অধ্য়ায়-৫
কয়েকটি প্রধান রাজনৈতিক মতাদর্শ
Some Major Political Doctrines
👉Paid Answer (For Membership User)
Long Answer Question
প্রশ্ন 1. আধুনিক উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করো। অথবা, সংশোধনমূলক উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
উত্তরঃ আধুনিক উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ-উনবিংশ শতকের শেষ দশকে সাবেকি উদারনীতিবাদ তার গুরুত্ব অনেকটা হারিয়ে ফেলে। এই সময় টি এইচ গ্রিন, ম্যাক্সইভার এবং ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইতিবাচক ধারণা নিয়ে উদারনীতিবাদের নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। একে ইতিবাচক বা আধুনিক উদারনীতিবাদ (Positive or Modern Liberalism) বলা হয়।
[1] রাষ্ট্র সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ: ইংল্যান্ডের ভাববাদী দার্শনিক টি এইচ গ্রিন বলেন, জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি, বলপ্রয়োগ নয় (Will, not force, is the basis of State.)। গ্রিন রাষ্ট্রকে সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ বলে বর্ণনা করেন। গ্রিনের মতে, রাষ্ট্র কখনও নিজেই নিজের লক্ষ্য হতে পারে না। রাষ্ট্র হল ব্যক্তিবর্গের পূর্ণ নৈতিক বিকাশের হাতিয়ার মাত্র। গ্রিনের অভিমত তাঁর "সাধারণ ইচ্ছা"র ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি মনে করতেন সাধারণ ইচ্ছা তথা সদিচ্ছা প্রতিষ্ঠার জন্যই স্বাধীনতার প্রয়োজন। রাষ্ট্র এই সদিচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। রাষ্ট্র এর প্রতিবন্ধকতাসমূহ অপসারণ করবে। তাঁর মতে, নাগরিকরা নিজেদের স্বার্থরক্ষা ছাড়া অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পারে না। অবশ্য স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধাচরণ করাকে তিনি অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
[2] বহুত্ববাদী দৃষ্টিতে রাষ্ট্র: আধুনিক উদারনীতিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাক্সইভার, ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, ব্যক্তির বহুমুখী জীবনের সম্পূর্ণ বিকাশ রাষ্ট্র একা করতে পারে না। এজন্য মানুষ সমাজের অভ্যন্তরে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি সংঘ বা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে থাকে। রাষ্ট্রের মতো এইসব সংঘ বা > প্রতিষ্ঠানগুলি সমান গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন। এদেরও রাষ্ট্রের মতো সার্বভৌম ক্ষমতা + থাকা উচিত। বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র ব্যক্তির বাহ্যিক আচরণ ল নিয়ন্ত্রণ করলেও অন্তর্জীবনের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ম্যাক্সইভারের ভাষায়, 'পেনসিল কাটার জন্য কুঠার যেমন অনুপযুক্ত, সেরকম ব্যক্তির অন্তর্জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির বিকাশে রাষ্ট্রও অনুপযুক্ত।'
[3] রাষ্ট্র জনগণের সেবকঃ অধ্যাপক ম্যাক্সইভারের মতে, রাষ্ট্র জনগণের সেবা করে বলেই তার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। রাষ্ট্র সমাজের 'এজেন্ট' হিসেবে জনগণের অধিকারসমূহ সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র জনগণ অপেক্ষা বড়ো হতে পারে না। ম্যাক্সইভার ধর্ম, নৈতিকতা, প্রথা ও সংস্কৃতির ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন। রাষ্ট্রের কাজকর্মকে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ তথা কৃষি ও শিল্পের বিকাশসাধনে সীমিত রাখার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন।
[4] সমাজস্থ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষা: অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রকাশিত শীর্ষক গ্রন্থ 'The State in theory and practice'- এ রাষ্ট্রকে একটি জাতীয় সমাজ বলে অভিহিত করেন। রাষ্ট্র আইনসংগতভাবে বলপ্রয়োগের অধিকারী-এই ক্ষমতা সার্বভৌমিকতা নামে পরিচিত। ল্যাস্কির মতে, রাষ্ট্রকে সমাজস্থ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করতে হয়। জনগণের ব্যাপক অংশের সর্বাধিক পরিমাণ সামাজিক মঙ্গলসাধন রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। ল্যাস্কি অবশ্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকে জনগণের শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সপক্ষে রায় দেন।
[5] জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্ব: রাশিয়ায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরবর্তীকালে উদারনীতিবাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে উদারনীতিবাদের সমর্থকরা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র তত্ত্ব প্রচার করেন। সমাজতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যবর্তী পর্যায়ে অবস্থিত এই তত্ত্বে একটা মাঝামাঝি অবস্থার কথা বলা হয়। এই মতবাদে মিশ্র অর্থব্যবস্থা চালু করে জনকল্যাণ সাধন সম্ভব বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। জনকল্যাণকর রাষ্ট্রতত্ত্বে উদারনীতিবাদের মৌল নীতিগুলির মধ্যে নাগরিকদের রাজনৈতিক ও পৌর অধিকারের স্বীকৃতি, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, বহুদলীয় ব্যবস্থা, শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন প্রভৃতি গৃহীত হয়।
প্রশ্ন 2. উদারনীতিবাদের অর্থ ও সংজ্ঞা দাও। উদারনীতিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তরঃউদারনীতিবাদ:অর্থওসংজ্ঞা- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় উদারনীতিবাদের একটি সবিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। রাষ্ট্রের কার্যাবলি এবং প্রকৃতি-সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হল উদারনৈতিক মতবাদ। উদারনৈতিক মতবাদ দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চিন্তাভাবনায় বিকশিত হওয়ার ফলে এর কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করা একটি দুরূহ ব্যাপার। বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উদারনীতিবাদের সাধারণ অর্থ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠা। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার (Encyclopedia Britannica) বক্তব্য অনুযায়ী, উদারনীতিবাদ হল এমন এক ধারণা যা সরকারি কাজের নীতি ও পদ্ধতিরূপে, সমাজ গঠনের নীতিরূপে এবং ব্যক্তি ও সমাজের এক জীবনাদর্শরূপে 'স্বাধীনতা'-কে প্রতিষ্ঠিত করে (Liberalism is an idea committed to freedom as a method and policy in government, as an organizing principle in society, and a way of life for the individual and the community.)¹।
উদারনীতিবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে হবহাউস (Hobhouse) তাঁর 'Liberalism' গ্রন্থে বলেছেন, ব্যক্তিত্বের আত্মপরিচালনার ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সমাজ গঠনের আদর্শকে উদারনীতিবাদ বলে (Liberalism denotes an attitude which seeks to make possible those social conditions in which the individuality of all men may be best realised.)2। হ্যারল্ড ল্যাস্কি উদারনীতিবাদ বলতে স্বাধীনতার অনুশাসনকে বুঝিয়েছেন। উদারনীতিবাদ সংকীর্ণ ও ব্যাপক, এই দুই অর্থেই প্রযুক্ত হয়। সংবীর অর্থে উদারনীতিবাদ বলতে এমন এক তত্ত্বকে বোঝায় যা অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে প্রতিষ্ক করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা এবং রাজনৈতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শাসক প্রতিনিধিদের নির্বাচন ও অপসারণের ব্যাপারে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠা করা সংকীর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদের প্রধান উদ্দেশ্য। অন্যদিকে, ব্যাপক অর্থে উদারনীতিবাদ হল এমন এক মানসিক ধারণা যা ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পক্ষপাতী। বস্তুতপক্ষে সংকীর্ণ ও ব্যাপক, উভয় ক্ষেত্রেই উদারনীতিবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল স্বাধীনতা।
উদারনীতিবাদেরউৎপত্তিওবিকাশ- উদারনীতিবাদ এক প্রাচীন মতবাদ। গ্রিক দার্শনিকদের দুই প্রধান নীতি, চিন্তার স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে উদারনীতিবাদের সর্বপ্রথম উৎপত্তি ঘটে। যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে প্রাচীন গ্রিসে চিন্তার স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষের ছিল না। বস্তুতপক্ষে সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে উদারনীতিবাদ প্রথম বিকশিত হয়। সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসন ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে উদারনৈতিক মতবাদ জন্মগ্রহণ করে। ইউরোপে মধ্যযুগের নবজাগরণ আন্দোলন ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সাফল্যের ফলে উদারনীতিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে 'গৌরবময় বিপ্লবের' মাধ্যমে উদারনীতিবাদ একটি সুসংহত চেহারা লাভ করে।
অনেকেমনেকরেন, ইংল্যান্ডে উদারনীতিবাদের উদ্ভবের কারণ ছিল। শিল্পবিপ্লবের ফলাফল। শিল্পবিপ্লবের পর যে বণিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে, তারা রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই আরও ব্যাপক স্বাধীনতার দাবিদার হয়ে ওঠে। এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব লাভ করে। যুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লকের চিন্তাধারার মধ্যে উদারনৈতিক মতবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। লকের মতে, জনগণের সম্মতি হল রাষ্ট্রের মূলভিত্তি। ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ঘটানোর অধিকার রাষ্ট্রের নেই। রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতার পথে বাধাগুলি দূর করতে প্রয়াসী হবে। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণায় এবং ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণায় উদারনীতিবাদের আদর্শ বাস্তবরূপ লাভ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেরিমি বেত্থাম হিতবাদী দর্শনের সাহায্যে উদারনীতিবাদকে আরও প্রসারিত করেন। বেথামের মতে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা। উদারনীতিবাদের অপর এক প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ নীতি বা 'Laissez-faire'-এর ব্যাখ্যা দেন। তিনি নির্দিষ্ট কতগুলি কার্যাবলির মধ্যে রাষ্ট্রের কার্যকলাপকে সীমিত রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। পরবর্তীকালে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গ্রিন, ব্রাডলি, বোসানকের হাত ধরে উদারনীতিবাদ আরও সংশোধিত ও পরিবর্তিত হয়। উদারনীতিবাদের সমর্থকরা এই সময় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র তত্ত্ব প্রচার করেন।আধুনিক উদারনীতিবাদের মূলনীতি হিসেবে নাগরিকদের রাজনৈতিক ও পৌর অধিকারের স্বীকৃতি, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, বহুদলীয় ব্যবস্থা, শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন, অবাধ বাণিজ্যনীতি ইত্যাদি গৃহীত হয়।
প্রশ্ন 3.মার্কসবাদ কাকে বলে? মার্কসবাদের উৎসগুলি কী কী?
উত্তরঃ মার্কসবাদ- রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মার্কসীয় মতবাদ এক সর্বাধুনিক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। মার্কসবাদে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী রাজনৈতিক আলোচনা করা হয়নি। মার্কসবাদ সমগ্র মানবসমাজের বিকাশের ধারাকে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছে। এই দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ মৌলিক।
মার্কসবাদ বলতে কী বোঝায় এই সম্পর্কে এককথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। লেনিনের মতে, মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষামালাই হল মার্কসবাদ (Marx- ism is the system of the views and teachings of Marx)। এমিল বার্নসের মতে, আমাদের এই জগৎ এবং তার অংশ মানবসমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব হল মার্কসবাদ। কার্ল মার্কসের (১৮১৮-১৮৮৩ খ্রি.)নাম অনুসারে এর নামকরণ হয়েছে। বিগত শতাব্দীর (ঊনবিংশ) মধ্য ও শেষ ভাগে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে একযোগে মার্কস এই তত্ত্ব রচনা করেন। মানবসমাজের উৎপত্তি, বিকাশ, প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে মার্কস ও এঙ্গেলস এক গভীর অনুসন্ধানমূলক গবেষণায় লিপ্ত হন। এই গবেষণার শেষে তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে সামাজিক পরিবর্তন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। বহিঃপ্রকৃতি যেভাবে কতকগুলি পরিবর্তনের নিয়ম মেনে পরিবর্তিত হয়, সামাজিক পরিবর্তনও সেভাবে ঘটে থাকে। এই সত্যকে কেন্দ্র করে সমাজ সম্বন্ধে এক বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব কার্ল মার্কস গড়ে তোলেন এবং একে মার্কসবাদ বলা হয়। এই প্রসঙ্গে মিলিব্যান্ড-এর বক্তব্য অনুসরণ করে বলা যায় যে, মার্কস নিজে কখনও 'মার্কসবাদ' শব্দটি প্রয়োগ করেননি। মৃত্যুর পর (১৮৮৩ খ্রি.) এঙ্গেলস এই কথাটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে লেনিন তা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন।
মার্কসবাদের উৎস- মার্কসবাদ কোনো একটি উৎস থেকে সৃষ্টি হয়নি। মার্কসের চিন্তার উপাদানগুলি বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। মার্কসবাদের প্রধান তিনটি উৎস হল- ① জার্মান দর্শন, ② ব্রিটিশ অর্থশাস্ত্র এবং (3)ফরাসি সমাজতন্ত্র।
প্রথম উৎস হিসেবে জার্মান ভাববাদী দার্শনিক হেগেলের তত্ত্ব 'দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদ' মার্কসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অবশ্য মার্কস অপর একজন জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাখ (Feuerbach)-এর বস্তুবাদী চিন্তাধারা থেকেও অনুপ্রাণিত হন। এর ফলে তিনি হেগেল ও ফয়েরবাখের চিন্তার ইতিবাচক দিকগুলি নিয়ে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ রচনা করেন। মার্কসবাদের দ্বিতীয় উৎস হল ব্রিটিশ অর্থশাস্ত্র। রবার্ট ওয়েন (Robert Owen) ও উইলিয়াম টমসন (Wil- Liam Thompson)-এর রচনা, টমাস হজস্কিন (Thomas Hodgkin)-এর 'মূল্যের উৎস হল শ্রমিক' এবং অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) ও ডেভিড রিকার্ডো (David Ricardo)-র 'মূল্যের শ্রম-তত্ত্ব' মার্কসের 'উদ্বৃত্ত মূল্য'-এর তত্ত্বকে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। মার্কসবাদের তৃতীয় উৎস হল ফরাসি সমাজতন্ত্র। শ্রেণিসংগ্রাম এবং সাম্যবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠা-সম্পর্কিত তত্ত্ব রচনা করতে গিয়ে ফরাসি সমাজতন্ত্রী সাঁ সিমোঁ (Saint Simon), শার্ল ফুরিয়ে (Charles Fourier), কাবে (Cabot) প্রমুখের লেখা থেকে মার্কস প্রভাবিত হয়েছিলেন।
প্রশ্ন 4. মার্কসবাদের মূলসূত্রগুলি আলোচনা করো।
অথবা, মার্কসবাদের মূলসিদ্ধান্তগুলি লেখো।
উত্তরঃ মার্কসবাদের মূলসূত্র- এমিল বার্নসের মতে, মার্কসবাদ হল আমাদের এই জগৎ এবং তারই অংশ মানবসমাজ সম্বন্ধে সাধারণ তত্ত্ব। এর নামকরণ হয়েছে কার্ল মার্কস-এর (১৮১৮-১৮৮৩ খ্রি.) নামানুসারে। এই মতবাদের মূলসূত্রগুলি হল-
[1] দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল মার্কসীয় তত্ত্বের প্রধান ভিত্তি। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদ থেকে উপাদান গ্রহণ করলেও তা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল বক্তব্য হল জগৎ প্রকৃতিগতভাবে বস্তুময়। জগতের প্রতিটি বস্তু পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ও পরস্পরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই বস্তুজগৎ অনড় বা অচল নয়, তা সতত পরিবর্তনশীল। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তিনটি মৌলিক নিয়ম রয়েছে-
1. বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বিশ্বাস করে যে, প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে পরস্পরবিরোধী ধর্ম একই সঙ্গে অবস্থান করে। তার ফলে দেখা দেয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। যেমন পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিমালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব সমাজ পরিবর্তনের মূল কারণ হিসেবে কাজ করে।
ii. পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুসারে বিপরীতধর্মী শক্তিগুলির দ্বন্দ্বের ফলে বস্তুজগতে পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন ঘটে। এই গুণগত পরিবর্তন বস্তুর আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। মার্কসের মতে, পুঁজিবাদী সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আকস্মিকভাবে বিপ্লবের মাধ্যমে যে গুণগত পরিবর্তন ঘটে তার ফলে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পত্তন হয়। এভাবে সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন ঘটে।
iii. অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে পুরাতনের অস্বীকৃতি ছাড়া নতুনের আবির্ভাব ঘটতে পারে না। নতুন ক্রমে পুরোনো হয়। তখন তারও বদল ঘটে। এভাবে দাস সমাজব্যবস্থাকে অস্বীকার করে সামন্ড সমাজের বিকাশ, সামন্ত সমাজকে অস্বীকার করে পুঁজিবাদের বিকাশ, আবার পুঁজিবাদকে অস্বীকার করে সমাজতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।
[2] ঐতিহাসিক বস্তুবাদ: মার্কসের তত্ত্বের মূলনীতিগুলির মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।
i. মূল কাঠামো ও উপরিকাঠামো: মার্কস সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন প্রভৃতি চিন্তাধারা নয়, সমাজের মূল কাঠামো বা প্রকৃত বুনিয়াদ হল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এই বুনিয়াদের ওপর গড়ে ওঠে ধর্ম, নৈতিকতা, আইন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (যেমন রাষ্ট্র) ইত্যাদি যাবতীয় উপরিকাঠামো।
ii. মানব ইতিহাসের পরিবর্তনের কারণ: মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে, মানবসমাজের বিকাশের ইতিহাস হল উৎপাদন-ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস। মানবসমাজের পরিবর্তনের মুখ্য কারণ উৎপাদন-শক্তি এবং উৎপাদন-সম্পর্কের দ্বন্দ্ব। মার্কসের মতে, আদিম যৌথ সমাজজীবনে উৎপাদনের উপাদানের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় সমাজে শ্রেণিশোষণ ছিল না। দাস সমাজব্যবস্থায় দাসমালিকরা উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম করে। ক্রমে সামন্ত সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের মালিক হয়ে ওঠে সামন্তপ্রভুরা। যন্ত্রশিল্পের উদ্ভব ঘটলে সামন্ডসমাজের অবসান ঘটে এবং পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দ্বন্দ্ব ও সংকট তীব্র আকার ধারণ করলে বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজের অবসান এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন ঘটে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সবরকম শোষণের সমাপ্তি ঘটে। এভাবে মার্কস তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে সমাজবিবর্তনের ধারার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন।
[3] উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব: পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শোষণের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বের অবতারণা করা হয়।মার্কসের বক্তব্য হল যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও শ্রমের সংমিশ্রণে যে দ্রব্য উৎপাদিত হয় তার সমস্তটাই আসলে শ্রমিকের শ্রমের ফসল। পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদনের উপাদানের মালিক হল পুঁজিপতি শ্রেণি। জীবনধারণের জন্য তাদের কাছে শ্রমিকরা শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য থাকে। কিন্তু শ্রমিক সারা দিনের শ্রমে যা উৎপাদন করে সেই মূল্যের মাত্র সামান্য একটি অংশ সে মজুরি হিসেবে পায়। বাকি অংশটুকু উদ্বৃত্ত মূল্য হিসেবে থেকে যায়। এই উদ্বৃত্ত মূল্য শ্রমিক পায় না, তা যায় মালিকের কাছে। পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার উৎস হল এই উদ্বৃত্ত মূল্য। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, শ্রমিক তার মজুরির সমমূল্যের দ্রব্য উৎপাদন করতে যেটুকু সময় কাজ করে তাকে আবশ্যিক শ্রম-সময় বলে। বাকি উদ্বৃত্ত মূল্যটুকু তৈরি করতে শ্রমিককে যতটুকু অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয় তাকে উদ্বৃত্ত শ্রম-সময় বলে।
[4] শ্রেণিসংগ্রাম: মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখা 'দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'- র সূচনা বাক্যটি হল-'আজ পর্যন্ত (আদিম সাম্যবাদী সমাজের পর থেকে) যতগুলি সমাজ দেখা গেছে, তাদের সকলের ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।' মার্কসীয় দর্শনে শ্রেণি ও শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রেণি বলতে বোঝায় একই প্রণালীতে জীবনযাত্রা নির্বাহকারী সমাজের এক-একটি অংশ। যেমন-পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় যে গোষ্ঠী শ্রমদান করে, তাকে বলা হয় শ্রমিক শ্রেণি। মার্কসীয় মতে, বিনা সংগ্রামে বা সংঘাতে, মসৃণ পথে সমাজের পরিবর্তন ঘটে না, সমাজের বিকাশ ঘটে শ্রেণিসংগ্রামের ফলেই। তাই তাঁরা শ্রেণিসংগ্রামকে সমাজবিকাশের চালিকা শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। মার্কসীয় মত অনুসারে শ্রেণির বিভাজন দুই প্রকার-মুখ্য এবং গৌণ। যে শ্রেণিদের বাদ দিয়ে উৎপাদন-ব্যবস্থা চলতে পারে না তারা মুখ্য শ্রেণি। যেমন, পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণি। আর অন্যরা হল গৌণ শ্রেণি।অতীতকালে শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল না। মার্কসের মতে, পৃথিবীতে প্রথম শ্রেণিবিভক্ত সমাজ দেখা যায় দাস সমাজে। এই সমাজে দুটি মুখ্য শ্রেণি ছিল দাস ও দাসমালিক। দাস সমাজেই শুরু হল এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণির শোষণ। এই সমাজে দাস ও দাসমালিকদের মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্ব তীব্র হয়।
দাস সমাজের পরবর্তী পর্যায়ে সমাজ বিভক্ত হয় শোষক সামন্তপ্রভু ও শোষিত ভূমিদাস শ্রেণিতে। এই দুই শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিদ্বন্দ্বও চলতে থাকে। এরপর গড়ে ওঠে পুঁজিবাদী সমাজ। এই সমাজ বুর্জোয়া ও সর্বহারা, এই দুই পরস্পরবিরোধী শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শ্রেণিদ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে ওঠে এবং সর্বহারা শ্রেণি পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা উচ্ছেদের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংগ্রাম চালাতে থাকে। মার্কসীয় মতে পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হলে সর্বহারার একনায়কত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং শ্রেণিদ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে। পরিশেষে সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণিহীন এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
[5] রাষ্ট্র-সম্পর্কিত তত্ত্ব: মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের আবির্ভাব আকস্মিকভাবে ঘটেনি। উৎপাদন-ব্যবস্থার প্রকৃতিগত পরিবর্তনের ফলে সমাজবিবর্তনের একটি বিশেষ অধ্যায়ে রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এই সময়ে সমাজ সম্পত্তিবান শোষকশ্রেণি এবং সম্পত্তিহীন শোষিতশ্রেণি, এই দুই পরস্পরবিরোধী শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
i. বলপ্রয়োগ ও শ্রেণিশোষণের হাতিয়ার: মার্কসের মতে, সম্পত্তি- মালিকানার নিরাপত্তার জন্য যে বলপ্রয়োগমূলক হাতিয়ারের প্রয়োজন হয় তা হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র নামক হাতিয়ারের সাহায্যে সমাজে প্রভুত্বকারী সংখ্যালঘু সম্পত্তিবান শ্রেণি তার বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পত্তিহীন শ্রেণিকে শোষণ করে। এভাবে দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র উৎপাদন-ব্যবস্থার মালিকদের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠকে শোষণ করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
ii. রাষ্ট্র প্রকৃতির পরিবর্তন: মার্কসের মতে, বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ধ্বংসের ফলে 'সর্বহারার একনায়কত্ব' প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হবে। রাষ্ট্র সেখানে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে না, বরং সাম্যবাদী সমাজের ভিত্তি রচনা করবে।
iii. রাষ্ট্রের বিলুপ্তি: সাম্যবাদী সমাজে সবরকম শ্রেণিশোষণের সমাপ্তি ঘটার ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো প্রয়োজন থাকবে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে।
[6] বিপ্লবের তত্ত্ব: মার্কসের মতবাদ অনুযায়ী, বিপ্লব হল এমন এক সামাজিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে পুরোনো সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
i. বিপ্লবের কারণ: মার্কসবাদে বলা হয়েছে, বিপ্লবের কারণ হল প্রচলিত উৎপাদন-সম্পর্কের সঙ্গে নতুন উৎপাদিকাশক্তির বিরোধ। নতুন উৎপাদন-শক্তির সঙ্গে পুরোনো উৎপাদন-সম্পর্কের এই সংঘর্ষের ফলে পুরোনো সমাজব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
ii. বিপ্লবের চালিকাশক্তি: মার্কস বিপ্লবকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি (Loco- motive of History) বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, বিপ্লবের চালিকাশক্তি হিসেবে যে শ্রেণি কাজ করে তার মাধ্যমে বিপ্লবের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। যেমন-বুর্জোয়া বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি বুর্জোয়া শ্রেণি, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চালিকাশক্তি হল শ্রমিক ও কৃষক সম্প্রদায়।
iii. বিপ্লবের শর্ত: বিপ্লবের জন্য মার্কসীয় তত্ত্বে দু-ধরনের শর্তপূরণের কথা বলা হয়েছে-① বিষয়গত অবস্থা, ② বিষয়ীগত অবস্থা। বিষয়গত অবস্থা হল বৈপ্লবিক পরিস্থিতি। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনুসারে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই বৈপ্লবিক পরিস্থিতি না থাকলে বিপ্লব ঘটতে পারে না। অন্যদিকে বিষয়ীগত উপাদানগুলি হল জনগণের বৈপ্লবিক চেতনা ও সংগ্রামী মানসিকতা, বিপ্লবী রাজনৈতিক দল প্রভৃতি।
iv. বিপ্লবের প্রকৃতি: মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে বিপ্লব সবরকম সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক শোষণমুক্ত শ্রেণিহীন সমাজ গঠন করবে। বিপ্লব রক্তপাতহীন বা রক্তাক্ত, শান্তিপূর্ণ বা হিংসাত্মক উভয়ই হতে পারে। লেনিনের মতে, বিপ্লব হিংসার তাণ্ডব নয়, বিপ্লব হল উৎপীড়িত ও শোষিতের মহোৎসব।
v. বিপ্লবের প্রকারভেদ: দুই ভিন্ন ধরনের বিপ্লবের কথা মার্কসবাদে বলা হয়-সমাজতান্ত্রিক ও অসমাজতান্ত্রিক। এই দুই বিপ্লবের প্রকৃতি ভিন্ন। অসমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পুরোনো সমাজের সঙ্গে আপস করে উৎপাদনের উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানার রূপকে সংস্কার করে মাত্র। অন্যদিকে উৎপাদনের উপাদানের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লব হল শোষিত মানুষের স্থায়ী মুক্তির জন্য শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রথম বিপ্লব।