির মতো অর্থনৈতিক শক্তিও একটি বিচার্য বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের মতে যুদ্ধ ও শান্তি যে সময়ই হোক না কেন, অর্থনৈতিক সামর্থ্যের প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিরক্ষাজনিত প্রস্তুতি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, প্রযুক্তিবিদ্যা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতি প্রভৃতি বিষয়ে অর্থনৈতিক শক্তি একান্ত আবশ্যক। এমনকি পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের জন্যও অর্থনৈতিক শক্তি বা ক্ষমতার প্রয়োজন আছে বলে অনেকে মনে করেন।
[3] জনমত গঠনের শক্তি: আধুনিককালে বিশ্বরাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে জনমত গঠনের বিষয়টিও শক্তি বা ক্ষমতার একটি উপাদানরূপে বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটা দেখা গেছে, যে রাষ্ট্রের হাতে বিশ্বজনমত গঠনের ক্ষমতা রয়েছে সেই রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অধিকতর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার গুরুত্ব: ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি চালিত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল পারে না।
[1] আন্তর্জাতিক রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, ক্ষমতা সম্পর্কিত ধারণা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে খুবই প্রাসঙ্গিক। জাতীয়তাবাদ ও সার্বভৌমত্বের মতো জাতীয় শক্তিকে তাঁরা রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী লেখকদের মতে, ক্ষমতা বা শক্তি হল এমন একটি মাধ্যম যার সাহায্যে কোনো রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ নীতি ও পররাষ্ট্রনীতিকে বাস্তবে প্রয়োগ করে থাকে। ক্ষমতা অর্জন, প্রয়োগ এবং তার প্রতিষ্ঠা হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ তাঁর Politics Among Nations গ্রন্থে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ক্ষমতার লড়াই বলে আখ্যা দিয়েছেন।
[2] রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণকারী: রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে ক্ষমতা বা শক্তির ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে রাষ্ট্রগুলিকে 'শক্তি' (Power) বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন-ক্ষুদ্র শক্তি, মাঝারি শক্তি, বৃহৎ শক্তি ও অতিবৃহৎ শক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন অতিবৃহৎ শক্তি (Super power) হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একক মহাশক্তিধর রাষ্ট্ররূপে আবির্ভূত হয়েছে।
[3] পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলির পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য হল ক্ষমতা অর্জন করা। মর্গেনথাউ-এর মতে, শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের লক্ষ্যপূরণের জন্য ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে থাকে। বস্তুত, ক্ষমতা অর্জন না করতে পারলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে তার অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ছোটো-বড়ো প্রতিটি রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ক্ষমতা অর্জন করা।
👉Paid Answer (For Membership User)
Editing by- Rita Moni bora