Chapter 13
আমাব় বাংলা
------------------------------
প্রশ্ন.1" যেন রাবণের চিতা-জ্বলছে তো জ্বলছেই।"-রাবণের চিতার মতো আগুন কারা, কোথায়, কী উদ্দেশ্যে জ্বালিয়েছে? এই আগুন তাদের কীভাবে সাহায্য
করে থাকে?
উত্তব়ঃ ▶ 'রাবণের চিতা'র মতো জ্বালানো আগুন: লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'গারো পাহাড়ের নীচে' রচনায়
জানিয়েছেন যে, প্রতিবছর চৈত্র মাসের রাত্রিবেলায় ময়মনসিংহের উত্তরদিকের
আকাশে একরাশ ধোঁয়াটে মেঘ দেখা যায়। আসলে ওটা মেঘ নয়, ওটা হল অবিভক্ত বঙ্গদেশের
গারো পাহাড় (বর্তমানে মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত)। ওখানে বাস করে বিভিন্ন আদিবাসী।
তাদের চাষের জন্য লাঙল, হাল বা বলদ কিছুই নেই। তা ছাড়া পাহাড়ের ওপর থাকে শুধু গাছ
আর পাথর, মাটি থাকে না। অথচ ফসল না ফলালে সারাবছর তারা খাবার পাবে
না। তাই ফসল ফলানোর উদ্দেশ্যে পাহাড়বাসীরা প্রতিবছর চৈত্রমাসে পাহাড়ের শুকনো
ঝোপঝাড়ে একদিন আগুন ধরিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে জ্বলতে থাকা সেই দাবানলকেই লেখক 'রাবণের
চিতা বলে উল্লেখ করেছেন।
▶আগুনের
সাহায্যকারী ভূমিকা: দাবানলের সময় বনের বাঘ, হরিণ, শুয়োর, অজগর
প্রভৃতি জন্তু আত্মরক্ষার তাগিদে ছুটোছুটি করতে থাকে। তখন পাহাড়িরা জন্তুগুলির, বিশেষত
শুয়োর ও হরিণগুলোকে শিকার করে মহানন্দে। আগুন জ্বলতে জ্বলতে কয়েকদিনের মধ্যে গোটা
জঙ্গল সাফ হয়ে গেলে পাহাড়ের গা এবং উপত্যকায় কালো ছাইয়ের একটি পুরু আস্তরণ পড়ে
যায়। সেই ছাইয়ের মধ্যেই ফসলের বীজ ছড়ায় পাহাড়িরা। কয়েকদিনের মধ্যেই গারো পাহাড়ের
পোড়া জমি তামাক, ধান এবং অন্যান্য ফসলে ভরে ওঠে। এইভাবেই দাবানল সেখানকার
জনজাতিদের সাহায্য করে থাকে।
প্রশ্ন.2"
এ-অঞ্চলের গারোদের ঘর দূর থেকে দেখলেই চেনা
যায়।" গারোদের ঘরবাড়ি এবং জীবিকার বর্ণনা দাও। প্রসঙ্গত অন্য যেসব
সম্প্রদায়ের মানুষের কথা উল্লিখিত আছে তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
উত্তব়ঃ ▶ গারোদের ঘরবাড়ি এবং
জীবিকা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'গারো পাহাড়ের নীচে' রচনায়
গারোদের ঘরবাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বন্য জন্তুজানোয়ারদের ভয়ে তারা মাটি থেকে
উঁচুতে মাচায় ঘর বাঁধত। সেখানেই শোয়া, রান্নাবান্না সব কিছু। এমনকি তাদের
হাঁসমুরগিগুলিও সেই মাচার উপরেই জায়গা পায়। লেখকের ভাষায় এটা 'পাহাড়ি
স্বভাব'। দূর থেকে দেখলেই গারোদের ঘরবাড়ির বিশিষ্টতা বুঝতে পারা
যায়। অন্যান্য পাহাড়ি উপজাতিদের মতোই গারোরাও হাল-বলদ নিয়ে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই
করে চাষ-আবাদ করে।
▶অন্যান্য
সম্প্রদায়: গারোদের মতোই পাহাড়ের নিম্ন এলাকায় বসবাস
করে হাজং, কোচ, বানাই, ডালু, মার্গান ইত্যাদি বিভিন্ন পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষ। এর মধ্যে হাজংদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। হাজং কথাটির অর্থ 'পোকা'। এই হাজংরা হল, 'চাষের পোকা'। পাহাড়ি গারোরা তাদের এই নাম দিয়েছে। কারণ কৃষিকার্যে হাজংরা অদ্বিতীয়। হাজং-ডালুদের ভাষা বাংলা হলেও তাদের 'ট' এবং 'ত' উচ্চারণে ধ্বনি বিপর্যয় ঘটে। সবমিলিয়ে পাহাড়ি মানুষদের জীবনযাত্রা ও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যকে টুকরো ইঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
প্ৰশ্ন.3" পাহাড়ি গারোরা তাই তারিফ করে তাদের নাম দিয়েছে হাজং।"-'হাজং' কথার অর্থ কী? হাজংদের জীবনযাত্রার পরিচয় দাও।
অথবা, "পাহাড়ি গারোরা তাই তারিফ করে তাদের নাম দিয়েছে হাজং।”-'হাজং' কথার অর্থ কী? হাজংদের পরিচয় দাও।
উত্তব়ঃ ▶ 'হাজং'-এর অর্থ: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'গারো পাহাড়ের নীচে' রচনা থেকে সংগৃহীত উদ্ধৃতিটিতে 'হাজং' কথাটি প্রকৃতপক্ষে 'গারো' ভাষার একটি শব্দ; যার অর্থ 'পোকা'।
▶ হাজংদের জীবনযাত্রা: উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের এক উপজাতি হল হাজং। গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজংদের সাথেই গারো, কোচ, বানাই, ডালু, মার্গান প্রভৃতি উপজাতির মানুষ বাস করে। প্রত্যেক উপজাতির মানুষের চোখেমুখেই পাহাড়ি ছাপ লক্ষ করা যায়। এই সমস্ত উপজাতির আলাদা আলাদা মাতৃভাষা থাকলেও হাজং ও ডালুরা অদ্ভুত ধরনের উচ্চারণে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। 'ত্'-কে 'ট্', 'ট্'-কে 'ত্', 'ড্'-কে 'দ' এবং 'দ'-কে 'ড্' উচ্চারণ করে তারা। হাজংদের এমন উচ্চারণ শুনলে যে-কোনো বাঙালিরই হাসি পাবে। একজন বয়স্ক মানুষ 'দুধ'-কে 'ডুড' এবং 'তামাক'-কে 'টামাক' বলছে শুনলে কার না হাসি পায়?
গারো পাহাড়ের ঠিক নীচে রয়েছে সুসং পরগনা, যার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে সোমেশ্বরী নদী। এখানে প্রথম বসতি গড়ে তোলে হাজংরাই। এ অঞ্চলের সংখ্যাগুরু আদিবাসী তারাই, গারোরা নয়। গারো পাহাড়তলির সুসং পরগনায় এসে হাজংরা প্রথম চাষবাস শুরু করে। কৃষিকার্যে তারা ছিল অত্যন্ত দক্ষ একারণে পাহাড়তলির পাহাড়ি উপজাতি গারোরা হাজংদের কৃষিকাজের দক্ষতাকে তারিফ করে তাদের নাম দিয়েছিল 'চাষের পোকা'।
প্রশ্ন.4" জঙ্গলে যখন আগুন লাগে তখন হয় মজা।”-জঙ্গলে আগুন লাগে কেন? এখানে মজা বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন?
উত্তব়ঃ ▶ জঙ্গলে আগুন লাগার কারণ: লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'গারো পাহাড়ের নীচে' রচনায় জানিয়েছেন যে, অবিভক্ত বঙ্গদেশের (বর্তমান মেঘালয় রাজ্যের) গারো পাহাড়ে হাজং, গারো, কোচ, বানাই, ডালু, মার্গান প্রভৃতি পাহাড়ি এবং সমতলি আদিবাসীরা বাস করে। তাদের চাষ করার লাঙল, হাল বা বলদ নেই। তা ছাড়া, পাহাড়ের ওপরে থাকে শুধু গাছ আর পাথর, সেখানে মাটি বিশেষ থাকে না। অথচ, ফসল না ফলালে তাদের সারাবছরের খাবার জুটবে না। তাই গারোরা পাহাড়ে ফসল ফলানোর উদ্দেশ্যে প্রতিবছর চৈত্র মাসে পাহাড়ের শুকনো জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেয়। একারণেই প্রতি বছর চৈত্র মাসের কোনো এক রাত্রে গারো পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন লাগে।
.▶ 'মজা' বলতে
লেখকের উপলব্ধি:
জঙ্গলে যখন দাবানল জ্বলতে থাকে, তখন
পাহাড়ি বনের বাঘ, হরিণ, শুয়োর, অজগর প্রভৃতি জানোয়ার প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারে
ছুটোছুটি করে। ফলে সেইসময় পাহাড়িরা শুয়োর এবং হরিণ শিকার করে চলে নির্বিচারে।
তারপর সন্ধ্যা হলে শিকার করে ফেরা মানুষগুলি এক জায়গায় জড়ো হয়ে গোল হয়ে ঘিরে
আনন্দে নাচ-গান করে এবং হরিণ ও শুয়োরের মাংসের ভূরিভোজে মেতে ওঠে। সুতরাং গারো
পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন লাগলে সেখানকার অধিবাসীরা কয়েকদিন আনন্দ-মজায় কাটায়।
প্রশ্ন.8"একটা
দুষ্টু শনি কোথাও কোন্ আনাচে যেন লুকিয়ে আছে।”-এই দুষ্টু শনির পরিচয় দাও।
অথবা, “জমিদারকে
টঙ্ক দিতে গিয়ে চাষিরা ফকির হয়।” সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আমার বাংলা গ্রন্থের 'গারো পাহাড়ের নীচে' রচনা
অবলম্বনে উদ্ধৃতিটি বিশ্লেষণ করো।
অথবা, “এত ফসল, এত প্রাচুর্য-তবু কিন্তু মানুষগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় জীবনে তাদের শান্তি নেই।"-মানুষগুলোর জীবনে শান্তি নেই কেন?
উত্তব়ঃ ▶ কথামুখ: সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'গারো পাহাড়ের নীচে' রচনায় গারো পাহাড়ের অধিবাসীদের উপর জমিদারের শোষণ ও অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন। 'দুষ্ট শনি'র পরিচয়: এই অঞ্চলে ফসলের প্রাচুর্য সত্ত্বেও সেখানকার মানুষের মনে কোনো শান্তি ছিল না। তার কারণ 'দুষ্টু শনি'র মতো জমিদারের অত্যাচার তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। মানুষগুলোর জীবনে শান্তি না থাকার কারণ: গারো পাহাড়ের উপত্যকার উঁচু কোনো টিলা থেকে নীচে তাকালে দেখা যেত চারদিকে কেবল ধান আর ধান। প্রতি বছর ধান কাটার মরশুমে প্রতিটি পরিবারের নারী-পুরুষ-শিশু প্রত্যেকেই কাস্তে হাতে নিয়ে মাঠে যেত। পিঠে ধানের আঁটি বেঁধে 'ছোটো ছোটো ছেলের দল' ফিরে আসত বাড়ির খামারে। কিন্তু চাষের জমি থেকে খামারে তোলা এই ফসলের বেশিরভাগটাই তাদের ঘরে থাকত না। জমিদারের প্রাপ্য আদায় করতে তার পাইক-বরকন্দাজরা ঠিক সময়েই চলে আসত। ফসলের মরশুমে গ্রামের আলপথে লোহার খুর দেওয়া নাগরাজুতোর খটখট শব্দ শুনতে পেত গ্রামবাসীরা। দূর থেকে দেখা যেত মোটা কঞ্চির আগা। ছোটোরা তা দেখে ভয়ে মায়ের আঁচলে আশ্রয় নিত। খিটখিটে বুড়িরা অভিশাপ দিতে থাকত। এমনকি, জমিদারের এই জুলুমকে নিয়ে গানও বাঁধত তারা। এ প্রসঙ্গে লেখক যথার্থই বলেছেন যে, "জমিদারের টঙ্ক দিতে দিতে চাষিরা ফকির হয়।"
প্রশ্ন.9“ গারো পাহাড়ের ঠিক নীচেই সুসং পরগনা।”—'গারো পাহাড়ের নীচে' রচনা অবলম্বনে সুসং পরগনার নিসর্গ-প্রকৃতি এবং মানুষের জীবনযাত্রার বর্ণনা দাও।
উত্তব়ঃ ▶ সুসং পরগনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর 'গারো পাহাড়ের নীচে' শীর্ষক রচনায় গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সুসং পরগনার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। রেললাইন থেকে অনেকটা দূরে অবস্থিত এই সুসং পরগনার রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো নয়। শস্যশ্যামলা এই উপত্যকার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরী। এতে শীতকালে জল খুব কম থাকে। কিন্তু এই নদীর ঠান্ডা জলে এমন স্রোত থাকে যে, তাতে পা ডোবালে মনে হয় কুমিরে দাঁত বসিয়ে যেন পা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাই ফেরিনৌকোতেই মানুষজনকে পারাপার করতে হয়।
মানুষের জীবনযাত্রা: সুসং পরগনায় হাজং, গারো, কোচ, বানাই, ডালু, মার্গান প্রভৃতি নানা উপজাতির মানুষের বাস।
গারো পাহাড়তলিতে হাজংরাই সংখ্যায় বেশি। চাষাবাদে দক্ষ এই উপজাতিই এ অঞ্চলে প্রথম
পা রেখেছিল। এ অঞ্চলে গারোদের বাসস্থানের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। গাছের উপর
মাচা বেঁধে বাসস্থান তৈরি করে সেখানেই শোওয়া-বসা, রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া
করে তারা। পোষা হাঁস-মুরগিকেও বন্যজন্তুর থেকে বাঁচাতে তারা মাচাঘরেই রাখে। তবে এখানকার প্রতিটি উপজাতির চোখে-মুখে পাহাড়ি ছাপ থাকলেও তাদের ভাষা কিন্তু আলাদা। অবশ্য বাংলা ভাষার প্রভাবে গারো ভাষা ছাড়া অন্য ভাষাগুলির অস্তিত্ব আর বিশেষ নেই। এইসব উপজাতির মানুষের উচ্চারণে বাংলা শব্দ অনেকটাই বদলে যায়। তারা 'ত'-কে 'ট', 'ট'-কে 'ত', 'ড'-কে 'দ' এবং 'দ'-কে 'ড' বলে। তাই তারা 'দুধ'-কে 'ডুড' এবং 'তামাক'-কে 'টামাক' বলে থাকে।
প্রশ্ন.10” গারো পাহাড়ের নীচে' যারা বাস করে তাদের জীবনযাত্রার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
উত্তব়ঃ ▶ উপজাতি সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আমার বাংলা গ্রন্থের 'গারো পাহাড়ের নীচে' রচনায় সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রার এক স্পষ্ট ও নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায়। গারো পাহাড়ের নীচের সুসং পরগনায় বাস করে হাজং-গারো-কোচ-বানাই-ডালু-মার্গান প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়ের মানুষ। এখানকার প্রথম বাসিন্দা হাজংরা ছিল চাষবাসে খুব দক্ষ। তাই গারোরা এদের নাম দিয়েছিল হাজং অর্থাৎ, চাষের পোকা। গারোদের ঘরগুলো ছিল মাচা করে বাঁধা, তার ওপরেই খাওয়া-শোওয়া-রান্নাবান্না-হাঁসমুরগির থাকার ব্যবস্থা।
চাষের সময় গারো পাহাড়ের নীচে দিগন্তজোড়া ধানের খেতে নারীপুরুষ কাস্তে হাতে ধান কাটতে ছোটে। ছোটো ছেলেরা পিঠে ধানের আঁটি বেঁধে এনে খামারে ভরে। কিন্তু পরিশ্রম করে ফলানো ফসলের বেশিরভাগটাই নিয়ে চলে যায় জমিদারের পাইক-বরকন্দাজ।
হাতি-বেগার আইনের কারণে জমিদারের হাতি শিকারের সময় জঙ্গল ঘিরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হত গ্রামের মানুষদের। তবে প্রজাবিদ্রোহের ফলে সে আইন বাতিল হলেও গ্রামবাসীদের দুর্দশা কাটেনি।
অনেক বছর আগে একসময় গারো পাহাড়ের মানুষগুলোর খেয়েপরে বেঁচে আঁকিতে কোনো অসুবিধাই হত না। কিন্তু দিনের পর দিন জমিদারের অত্যাচারে ও শোষণে আজ তাদের দুমুঠো ভাত কিংবা একফোঁটা দুধও চেয়েচিন্তে আোচারে করতে হয়।
অবিভক্ত বাংলা দেশে থাকলেও বাঙালি জীবনযাত্রার সাথে গারোরা
কখনও নিজেদের মেলাতে পারেনি, আর বাঙালিরাও তাদের আপন করে নিতে পারিনি।
প্রশ্ন.11” ছাতির
বদলে হাতি' গল্পে মনমোহন মহাজনের চরিত্রবৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
উত্তব়ঃ ▶ শুরুর কথা: সুভাষ মুখোাধ্যায়ের 'ছাতির বদলে হাতি' গল্পে মনমোহন মহাজন
চরিত্রটির উপস্থাপন ঘটেছে মহাজনি শোষণের প্রতীক হিসেবে। আলোচ্য গল্পে চরিত্রটির যে
বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করা যায় তা হল-
আপাত বিনয়: বৃষ্টিতে
আটকে পড়া চেংমানকে যেভাবে মনমোহন নতুন ছাতা দিয়েছে এবং দাম নিয়ে ভাবতে নিষেধ করেছে, কিংবা
পরে দাম মেটানোর সুযোগ দিয়েছে,
তা তার আপাত বিনয় এবং উদারতার নিদর্শন।
শঠতা: বিনয় কিংবা উদারতা মনমোহনের
স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য ছিল না। এগুলি ছিল তার দুরভিসন্ধির ভান। তাই চেংমান পরে বারবার
বললেও মনমোহন ছাতার দাম নিতে চায়নি এবং যখন চেংমান ছাতার কথা ভুলে গিয়েছে তখনই
সুদসমেত ছাতার এমন দাম দাবি করেছে যা একটি হাতির দামের সমান।
হৃদয়হীনতা: মনমোহন
মহাজন তার শঠতার দ্বারা শোষণের যে ফাঁদ তৈরি করেছে চেংমানকে তার শিকার হতে হয়েছে।
বছরের পর বছর দাম না নিয়ে সে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ বাড়ার সুযোগ তৈরি করেছে। শেষে
ছাতার দাম বাবদ মনমোহন হাজার টাকা দাবি করেছে, যা চেংমানের মত দরিদ্র গারো চাষিকে নিঃস্ব করার
জন্য যথেষ্ট।
উপসংহার: সব
মিলিয়েই মনমোহন মহাজন একটি চূড়ান্ত নেতিবাচক চরিত্র এবং মহাজনি শোষণের জীবন্ত
প্রতীক।
প্রশ্ন.12"
ফিরে এসে কলকাতার গল্প বলেছিল মোনা
ঠাকুর।"-মোনা ঠাকুর কলকাতায় গিয়েছিল কেন? সে কলকাতার কোন্ গল্প বলেছিল?
অথবা, মোনা
ঠাকুর বর্ণিত কলের কলকাতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
উত্তব়ঃ ▶মোনা ঠাকুরের কলকাতা যাওয়ার কারণ: 'কলের
কলকাতা' রচনাটি লেখার পঁচিশ বছর আগে লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের
গ্রামের বাসিন্দা মোনা ঠাকুর কলকাতায় গিয়েছিল কালীঘাটের মন্দিরে পইতে নিতে।
▶ মোনা ঠাকুরের বলা কলকাতার গল্প: কলকাতায়
এসে বিস্মিত মোনা ঠাকুর দেখে যে,
সেখানে শব্দ করে মোটরগাড়ি, ট্রাম
চলে। রাস্তায় সর্বত্র লোক গিজগিজ করছে। কলকাতায় অসংখ্য বাড়ি ও গাড়ি রয়েছে। গ্রামের
মাটি কিংবা সাঁকোর কোনো চিহ্ন নেই, শুধু বালি-চুন-ইট আর পাথর। এই 'কলের
কলকাতা'য় টাইমকল খুললে জল পড়ে, সুইচ টিপলে অন্ধকারে জ্যোৎস্না বিচ্ছুরিত হয়।
এখানকার অসংখ্য গলিতে ঘুরতে ঘুরতে তার মাথা বনবন করে, পা
টনটন করে। পথের দু-পাশে অসংখ্য দোকান, বাজার দেখা যায়। একদিন হাঁটতে হাঁটতে মোনা দেখে
তার ছায়ার পাশে লম্বা চওড়া আর একটা ছায়া। পেছন ফিরে সে দেখে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, গোঁফ-দাড়িওয়ালা
একটি লোক লম্বা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে। পরনে তার পাঞ্জাবির ওপর রংচঙে হাতকাটা ফতুয়া, কাঁধে
ঝুলি। ভীষণাকৃতি এই লোকটাকে ছেলেধরা ভেবে মোনা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে এবং ভগবানের
নাম নেয়। এইসময় লোকটি হঠাৎ তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলে ধড়ে প্রাণ আসে তার। মোনা ঠাকুর
লেখককে জানায়, 'কলের কলকাতা'-য় "গাড়ি চাইলে গাড়ি, বাড়ি চাইলে বাড়ি। যা চাইবে তাই পাবে।"
প্রশ্ন.13” কলকাতা থেকে মোনা ঠাকুররা তাড়াতাড়ি কেন ফিরে এসেছিল, তা 'কলের কলকাতা' রচনার অন্তর্গত মোনা ঠাকুরের ভাষ্য অবলম্বন করে লেখো।
উত্তব়ঃ ▶ কলকাতা থেকে মোনা ঠাকুরের তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কারণ: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'কলের কলকাতা' রচনায় আমরা দেখি যে লেখকের গ্রামের বাসিন্দা মোনা ঠাকুর কালীঘাটে পইতে নেওয়ার জন্য কলকাতায় গিয়ে সপরিবারে এক ধর্মশালায় উঠেছিল। মোনার কথা অনুযায়ী, তাদের আসার উদ্দেশ্যপূরণের পর হঠাৎ একদিন তারা দেখে যে, শহরের বাড়িগুলির দরজা-জানালা দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাড়িগুলি ধীরে ধীরে হানাবাড়িতে পরিণত হচ্ছে। রাস্তাঘাট শুনসান। শহরে মানুষজন আছে কি না তা বোঝাই যাচ্ছে না। অন্ধকার রাতে মাঁঝে মাঝেই প্রবল চিৎকার কানে ভেসে আসে-"...মুসলমানগুলাকে কাটব।...! হিন্দুগুলাকে কাটব।" প্রকাশ্য রাস্তায় শুরু হয়ে যায় দাঙ্গা, প্রত্যেকের হাতেই লাঠি বা ছুরি। রক্তের স্রোত বয়ে যায় রাস্তায়, পথে লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ঘরবাড়িতে শুরু হয় আগুন ধরানো। এই দাঙ্গা দেখে ধর্মশালায় থাকা যাত্রীরা স্বভাবতই অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রাণ নিয়ে যেভাবেই হোক পালাতে চায় তারা। কিন্তু তারা চলে গেলে পান্ডাদের উপার্জনের ব্যাঘাত ঘটবে বলে কালীঘাটের পান্ডারা তাদের অভয় দিয়ে জানায় যে, তারা থাকতে যাত্রীদের কোনো ভয় নেই। কিন্তু প্রাণনাশের আশঙ্কাতেই ধর্মশালার যাত্রীরা কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। একারণেই রাতের অন্ধকারে মোনা ঠাকুররা নিঃশব্দে কলকাতা থেকে বিদায় নেয়।
প্রশ্ন.14" ডানদিকে কাঁটাতারে ঘেরা জেলখানার চৌহদ্দি।”- কোন্ জেলখানার কথা বলা হয়েছে? জেলখানার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
অথবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনা অবলম্বন করে বক্সা জেলখানার বর্ণনা দাও।
উত্তব়ঃ উদ্দিষ্ট জেলখানা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনায় বক্সা জেলখানার কথা বলা হয়েছে।
▶ জেলখানার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: জয়ন্তী পাহাড় এবং ভুটান পাহাড়ে ওঠার রাস্তা দুটি বাদে তেরাস্তার অবশিষ্ট রাস্তাটিই ঘাস ও কাঁকরে ভরা একটা মাঠ পেরিয়ে কাঁটাতারে ঘেরা বক্সা জেলখানার সীমানায় গিয়ে শেষ হয়েছিল। দূর থেকে দেখে লেখকের মনে হয়েছিল জেলখানাটা যেন পাহাড়ের তিনতলা সমান একটা হাঁটুর ওপর অবস্থিত। মাঠের গা দিয়ে উঠেছে পাথরের সিঁড়ি যা শেষ হয়েছে একটা 'লোহার ফটক'-এর সামনে। পাহাড়ের তিনটি খাঁজেই ছিল
অসংখ্য সারিবদ্ধ ঘর। সেই ঘরগুলোর দেয়াল ছিল পাথরের আর ছাদ ছিল রং করা কাঠের। প্রতিটি ঘরেই ছাদের কাছে গরাদ-আঁটা জানলা আর দুটো করে দরজা। একটা পেটাই করা লোহার, অন্যটি মোটা কাঠের। ঘরের সামনে রয়েছে কাঁটাতার-ঘেরা ছোট্ট উঠোন। জেলখানার চৌহদ্দির মধ্যে যে পরিমাণ কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে, সব এক করলে তা লম্বায় কয়েক মাইল পর্যন্ত হবে। জেলখানার ভেতরের রাস্তাগুলি এঁকেবেঁকে এদিক-ওদিক চলে গেছে। ইলেকট্রিক পোস্টগুলিকে দিনের বেলাতে ফাঁসির মঞ্চ বলে মনে হচ্ছিল লেখকের। জেলখানার চৌহদ্দির বাইরে একশো-হাত অন্তর উঁচু করে তৈরি করা সেন্ট্রি-বক্সগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে বন্দুকধারী সেপাইরা দিন-রাত পাহারা দেয়। জেলখানাটির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাঁ-দিকে জেলের অফিস, সেপাইদের শিবির এবং নীচুপদের কর্মীদের কোয়ার্টার। আরও দুটো ফটক পার হওয়ার পর খোলা আকাশ দেখা যায়। জেলের ভেতরের দেয়ালের গায়ে ছাপার অক্ষরে উপদেশাবলিও লেখা ছিল।
প্রশ্ন.15” সেই মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বক্সার জেলখানা।” -সান্তালবাড়ি থেকে কীভাবে লেখক বক্সা জেলখানায় পৌঁছেছিলেন, তা 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনা অবলম্বন করে লেখো।
উত্তব় যাত্রাপথ: 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনায় লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় রাজাভাতখাওয়া স্টেশন থেকে ট্রাকে চড়ে চা-বাগান, খানাখন্দে ভরা মাঠ, ডুয়ার্সের ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ি চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পৌঁছোন সান্তালবাড়িতে। সেখান থেকে বক্সা দু-মাইল চড়াই হাঁটা পথ। লেখক ওপরে উঠতে গিয়ে দেখেন যে, বক্সায় যেতে গেলে যে পাহাড়ে তাঁদের উঠতে হবে, সেই পাহাড়ি পথ জঙ্গলে ঢাকা। সেই পাহাড়ি পথে উঠতে উঠতে লেখকের হাঁফ ধরে যায়। নিস্তব্ধ পথে হঠাৎ একসময় ঝিরঝির শব্দ শুনতে
পেয়ে লেখক বিস্মিত হয়ে ভাবেন যে, কাছেই নিশ্চয় কোনো ঝরনা আছে। এতক্ষণ তিনি একবারও পাখির ডাক পর্যন্ত শুনতে পাননি। এই ঝরনার জল যেখান দিয়ে বয়ে গেছে তার ওপর তিনি একটি কাঠের সেতু দেখতে পেলেন। সেই সেতু পেরোনোর পরই লেখক দু-একটা কাঠের ঘর দেখতে পেলেন যা ছিল ওখানকার ডাকঘর, জলকল এবং বনবিভাগের দফতর। আরও খানিকটা এগিয়ে রাস্তাটা একটা তেমাথায় গিয়ে শেষ হল। এর মধ্যে একটি রাস্তা জয়ন্তী পাহাড়ের দিকে, দ্বিতীয় রাস্তাটি ভুটান পাহাড়ের গা বেয়ে সোজা তিব্বতের দিকে চলে গেছে। এই রাস্তাটি দিয়েই মাসখানেকের মধ্যে লাসায় যাওয়া যায়। তৃতীয় রাস্তাটি ঘাস ও কাঁকরে ভরা ছোটো একটা মাঠ অতিক্রম করে কাঁটাতারে ঘেরা বক্সা জেলখানার সীমানায় গিয়ে শেষ হয়েছে। মাঠ পেরিয়ে পাথরের সিঁড়ি ভেঙে অবশেষে লেখক পৌঁছোেন বক্সা জেলখানার সদর দরজায়।
প্রশ্ন.16"এরা সব সাধুচরণের অতীত, সাধুচরণ এদের ভবিষ্যৎ।”-এখানে 'এরা' বলতে কাদের কথা বোঝানো হয়েছে? মুস্তাফার বিশদ পরিচয় দাও।
উত্তব়ঃ এদের পরিচয়: কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনায় 'এরা' বলতে বক্সার জেলের নাবালক অপরাধীদের বোঝানো হয়েছে। এরা কেউ ছিঁচকে চোর, কেউ-বা পকেটমার। ঠিকমতো যত্ন বা পরিচর্যা পেলে এদের মধ্যে থেকেই কেউ হয়তো ইঞ্জিনিয়ার, কেউ মাস্টার, কেউ-বা লেখক হতে পারত। এইসব বালকরা হয় অনাথ, না হয় কলকাতা শহরের ফুটপাথে বড়ো হয়েছে।
▶ মুস্তাফার পরিচয়: মুস্তাফা ছিল বছর দশেকের ফুটফুটে একটি ছেলে। সে জেলখানায় এমন ভাবভঙ্গি করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যেন পৃথিবীর কাউকে সে তোয়াক্কা করে না। এন্টালির কোনো এক স্কুলে-পড়া মুস্তাফার বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রি। হঠাৎ একদিন তিনতলা-সমান উঁচু বাঁশের ভারা থেকে পড়ে তিনি মারা গেলে বিধবা মা এবং বেশ কয়েকটি ভাইবোন নিয়ে অথই জলে পড়ে মুস্তাফা। মাইনে দিতে না পারায় স্কুল থেকে তার নাম কেটে দেওয়া হয়। তাদের বস্তির এক পকেটমার-সর্দার মুস্তাফাকে টাকার লোভ দেখিয়ে তার দলে নিয়ে নেয়। এভাবেই শুরু হয় তার পকেট কাটার পেশা। পকেটমার হিসেবে ধরা পড়ে ইতিপূর্বে সে বারচারেক জেলেও গেছে। ইস্কুলে যেতে ইচ্ছে করে কি না লেখকের এই প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞের মতো সে জানায় যে, 'ইচ্ছে করলেই কি যাওয়া যায়?'
প্রশ্ন.17“ কিন্তু এদের কারো জন্যেই তৈরি হয়নি বক্সা বন্দি শিবির।”- 'এদের' বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে? এই বন্দিশিবির কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তার বর্ণনা দাও।
উত্তব়ঃ উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ: 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনায় বক্সার জেলখানায় প্রবেশ করে লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে তিনপ্রকার কয়েদির সন্ধান পান'-অভিজাত কয়েদি, অনভিজাত নাবালক কয়েদি, অনভিজাত সাবালক কয়েদি। তথাকথিত ভদ্র, শিক্ষিত যেসব কয়েদি খাদ্যে ভেজাল বা বিষ মিশিয়ে অথবা নোট জাল করে কিংবা ব্যাংক লুঠ করে মানুষকে প্রাণে বা ধনে-প্রাণে মেরে জেলে এসেছেন, তারাই অভিজাত কয়েদি। আর অনাথ যেসব শিশু বা কিশোর পেটের দায়ে ছিঁচকে চুরি বা পকেটমারি করে এখানে স্থান পেয়েছে, তারাই অনভিজাত নাবালক কয়েদি। আর চোর, ডাকাত, খুনি-ইত্যাদি অপরাধের পাকা অপরাধীরা, যারা মূলত নিরক্ষর ও অভদ্র, তারাই অনভিজাত সাবালক কয়েদি। উদ্ধৃত মন্তব্যটিতে লেখক এই তিনপ্রকার কয়েদির কথা বলেছেন।
▶ বন্দিশিবির তৈরির বর্ণনা: ঘন জঙ্গলে ভরা বক্সা জায়গাটা ইংরেজরা ভুটানের কাছ থেকে লম্বা মেয়াদে ইজারা নিয়েছিল। সেখানে তারা তৈরি করে কেল্লা। পরে সেই কেল্লাকেই তারা জেলখানায় রূপান্তরিত করে। তখন জঙ্গলাকীর্ণ এই অঞ্চলে বাঘের ডাক শোনা যেত, বিষধর সাপেরা ঘুরে বেড়াত। আশেপাশে দোকান-বাজার-হাসপাতালও ছিল না। এরকম বিপদসংকুল নির্বান্ধবপুরীতে স্বাধীনতা সংগ্রামী ভারতীয়দের নিক্ষেপ করতেই ইংরেজরা তৈরি করেছিল এই জেলখানা। তাই এই বন্দিশিবির সাধারণ অপরাধীদের জন্য তৈরি হয়নি।
প্ৰশ্ন.18" জেলখানায় অসহ্য লাগে অপরাধের তুলনায় শাস্তির এই হেরফের।”-কোন্ জেলখানার কথা বলা হয়েছে? জেলখানায় অপরাধের তুলনায় শাস্তির কী হেরফের লেখক লক্ষ করেছেন?
উত্তব়ঃ উদ্দিষ্ট জেলখানা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনা থেকে সংকলিত এই উদ্ধৃতিটিতে বক্সা জেলখানার কথা বলা হয়েছে।
▶ জেলখানায় অপরাধের তুলনায় শাস্তির হেরফের: লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় বক্সা জেলখানার বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে তিনি দুইপ্রকার কয়েদির সন্ধান পান-অভিজাত কয়েদি এবং অনভিজাত কয়েদি। খাদ্যে ভেজাল বা বিষ মিশিয়ে, অথবা নোট জাল করে, কিংবা ব্যাংক লুঠ করে আসা অর্থবান ঘরের, লেখাপড়া-জানা, ভদ্র, বিনীত কয়েদিরাই হল অভিজাত কয়েদি। আর চুরি, ডাকাতি, পকেটমারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে আসা হতদরিদ্র, 'ছোটোলোক' পরিবারের নিরক্ষর, অভদ্র, সৌজন্যহীন কয়েদিরাই হল অনভিজাত কয়েদি। অভিজাত কয়েদিরা বহু মানুষকে ধনে-প্রাণে শেষ করলেও জেলের কর্তামহল তাদের তোয়াক্কা করে। বড়ো ঘর, বনেদি বংশের ছেলে বলে জেলে গিয়ে তারা সুখেই থাকে। অন্যদিকে, ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করতেই অভাবের তাড়নায় চুরি-ছিনতাই-রাহাজানি করা অনভিজাত কয়েদিদের জন্য থাকে 'অনন্ত নরকবাসের ব্যবস্থা।' জেলের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ অবধি সমস্ত কাজ বিনা মজুরিতে করিয়ে নেওয়া হয় এদের দিয়ে। তবুও "পান থেকে চুন খসলেই পিঠে ডান্ডা কিংবা লোহার নাল মারা বুটের লাথি”। জেলখানায় অপরাধের তুলনায় শাস্তির এই হেরফের লক্ষ করেই লেখক অভিজাত কয়েদিদের 'সুয়োরানির ছেলে' এবং অনভিজাত কয়েদিদের 'দুয়োরানির ছেলে' বলে অভিহিত করেছেন।
প্রশ্ন.19 দেশকে ভালোবাসা ছাড়া কোনো অপরাধই যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হয়নি,”-লেখক এখানে কাদের কথা বলেছেন? তাঁদের সম্পর্কে লেখকের যে মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে, তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।
উত্তব়ঃ উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ: সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনায় জানিয়েছেন যে, দেশকে ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো অপরাধ যাঁরা করেননি, তাঁরাও বর্তমানে বক্সার জেলখানায় কয়েদি হয়ে রয়েছেন। ইংরেজরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্যই বক্সার জেলখানা তৈরি করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেখানে অন্যান্য অপরাধীদের সঙ্গে রাজনৈতিক অপরাধীদেরও কয়েদি করে রাখা হয়েছে। খাঁসাহেব, নীরদ চক্রবর্তী, শিবশংকর মিত্র, সতীশ পাকড়াশী প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামী কমিউনিস্টদেরও এ জেলখানায় দেখেন লেখক।
▶ লেখকের মনোভাব: যে-সমস্ত মানুষ দুরন্ত অজয় নদের তীরে দাঁড়িয়ে বন্যারোধী বাঁধ বেঁধেছেন, যাঁরা অন্ধকার খনিগর্ভে পৌঁছে দিয়েছেন উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় নতুন দিনের সুসমাচার, হেলে পড়া ধানের শিষগুলিকে যাঁরা সাহস জুগিয়ে বর্শার ফলার মতো টানটান করে দিয়েছেন, কারখানার চিমনির ধূমায়িত মুখে যাঁরা জুগিয়ে দিয়েছেন আগুনের ভাষা-সেইসব মানবতাবাদী কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের বক্সা বন্দিশিবিরে দেখতে পেয়ে অত্যন্ত বেদনার্ত হয়েছেন মানবতাবাদী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। স্বাধীন দেশের সরকারের এই অন্যায় আচরণ তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি লিখেছেন, "আজ ইংরেজ নেই, তবু তার আগের ব্যবস্থাই বহাল আছে বক্সায়।”
প্রশ্ন.20" গলার মধ্যে থলি বানাতে কষ্ট আছে।"-কারা, কীভাবে গলার মধ্যে থলি বানায় তা 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনা অবলম্বনে লেখো।
অথবা বক্সা জেলে কয়েদিরা কীভাবে সোনাদানা জেলের মধ্যে লুকিয়ে রাখত, তা 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনা অবলম্বন করে লেখো।
উত্তব়ঃ উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ: সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনায় উল্লেখ করেছেন যে জেলখানার মধ্যে কয়েদিদের টাকাপয়সা বা সোনাদানা রাখা আইনবিরুদ্ধ হলেও জেলে একটু ভালোভাবে থাকার জন্য কয়েদিরা তাদের ধনসম্পদ রাখার একটা বিশেষ উপায় অবলম্বন করত।
▶ থলি বানানোর পদ্ধতি: দিনের পর দিন অসম্ভব কষ্ট করে কয়েদিরা তাদের গলার মধ্যে একটা ছোট্ট থলি তৈরি করে নিত। দীর্ঘদিন ধরে তারা একটা ভারী সিসার বল গলার কাছের তালুতে অর্থাৎ টাকরাতে রেখে দিত তারা। সেই ভারী বলটি ধীরে ধীরে 'মাংস ছ্যাঁদা হয়ে'।বসে যেত। স্বভাবতই এর ফলে সেই জায়গাটায় দগদগে ঘা হয়ে গেলে তারা যন্ত্রণায় ছটফট করত। ঘায়ের জন্য মুখে দুর্গন্ধ হয়ে যেত। প্রায় একবছর ধরে ঘায়ের যন্ত্রণা এবং দুর্গন্ধ সহ্য করে গর্ত ভালোভাবে তৈরি হয়ে গেলে তারা বলটি বের করে নিত। তারপর একসময় ঘা শুকিয়ে গেলে গলার কাছে তৈরি হয়ে যেত একটা স্থায়ী গর্ত। তখন সেই গর্তের মধ্যে তারা সোনাদানা অনায়াসেই লুকিয়ে রেখে দিত। আর এই থলির মধ্যেই সোনা বা রত্ন রেখে বন্দিরা নিরাপদে দিনযাপন করত। লেখক এ কারণেই বলেছেন, "গলার মধ্যে থলি বানাতে কষ্ট আছে।"
প্ৰশ্ন.21" কেননা তাদের বড়ো ঘর, বনেদি বংশ-তারা সুয়োরানির ছেলে।"-কাদের সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে? তাদের বিষয়ে লেখক করো।
কী বলেছেন এবং তাদের প্রতি জেল-কর্তৃপক্ষের আচরণ পর্যালোচনা
উত্তব়ঃ উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ: 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনায় লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় বক্সা জেলখানা ভ্রমণকালে যে অভিজাত কয়েদিদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তাদেরকেই তিনি 'সুয়োরানির ছেলে' বলেছেন।
▶ লেখকের বক্তব্য: খাদ্যে ভেজাল বা বিষ মিশিয়ে অথবা নোট জাল করে কিংবা ব্যাংক লুঠ করে এরা জেলে এসেছে। অথচ এরা বুক ফুলিয়ে জেলে ঘুরে বেড়ায়। এইসব তথাকথিত ভদ্র, শিক্ষিত কয়েদিদের কর্তামহল তোয়াক্কা করে, অন্য কয়েদিরা সম্মান করে। অভিজাত, ধনী পরিবারের এইসব শিক্ষিত যুবক ট্রামে-বাসে কারও পকেট মারেনি, ছুরি দেখিয়ে কারও টাকার থলি ছিনিয়েও নেয়নি। অভাব কাকে বলে, তাও কখনও জানতে পারেনি তারা। তারা ব্যাংক লুঠ করে হাজার হাজার গরিব বা বিধবাকে সর্বস্বান্ত করেছে, খাদ্যে বিষাক্ত ভেজাল মিশিয়ে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে, নোট জাল করে হাজার হাজার পরিবারকে পথের ভিখারি করে দিয়েছে। এসব করেও জেলে তারা সুয়োরানির ছেলের মতো পরম সুখে বাস করছে। জেল-কর্তৃপলে
আচরণ: এইসব উচ্চবিত্ত, প্রভাবশালী কয়েদিদের 'আপনি-আজ্ঞে' করে খাতির দেখিয়ে বক্সার জেল-কর্তৃপক্ষ একরকম পক্ষপাতমূলক আচরণই করত।
প্রশ্ন.22" আজ ইংরেজ নেই, তবু তার আগের ব্যবস্থাই বহাল আছে বক্সায়।"-কোন্ ব্যবস্থার কথা এখানে বলা হয়েছে? যখন বক্সায় ইংরেজরা বন্দিশিবির তৈরি করেছিল, তখন সেখানকার পরিবেশ কেমন ছিল?
উত্তব়ঃ উদ্দিষ্ট ব্যবস্থা: সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনায় বলেছেন, বক্সা জেলখানায় স্বাধীনতার পরেও দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামী ভারতীয়দেরকেই বন্দি করে রাখা হত। তাই খাঁসাহেব, নীরদ চক্রবর্তী, শিবশঙ্কর মিত্রকে এই জেলখানায় দেখেন লেখক। বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দী বিস্তৃত মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিগর্ভ ইতিহাসে যাঁর জীবন উৎসর্গীকৃত হয়ে আছে—সেই সতীশ পাকড়াশীও রয়েছেন বক্সা জেলে। এ ছাড়া এই জেলে রয়েছেন বাংলাদেশের অগণিত মানুষের বিশ্বস্ত প্রতিনিধিরাও। যে-সমস্ত মানুষ দুরন্ত অজয় নদের তীরে দাঁড়িয়ে বন্যারোধী বাঁধ বেঁধেছেন, যাঁরা অন্ধকার খনিগর্তে পৌঁছে দিয়েছেন উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় নতুন দিনের সুসমাচার, হেলে পড়া ধানের শিষগুলোকে যাঁরা সাহস জুগিয়ে বর্শার ফলার মতো টানটান করে দিয়েছেন, কারখানার চিমনির ধূমায়িত মুখে যাঁরা জুগিয়ে দিয়েছেন আগুনের ভাষা-তাঁদের সবারই ঠাঁই হয়েছে এই বক্সার জেলে।
▶ বন্দিশিবির তৈরির সময়কার পরিবেশ: ভুটানের রাজার কাছ থেকে দীর্ঘকালীন মেয়াদে ইজারা নিয়ে ইংরেজরা এই বক্সার জেল তৈরি করে। প্রথমে এটা ছিল কেল্লা। তখন গভীর জঙ্গলে ভরা এই অঞ্চলে বাঘের ডাক শোনা যেত, বিষধর সাপেরা ঘুরে বেড়াত। বক্সার বায়ু ছিল দূষিত ও অস্বাস্থ্যকর, আর ঝরনার জল ছিল জীবাণুপূর্ণ। এই অঞ্চলের আশেপাশে দোকান-বাজার, হাসপাতাল-কিছুই ছিল না। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মৃত্যু অনিবার্য ছিল।
প্রশ্ন.23” সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনা অবলম্বন করে জেলের সাধারণ কয়েদিদের ওপর জেল কর্তৃপক্ষ এবং জেল কর্মচারীদের অত্যাচার বর্ণনা করো।
অথবা 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনা অবলম্বনে জেলের কয়েদিদের দুর্দশা ও দুরবস্থার বর্ণনা দাও।
অথবা "জেলখানা একটা আলাদা জগৎ”। -সেই জগতের যে চিত্র 'মেঘের গায়ে জেলখানা' পাঠে ধরা পড়েছে, তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তব়ঃ কয়েদিদের দুর্দশা ও দুরবস্থা: 'মেঘের গায়ে জেলখানা' রচনার লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে, "জেলখানা একটা আলাদা জগৎ”। উচু পাঁচিলে ঘেরা বক্সা জেলখানায় কয়েদিদের ঠাসাঠাসি করে লকআপে থাকতে হত। সকালে খোলা প্রাঙ্গণে তারা থাকতে পারত। ঢোকা-বেরোনোর সময় তাদের আচরণে কোনোরকম ভুলত্রুটি ঘটলে তাদের কপালে জুটত জমাদারের ডান্ডা অথবা লোহার নাল বসানো বুটজুতোর লাথি। কয়েদিদের দিয়ে জেলখানার চৌহদ্দির ভিতরকার হাড়ি-মেথরের কাজ থেকে শুরু করে
"দড়িচাল্লি, ধোবিচাল্লি, ঘানিকর, মিস্ত্রিঘর, ছাপাখানা, গোয়ালঘর, তরকারি বাগান” প্রভৃতি স্থানের যাবতীয় কাজ বিনা পারিশ্রমিকে করানো হত। কোনো কয়েদির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে কেসটেবিলে ডাক পড়ত তার। অপরাধ প্রমাণিত হলে ডিগ্রিবন্ধ, মার্কাকাটা, কম্বল-ধোলাই, মাড়ভাত, পায়ে বেড়ি ইত্যাদির কোনো-না-কোনো একটি শাস্তি জুটত তার কপালে। জেলখানার নির্জন, বন্ধ কুঠুরিতে কয়েদিকে মাসের পর মাস বন্ধ রাখাকে বলা হত ডিগ্রিবন্ধ। দরজার নীচের সরু ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হত তাদের খাবার। জেলের কয়েদিরা একবছর ভালোভাবে বন্দিজীবন কাটালে তাদের শাস্তির মেয়াদ তিনমাস কমে যেত। এটাই হল মার্কা। কর্তাদের মন জোগাতে না পারলেই এই মার্কা প্রাপ্তির স্বাভাবিক অধিকার থেকে কয়েদিদের বঞ্চিত করা হত। বেচাল করলে কোনো কোনো কয়েদিকে কম্বলে ঢেকে প্রহার করা হত, আবার কখনও কয়েদির পায়ে পরিয়ে দেওয়া হত লোহার ভারী বেড়ি। জেলের নিয়মশৃঙ্খলা ভাঙলে বা জেলের কর্তাব্যক্তিদের তোয়াজ না করলে কয়েদিদের এইসব শাস্তি ভোগ করতে হত। এভাবেই বক্সা জেলের কয়েদিরা অত্যাচারিত হত এবং দুর্দশাগ্রস্ত ও দুরবস্থার জীবন কাটাত।
প্রশ্ন.24" তোমরা হাত বাড়াও, তাকে সাহায্য করো"-লেখক কাকে, কীভাবে, কেন সাহায্য করতে বলেছেন?
উত্তব়ঃ উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'হাত বাড়াও' শীর্ষক রচনায় যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষে বিপন্ন যে মানুষ দু-পায়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তাকে সাহায্য করার কথাই বলেছেন।
সাহায্যের পদ্ধতি: তীক্ষ্ণ সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে লেখক বুঝেছিলেন যে, যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষে মানুষের যে বিপন্নতা তা প্রকৃতপক্ষে মানুষেরই সৃষ্টি। বাংলাদেশের নানা প্রান্ত ঘুরে এরকমই অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন লেখক। ফরিদপুর যাওয়ার পথে রাজবাড়ির বাজারে বসে দু-পায়ে হাঁটতে অক্ষম একটি বারো-তেরো বছরের মাজা পড়ে যাওয়া কিশোরকে দেখে লেখকের মনে হয়, তার জ্বলন্ত দুটি চোখ যেন শাস্তি চায়। সেই সমস্ত মানুষের যারা শহরে গ্রামে-গঞ্জে জীবনের গলায় মৃত্যুর ফাঁস পরাচ্ছে, মাথা উচু করে জনগণকে বাঁচতে দিচ্ছে না। বাংলার সবুজ মাঠের সোনালি ফসলে, চাষির গোলাভরা ধানে শান্তি আসবে। কারখানায় বন্ধনমুক্ত মানুষের আন্দোলিত হাতের দ্বারা শান্তি আসবে। শোষণমুক্তির সংগ্রামে পাশে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়েই এই 'সাহায্য' সম্ভব হতে পারে।
সাহায্যের কারণ: লেখকের মতে, মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠার জন্য এই সাহায্যের প্রয়োজন। শহরে কিংবা গ্রামে যারা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে দিচ্ছে না-তাদের অন্যায়ের অবসান ঘটানোর জন্যই এই সাহায্যের প্রয়োজন। যুদ্ধ আর অনাহারে মৃত্যু বন্ধ করার জন্য, সুখ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই এই সাহায্যের প্রয়োজন বলে লেখক মন্তব্য করেছেন।
প্রশ্ন.25" কিন্তু আজও সেই দুটো জ্বলন্ত চোখ আমাকে থেকে থেকে পাগল করে।"-কোন্ ঘটনা প্রসঙ্গে লেখক এ কথা বলেছেন? এই ঘটনা লেখকের মধ্যে কোন্ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে?
অথবা, "কিন্তু আজও সেই দুটো জলন্ত চোখ আমাকে থেকে থেকে পাগল করে।"-লেখকের এই রকম মন্তব্যের কারণ কী?
উত্তব়ঃ প্রসঙ্গ: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আমার বাংলা থেকে নেওয়া 'হাত বাড়াও' রচনায় লেখক পঞ্চাশের মন্বন্তরের মর্মস্পর্শী ছবি তুলে ধরেছেন। "পাতলা কুয়াশায় মোড়া পঞ্চাশের আকালের এক সকাল”-এ রাজবাড়ির বাজারে বসে লেখক ফরিদপুরের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এই সময়েই তিনি একটু দূরে স্টেশনের রাস্তায় মিলিটারি ছাউনির পাশে এক 'অদ্ভুত জন্তু' দেখেন। চার পা-এ এগিয়ে আসতে থাকা সেই জন্তুটির সঙ্গে চেনা কোনো জন্তুরই মিল খুঁজে পাননি লেখক। কুয়াশার মধ্যেও জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ। সেই চোখের মধ্যে এমন এক মায়া ছিল যা 'বুকের রক্ত হিম' করে দিচ্ছিল। কিন্তু সামনে আসতেই লেখক স্তম্ভিত হয়ে যান। মাজা পড়ে যাওয়া বারো-তেরো বছরের এক উলঙ্গ ছেলে জানোয়ারের মতো চার পা-এ চলে বাজার থেকে চাল আর ছোলা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল। এই মর্মান্তিক দৃশ্যটির প্রসঙ্গেই লেখক মন্তব্যটি করেছেন।
▶ লেখকের প্রতিক্রিয়া: লেখক মানবশিশুর এই পরিণতি সহ্য করতে না পেরে ছুটে স্টেশনের দিকে পালিয়ে গেলেও সেই দৃশ্য তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। দু-হাতে সোনা ছড়ানো নদীমালার দিকে তাকিয়ে তিনি তার নিশ্বাস শুনতে পেয়েছেন। লেখকের মনে হয়েছে যে শিশুটি তার সরু লিকলিকে আঙুল দিয়ে যেন সেইসব খুনিদের শনাক্ত করছে যারা শহরে, গ্রামে, গঞ্জে জীবনের পলায় মৃত্যুর ফাঁস পরাচ্ছে, মানুষের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। তাই লেখক এমন মন্তব্য করেছেন।
প্রশ্ন.26” হাত বাড়াও' রচনাটির মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো। অথবা, 'হাত বাড়াও' রচনায় লেখকের বক্তব্যবিষয় কী বুঝিয়ে দাও।
উত্তব়ঃ মূল বজ্রব্য: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'হাত বাড়াও' রচনাটি প্যাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় লেখা। প্রকৃতির অসামান্য বিস্তার যে বাংলাদেশে, সেখানেই লেখক দেখেছেন মন্বন্তরের করাল ছায়া। তিনি দেখেছেন, অমৃতের পুত্র যে মানবশিশু, সে-ই দু-পায়ের সঙ্গে দু-হাতও খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। মাটিতে দিয়ে অদ্ভুত জন্ডুর মতো বাজারের মধ্যে পড়ে-থাকা চাল আর ছোলা খুঁজছে। সেই বারো-তেরো বছরের ছেলেটির মাজা পড়ে গেছে, হাঁটতে অক্ষম সে। তাই সে জানোয়ারের মতো চার পায়ে চলছে। ওই কিশোরের চোখ দিয়ে যেন লেখকের সামনে দুর্ভিক্ষের ভয়াল বাস্তবতা ধরা পড়ে। তাঁর মনে হয়, বাংলাদেশের নদীমালা জুড়ে যেন ওই কিশোরের নিশ্বাস ছড়িয়ে আছে। একইসঙ্গে এই দুর্ভিক্ষ আর তার উৎসেও পৌঁছে যেতে চান লেখক। যে মহাজন, জোতদাররা দুর্ভিক্ষকে ভয়াবহ করে তুলেছিল, লেখকের মনে হয় এই কিশোর যেন-"সরু লিকলিকে আঙুল দিয়ে সেইসব খুনিদের সে শনাক্ত করছে শহরে গ্রামে বন্দরে গঞ্জে জীবনের গলায় যারা মৃত্যুর ফাঁস পরাচ্ছে"। এই সূত্র ধরেই লেখক চেয়েছেন বাংলার বুক জুড়ে সবুজ মাঠে সোনালি ফসল ফলুক, কৃষকের গোলাভরা ধানে জীবনে শান্তি আসুক। যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের সর্বনাশকে অস্বীকার করে যে মানুষ মাটি থেকে দুটো হাত তুলে দু-পায়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া তাই আমাদের সামাজিক দায়। এই বক্তব্যই প্রকাশ পেয়েছে 'হাত বাড়াও' রচনাটিতে।
প্রশ্ন.27" অমৃতের পুত্র মানুষ।” নিহিত অর্থ বুঝিয়ে দাও।
উত্তব়ঃ প্রসঙ্গ: লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'হাত বাড়াও' রচনাটিতে 'অমৃতের পুত্র মানুষ' কথাটির উল্লেখ আছে। "পাতলা কুয়াশায় মোড়া পঞ্চাশের আকালের এক সকাল"-এ লেখক রাজবাড়ির বাজারে বসে অপেক্ষা করছিলেন ফরিদপুরের গাড়ির জন্য। সেই সময় অল্প দূরে স্টেশনের রাস্তায় মিলিটারি ছাউনির পাশে তিনি এক 'অদ্ভুত জন্তু' কে দেখেন চার পায়ে এগিয়ে আসতে। চেনা কোনো প্রাণীর সঙ্গে লেখক তার মিল খুঁজে পাননি। তার চোখের দৃষ্টিতে এমন এক মায়া ছিল "যা বুকের রক্ত হিম করে দেয়।” কিন্তু কাছাকাছি আসতেই লেখক বুঝতে পারেন যে, সে আসলে মানবসন্তান। এই প্রসঙ্গেই লেখক উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছেন।
▶ নিহিত অর্থ: পঞ্চাশের মন্বন্তর মানুষকে শুধু নিঃস্বই করেনি, তার অস্তিত্বকেও বিপন্ন করেছিল। শ্মশানের শূন্যতা নেমে এসেছিল বাংলাদেশ জুড়ে। তারই যেন প্রতীকী উপস্থাপন ঘটেছে উল্লিখিত অংশে। যাকে লেখক 'অদ্ভুত জন্ম' ভেবেছিলেন, কাছে আসতে দেখেন যে সে আসলে মানবপুত্র। কিন্তু যেভাবে সে রাস্তার ধুলো থেকে চাল ছোলা খুঁটে খাচ্ছিল তা বুঝিয়ে দেয় 'অমৃতের পুত্র মানুষ' কথাটি যেন এক চরম বিদ্রূপ। বারো-তেরো বছরের উলঙ্গ এক ছেলে, তার মাজা পড়ে গেছে, হাঁটতে পারে না, "তাই জানোয়ারের মতো চার পায়ে চলে।” এই জীবস্মৃত অবস্থায় বেঁচে থাকার মুখোমুখি হয়ে মানুষ কতটা 'অমৃতের পুত্র'-সে প্রশ্নই সম্ভবত পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক।
EDITING BY---- Liza Mahanta