Chapter 12

    আরোহমূলক দোষ

------------------------------


Long Answer Question

      

1. আরোহমূলক দোষ কী? বিভিন্নপ্রকার আরোহমূলক দোষের উল্লেখ ক


উত্তর: আরোহমূলক দোষ


আরোহ অনুমানোর ক্ষেত্রে আমরা কয়েকটি বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্তের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্তে একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করি। সিদ্ধান্তে এই সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করা হয় কিছু জাত সত্যের ওপর নির্ভর করে ঠিকই নির্ভর করে সিন্ধান্তে একটি সামান্য সংশ্লোক (Inductive rap) অবশ্যই থাকে। এই আরোহমূলক লাফের বিষয়টি সবসময় যে সঠিক হয়, এমন নয়। অর্থাৎ, এরূপ লাফের ক্ষেত্রে অবশ্যই একপ্রকার সংশয় থেকেই যায়। এর ফলে আরোহ অনুমানের সিখান্ত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কিছু ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষি লাফের ক্ষেত্রে অবশ্যই একপ্রকার পোদের সৃষ্টি হয়। আরও বলা যায় যে, আরোহ অনুমানের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম দোষের (fallacies) উদ্ভব হয়। অণুলিকেই মাছের আরোহমূলক দোষ (Inductive fallacies)


আরোহমূলক দোখের প্রকার


আরোহ অনুমানের সিদ্ধান্তটিকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে বিভিন্ন প্রকার দোষের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত দোষগুলিকে প্রধানত দু-ভাগে ভাগ করা -[1] অনুমান সংক্রান্ত দোষ এবং [2] অ-অনুমান সংক্রান্ত দোষ।


 অলুমান সংক্রান্ত দোষ


আরোহ অনুমানের ক্ষেত্রে যে সমস্ত নিয়মের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলিকে যথাযথভাবে মেনে না চললে যে দোষের উদ্ভব হয়, তাকেই বলা হয় অনুমান সংক্রান্ত দোষ। এই অনুমান সংক্রান্ত দোষগুলিকে আবার তিনভাগে বিভক্ত করা যায়-[1] কারণ সংক্রান্ত দোষ (2) সামান্যীকরণ সংক্রান্ত দোষ এবং [3] উপমা যুক্তি সংক্রান্ত দোষ।


(1) কারণ সংক্রান্ত দোষ: আরোহ অনুমানের মূল উদ্দেশ্য হল সিদ্ধান্তে একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করা। এর মাধ্যমে একপ্রকার কার্যকারণ সম্পর্ককে হলিত করা হয়। এই কার্যকারণ সম্পর্কটিকে তাই যথাযথভাবে উল্লেখ করতে হয়। এই সম্পর্কটিকে যদি যথাযথভাবে নির্ণয় করা না হয়, তাহলে কোনো কার্যের প্রকৃত কারণটি কখনোই ধরা পড়ে না। কোনো কার্যের প্রকৃত কারণকে উল্লেখ না করে, অবভাসিত কোনো কারণকে যদি প্রকৃত কারণরূপে উল্লেখ করা হয়, তাহলে যে দোষের উদ্ভব হয়, সেই দোষকেই বলা হয় কারণ সংক্রান্ত দোষ।


তারণ সংক্রান্ত দোষের বিভাগ: কারণ সংক্রান্ত দোষকে আবার চারভাগে ভাগ করা যায়- (a) অবান্তর শর্ত বা বিষয়কে কারণ বলার দোষ (b) সহকার্যকে কারণ বলার দোষ [c] একটি আবশ্যিক শর্তকে কারণ বলার দোষ এবং (d) কাকতালীয় দোষ। কোনো অবান্তর বিষয়কে যদি কোনো কার্যের কারণ বলে মনে করা হয় তাহলে অবান্তর বিষয়কে কারণ বলার দোষ হয়। একই কারণ থেকে উদ্ভূত দুটি বিষয়ের একটিকে যদি আর-একটির কারণ বলা হয়, তাহলে সহকার্যকে কারণ বলার দোষ হয়। কোনো ঘটনার একটি অনিবার্য বা আবশ্যিক শর্তকে যদি সমগ্র কারণরূপে মনে করা হয়, তাহলে একটি আবশ্যিক শর্তকে কারণ বলার দোষ হয়। আর অহেতুক কোনো পূর্ববর্তী ঘটনাকে কারণ বলা হলে কাকতালীয় দোষের উদ্ভব হয়।


অ-অনুমান সংক্রান্ত দোষ


আরো অনুমানের মূল উদ্দেশ্যই হল পর্যবেক্ষণলব্ধ কতকগুলি দৃষ্টান্তের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্যে যেসমস্ত দৃষ্টান্তগুলিকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তা যদি যথাযথ না হয়, তবে যে দোষের উদ্ভব হয়, তাকেই বলা হয় অ-অনুমান সংক্রান্ত দোষ। আমাদের পর্যবেক্ষণের শ্রান্তির জন্যই এই ধরনের দোষ উৎপন্ন হয় বলে একে পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত দোষ রূপেও উল্লেখ করা হয়। এই দোষ আবার দু- প্রকারের- [1] অপর্যবেক্ষণমূলক দোষ এবং (2) ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষ।


অপর্যবেক্ষণমূলক দোষকে আবার দু-ভাবে উল্লেখ করা যায়- [i] নঞর্থক দৃষ্টান্তের অপর্যবেক্ষণ এবং [ii] প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার অপর্যবেক্ষণ। ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষকে আবার দু-ভাগে বিভক্ত করা যায়- (i) ব্যক্তিগত ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষ এবং [ii] সার্বিক ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষ।


আরোহমূলক দোষের ছক


আরোহ অনুমান সংক্রান্ত দোষগুলিকে নীচের ছকটির সাহায্যে সহজভাবে উল্লেখ করা যায়।






2. অনুমান সংক্রান্ত দোষগুলি কী? উদাহরণ-সহ আলোচনা করো।


উওরঃ

আরোহ অনুমান সংক্রান্ত দোষ


আরোহ অনুমানের নিয়মগুলিকে যথাযথ অনুসরণ না করে যদি সিদ্ধান্ত গঠন করা হয় তাহলে অনুমান সংক্রান্ত দোষের উদ্ভব হয়। এই অনুমান সংক্রান্ত দোষ হল মূলত তিনটি-[1] কারণ সংক্রান্ত দোষ [2] সামান্যীকরণ সংক্রান্ত দোষ এবং [3] উপমা যুক্তি সংক্রান্ত দোষ। এই সমস্ত দোষগুলিকে নীচে উদাহরণ-সহ পরপর আলোচনা করা হল-


[1] কারণ সংক্রান্ত দোষ: আরোহ অনুমানের মূল কাজই হল সিদ্ধান্তে একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করা। এরূপ বচন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে একপ্রকার কার্যকারণ সম্বন্ধকে স্থাপন করা হয়। কার্যকারণ সম্বন্ধটিকে এক্ষেত্রে যথাযথভাবে উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু সবসময় এই কার্যকারণ সম্বন্ধকে যথাযথভাবে উল্লেখ করা যায় না। এর ফলে কোনো কার্যের প্রকৃত কারণটিকে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। প্রকৃত কারণটিকে যদি যথাযথভাবে নির্ণয় করা না যায়, তাহলে যে দোষের উদ্ভব ঘটে, সেই দোষকেই বলা হয় কারণ সংক্রান্ত দোষ।


উদাহরণ

যখনই জোয়ার হয় তারপরেই ভাটা হয়।

.: জোয়ারই হল ভাটার কারণ।




 

ব্যাখ্যা

আমাদের অভিজ্ঞতায় অনেক সময় দেখা যায় যে, একই সার্বিক নিয়মের জন্য দুটি ঘটনা ঘটে। এই দুটি ঘটনাকে তাই সহকার্যের মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। এই দুটি ঘটনার একটিকে তাই অন্যটির কারণ বলা যায় না। এক্ষেত্রে যদি একটিকে অন্যটির কারণ বলা হয়, তাহলে সেই দোষকে বলা হয় কারণ সংক্রান্ত দোষ। এই উদাহরণটিতে দেখা যায় যে, জোয়ারের পরই ভাটা আসে এবং সেকারণেই জোয়ারকে ভাটার কারণ বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জোয়ার এবং ভাটা কোনোটিই অন্যটির কারণ বা কার্য নয়। এ দুটি হল সহকার্যের সম্বন্ধে আবদ্ধ। কারণ, এই দুটি ঘটনাই পৃথিবীর আহ্নিক গতি নামক সার্বিক নিয়মের কার্যরূপে গণ্য। এর ফলে জোয়ারকে ভাটার কারণরূপে উল্লেখ করায় কারণ সংক্রান্ত দোষের উদ্ভব হয়েছে।



[2] সামান্যীকরণ সংক্রান্ত দোষ বা অবৈধ সামান্যীকরণ দোষ: আরোহ অনুমানের প্রকৃত উদ্দেশ্যই হল সিদ্ধান্তে কার্যকারণ সম্পর্কিত একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু কার্যকারণ সম্পর্কের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ না করে, যদি কেবলমাত্র আমাদের অবাধ অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্তে একটি সার্বিক সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তবে তা দোষযুক্ত হয়ে পড়ে। আরোহ অনুমানের ক্ষেত্রে এরূপ দোষকেই বলা হয় সামান্যীকরণ সংক্রান্ত দোষ। এই সামান্যীকরণ সংক্রান্ত দোষের নাম হল অবৈধ সামান্যীকরণ (fallacy of illicit generalization)। কারণ, এরূপ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে সামান্য বা সার্বিক বচনটি যথাযথভাবে নিঃসৃত না হয়ে অবৈধভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়।


উদাহরণ

এ পর্যন্ত আমি যতগুলো দাঁড়কাক দেখেছি সেগুলি সবই কালো।

.. সিদ্ধান্ত করা যায় যে, সব দাঁড়কাক হয় কালো।




 ব্যাখ্যা

উদাহরণটিতে দেখা যায় যে, আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় কিছু দাঁড়কাককে কালোরূপে দেখেছি। এর কোনো ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত আমাদের নজরে আসেনি। এই কয়েকটি অবাধ দৃষ্টান্তের ওপর নির্ভর করেই আমরা একটি সার্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, সব দাঁড়কাকই হয় কালো। এখানে কিন্তু দাঁড়কাক এবং কালো রং-এর মধ্যে কোনো প্রকৃত কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। সেকারণেই এখানে কার্যকারণ সম্পর্ককে উপেক্ষা করে আমরা কিছু বিশেষ হ্যাঁ-বাচক দৃষ্টান্ত থেকে একটি সার্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এর ফলে এরূপ আরোহ অনুমানটি অবৈধ সামান্যীকরণের দোষে (fallacy of illicit generalization) দুষ্ট।



[3] উপমা যুক্তি সংক্রান্ত দোষ বা মন্দ উপমার দোষ: আরোহ অনুমানের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, অনেক সময় আমরা উপমা বা সাদৃশ্য ব্যবহার করেও অনুমান গঠন করি। উপমা বা সাদৃশ্য ব্যবহার করে আমরা যখন কোনো অনুমান গঠন করি, তখন তাকে বলা হয় উপমা বা সাদৃশ্য যুক্তি (argument by মূল analogy)। উপমা যুক্তিতে দুটি বিষয় বা ঘটনার মধ্যে যদি কয়েকটি বিষয়ে মিল বা সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় এবং এদের কোনোটিতে যদি অন্য একটি নতুন বিশেষ ০৮ গুণ লক্ষ করা হয়, তাহলে অনুমান করা যায় যে, ওই নতুন বিশেষ গুণটি ে অপরটির মধ্যেও আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, যুক্তিবাক্যে যে সমস্ত গুণের সাদৃশ্য বা মিলের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্তে নতুন কোনো বিষয়ের সাদৃশ্য অনুমান করা হয়, তাকে প্রাসঙ্গিক ও যথাযথ হতে হয়। যদি এরূপ যথাযথ সাদৃশ্য দেখা যায় তাহলে সাদৃশ্য বা উপমা যুক্তিটি উত্তম উপমা (good analogy) রূপেই গণ্য হয়। কিন্তু সাদৃশ্য যদি যথাযথ বা প্রাসঙ্গিক না হয় তবে সেক্ষেত্রে যে দোষের উদ্ভব হয়, তাকে বলা হয় মন্দ


 উপমা (bad analogy)-র দোষ। অর্থাৎ, উপমার অপপ্রয়োগেই এরূপ দোষের। উদ্ভব ঘটে।




 উদাহরণ

একটি টেবিলের সঙ্গে একটি গোরুর কিছু বিষয়ে মিল দেখা গেল, যেমন-উভয়েরই একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা আছে, উভয়েরই চারটি পা আছে ইত্যাদি।

আবার দেখা গেল যে, গোরু আমাদের দুধ দেয় (যা গোরুর মধ্যে একটি নতুন গুণরূপে গণ্য)।

সুতরাং, উপমার ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, টেবিলও আমাদের দুধ দেবে।

 


 ব্যাখ্যা

এরূপ উদাহরণটি হল একটি মন্দ বা দুষ্ট উপমার (bad analogy)

উদাহরণ। কারণ এখানে যুক্তিবাক্যে গোরু এবং টেবিলের মধ্যে যে সাদৃশ্য বা উপমা রচনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে সিদ্ধান্তে অনুমেয় সাদৃশ্যটি কখনও প্রাসঙ্গিক বা যথাযথ নয়। এরূপ উপমাটি একেবারেই। অবাস্তব এবং কাল্পনিক। সেকারণেই এরূপ যুক্তিটির ক্ষেত্রে মন্দ উপমার উদ্ভব হয়েছে।




4. অ-অনুমান সংক্রান্ত দোষ কোনগুলি? অপর্যবেক্ষণমূলক দোষ কী? 

 
উওরঃ

 অ-অনুমান সংক্রান্ত দোষসমূহ


আরোহ অনুমানের ক্ষেত্রে অনুমান সংক্রান্ত দোষ ছাড়াও আর এক ধরনের দোষ দেখা যায় এবং সেই দোষটি হল অ-অনুমান সংক্রান্ত দোষ। এই অ-অনুমান সংক্রান্ত দোষকেই বলা হয় পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত দোষ। আরোহ অনুমানের ক্ষেত্রে আমরা মূলত অনুমানই গঠন করি। কিন্তু সেই অনুমান নির্ভর করে কতগুলি পর্যবেক্ষণলব্ধ দৃষ্টান্তের ওপর। সুতরাং অনুমানের ক্ষেত্রে যে পর্যবেক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রেও আমাদের নানারকম ভ্রান্তির সম্ভাবনা থেকে যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নানা রকম দোষের উদ্ভব ঘটে।


অ-অনুমান সংক্রান্ত দোষ তথা পর্যবেক্ষণমূলক দোষকে তর্কবিদ মিল (Mill) মূলত দু-ভাগে ভাগ করেছেন- [1] অপর্যবেক্ষণমূলক দোষ (fallacy of non-observation) এবং [2] ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষ (fallacy of mal- observation)। এই দু-ধরনের দোষই মূলত আমাদের পর্যবেক্ষণের ত্রুটি [2 থেকে উঠে আসে। ইন্দ্রিয়ের দুর্বলতা, আবেগ এবং নানাবিধ সংস্কারের ফলে অনেক সময় যথাযথভাবে অনুমানের দৃষ্টান্তগুলির পর্যবেক্ষণের ব্যর্থতাই এই সমস্ত দোষের উদ্ভব ঘটায়।


অপর্যবেক্ষণমূলক দোষ


আরোহ অনুমানের মূল উদ্দেশ্যই হল সিদ্ধান্তে একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করা। এই সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে আমরা একপ্রকার কার্যকারণ সম্পর্ককে উল্লেখ করতে চাই। এর জন্য প্রয়োজন হল বিভিন্ন রকম ঘটনা বা দৃষ্টান্তকে পর্যবেক্ষণ করা। কারণ, যথাযথ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই সঠিক কার্যকারণ সম্পর্ককে হাজির করা যায়। কিন্তু নানা কারণে আমরা প্রয়োজনীয় ঘটনা বা দৃষ্টান্তসমূহকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি না। এর ফলে কিছু ঘটনা বা দৃষ্টান্তের অপর্যবেক্ষণ থেকেই যায়। এরূপ অবস্থা সত্ত্বেও যদি আমরা কোনো অনুমান গঠন করি, তবে তা দোষযুক্ত হয়ে পড়ে। অনুমানের ক্ষেত্রে এরূপ দোষকেই বলা হয় অপর্যবেক্ষণমূলক দোষ।


5. অপর্যবেক্ষণমূলক দোষ কয়প্রকার ও কী কী? উদাহরণ-সহ আলোচনা করো।

 

উওরঃ অপর্যবেক্ষণমূলক দোষের শ্রেণিবিভাগ


অপর্যবেক্ষণমূলক দোষকে আবার দু-ভাগে ভাগ করা হয়- [1] নঞর্থক দৃষ্টান্তের অপর্যবেক্ষণ (non-observation of relevant negative instances) এবং [2] প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার অপর্যবেক্ষণ (non-observation of essential circumstances)। এই দু-ধরনের অপর্যবেক্ষণমূলক দোষকে উদাহরণ-সহ নীচে আলোচনা করা হল-


[1] নঞর্থক দৃষ্টান্তের অপর্যবেক্ষণ: কোনো একটি ঘটনাকে যথাযথভাবে আলোচনা করার জন্য সেই ঘটনাটির সঙ্গে জড়িত সমস্ত সদর্থক ও নঞর্থক ঘটনা বা শর্তসমূহকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। কারণ, আমরা কোনো ঘটনার আলোচনার মাধ্যমেই তার কার্যকারণ সম্পর্ককে নির্ণয় করি। কারণ হল সদর্থক ও নঞর্থক ঘটনা বা শর্তের সমষ্টি। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যে, আমরা শুধুমাত্র সদর্থক ঘটনাগুলিকেই পর্যবেক্ষণ করে থাকি, নঞর্থক ঘটনাসমূহকে পর্যবেক্ষণ করি না। এর ফলে গঠিত আরোহ অনুমানটি দোষযুক্ত হয়ে পড়ে। এরূপ দোষটি হল নঞর্থক দৃষ্টান্তের অপর্যবেক্ষণ। এখানে নঞর্থক দৃষ্টান্তগুলিকে না-দেখা বা উপেক্ষা করা হয় বলে এরূপ দোষটিকে না-দেখা বা উপেক্ষার দোষরূপেও উল্লেখ করা হয়।



উদাহরণ

কয়েক দিন বৃহস্পতিবারের বারবেলায় যাত্রা করে অশুভ লক্ষণ দেখা দিয়েছে।

অতএব, সিদ্ধান্ত করা যায় যে, বৃহস্পতিবারের বারবেলায় যাত্রা অশুভ।



 ব্যাখ্যা

এখানে আমরা ঘটনার কয়েকটি সদর্থক দৃষ্টান্তকে পর্যবেক্ষণ করেছি মাত্র। এখানে কোনো নঞর্থক দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। অর্থাৎ,

বৃহস্পতিবারের বারবেলায় যাত্রা করেও যেসমস্ত ক্ষেত্রে কোনো অশুভ সংকেত পাওয়া যায়নি, সেগুলিকে উপেক্ষা করা হয়েছে বা পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। অথচ আরোহ অনুমানটি গঠনের ক্ষেত্রে এগুলিকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত ছিল। সেকারণেই এরূপ যুক্তিটি নঞর্থক দৃষ্টান্তের অপর্যবেক্ষণজনিত দোষে দুষ্ট।


[2] প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার অপর্যবেক্ষণ: অনেক সময় দেখা যায়, আরোহ অনুমানের ক্ষেত্রে আমরা যে কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত একটি সার্বিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করি, সেই প্রক্রিয়ায় ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রয়োজনীয় বহু পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে উপেক্ষা করে থাকি। পারিপার্শ্বিক অবস্থাগুলির মধ্যে যেমন অনেক অবান্তর ঘটনা থাকে, তেমনি আবার অনেক প্রয়োজনীয় ঘটনাও থাকে। যথাযথভাবে কার্যকারণ সম্বন্ধমূলক আরোহ সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে এই সমস্ত প্রয়োজনীয় অবস্থাসমূহকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এগুলিকে উপেক্ষা করে যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তবে তা দোষযুক্ত হয়ে পড়ে। এরূপ দোষকেই বলা হয় প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার অপর্যবেক্ষণজনিত দোষ।



উদাহরণ

পরীক্ষার আগের দিন গৃহশিক্ষক ছাত্রকে পড়াতে আসেননি এবং ছাত্রটির পরীক্ষায় ফল ভালো হয়নি। সুতরাং অনুমান করা যায় যে, পরীক্ষার আগের দিন গৃহশিক্ষকের অনুপস্থিতিই হল ছাত্রটির পরীক্ষায় ভালো ফল না করার কারণ।






  ব্যাখ্যা

এরূপ অনুমানটিতে যে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে কোনো ছাত্রের পরীক্ষার ফল ভালো না হওয়া নামক কার্যটির কারণ হিসেবে শুধুমাত্র একটি অবস্থার তথা পরীক্ষার আগের দিন গৃহশিক্ষকের অনুপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য আর যে সমস্ত প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা আছে, সেগুলির কথা আদৌ উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ, অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থাগুলিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। যেমন-প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়া, ভালো করে প্রস্তুতি না নেওয়া, পরীক্ষার হলে দেরিতে উপস্থিত হওয়া, প্রশ্ন পেয়ে মাথা ঘোরা ইত্যাদি অবস্থাগুলিকে আদৌ উল্লেখ করা বা পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। সেকারণেই এরূপ অনুমানটি প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার অপর্যবেক্ষণ দোষে দুষ্ট।


6. [i] টীকা লেখো: কাকতালীয় দোষ

[ii] ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষ কয়প্রকার ও কী কী? উদাহরণ-সহ আলোচনা করো।


উওরঃ

[1] কাকতালীয় দোষ


যে কোনো পূর্ববর্তী ঘটনাকে কারণরূপে গ্রহণ করলে কাকতালীয় দোষের উদ্ভব হয়। এরূপ দোষে যা প্রকৃত কারণ নয় তাকেই কারণ বলে উল্লেখ করা হয় (Non-causa Pro-causa)। কাকতালীয় দোষ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কারণের গুণগত লক্ষণে বলা হয়েছে যে, কারণ হল শর্তহীন, অপরিবর্তনীয় অব্যবহিত পূর্ববর্তী ঘটনা। অর্থাৎ, কার্যের যে-কোনো অব্যবহিত পূর্ববর্তী ঘটনাকেই কারণ বলা যায় না। কোনো কার্যের ঠিক আগের ঘটনাটি অনেক সময় আকস্মিকও হতে পারে। আর ঘটনাটি যদি আকস্মিক হয় তবে তা কখনোই শর্তহীন ও অপরিবর্তনীয় রূপে গণ্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে কার্যের ঠিক আগের ওই আকস্মিক ঘটনাটিকে যদি কার্যটির কারণ বলে ধরা হয়, তাহলে যে দোষের উদ্ভব হয়, তাকেই বলা হয় কাকতালীয় দোষ (fallacy of post hoc ergo propter hoc)।


কাকতালীয় দোষের হেতু


কাকতালীয় দোষটির উদ্ভব হয়েছে এভাবেই যে, তাল গাছের ওপর দিয়ে কাক উড়ে যাওয়ায় তালটি মাটিতে পড়ে গেল। সেকারণেই কাক উড়ে যাওয়াকে তাল পড়ার কারণ বলে মনে করা হয়েছে। সাধারণত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং অবাস্তব কল্পনাই হল এই দোষের মূলভিত্তি। আবার, অনেক সময় দেখা যায় যে, ব্যতিরেকী পদ্ধতির অপপ্রয়োগের ফলেও এই ধরনের দোষের উদ্ভব হয়। ব্যতিরেকী পদ্ধতি যদি পরীক্ষণের ওপর নির্ভর না করে পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভরশীল হয়, তখন তার অপপ্রয়োগে অনেক সময় এই ধরনের দোষ ঘটে থাকে।




উদাহরণ

মাদুলি ধারণ করার পরই তার রোগ সারল।

সুতরাং, মাদুলি ধারণই হল তার রোগ সারার কারণ।

আরোহ যুক্তিটিকে ব্যতিরেকী পদ্ধতির আকারে উপস্থাপিত করলে পাই,



উদাহরণ


  পূর্ববর্তী ঘটনা

অনুবর্তী ঘটনা

মাদুলি ধারণ হয়নি

মাদুলি ধারণ হয়েছে।

রোগ সারেনি

রোগ সেরেছে।

 

         .: মাদুলি ধারণ রোগ সারার কারণ।






 ব্যাখ্যা

এখানে এই আরোহ যুক্তিটিকে ব্যতিরেকী পদ্ধতির আকারে সাজিয়ে পর্যবেক্ষণের সাহায্যে মাদুলি ধারণরোগ সারার মধ্যে একপ্রকার কার্যকারণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মাদুলি ধারণ কখনোই রোগ সারার প্রকৃত কারণ নয়। যদিও মাদুলি ধারণ রোগ সারার পূর্ববর্তী ঘটনারূপে গণ্য, তবু তা নেহাতই এক আকস্মিক ঘটনা। এরূপ ঘটনাটি তাই নিয়ত ও শর্তান্তরহীন নয়। এ হল আমাদের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারপ্রসূত চিন্তামাত্র। এক্ষেত্রে তাই কাকতালীয় দোষ-এর উদ্ভব হয়েছে।


[ii] ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষের প্রকার


পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় যে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের অক্ষমতা বা অসুস্থতার কারণে কোনো বস্তুকে ঠিক সেই বস্তুরূপে পর্যবেক্ষণ না করে অন্য বস্তুরূপে পর্যবেক্ষণ করে থাকি। যেমন-আমরা অনেক সময়ই কোনো ছায়াকে কায়ারূপে, দড়িকে সাপরূপে এবং চলন্ত ট্রেনে গাছপালা প্রভৃতিকে ছুটন্তরূপে দেখে থাকি। এরূপ ভ্রান্ত প্রত্যক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে যদি কোনো অনুমান টির গঠন করা হয় তবে সেই অনুমানটি দোষযুক্ত হয়ে পড়ে। এই ধরনের দোষের নাম হল ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষ।

 

এই ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষকে আবার দু-ভাগে ভাগ করা যায়-[1] ব্যক্তিগত ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষ (fallacy of individual mal-observation) এবং [2] সার্বিক ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষ (fallacy of universal mal-observation)। এই দু-ধরনের দোষের বিষয় দুটিকে উদাহরণ-সহ নীচে উল্লেখ করা হল-


[1] ব্যক্তিগত ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষ: অনুমান গঠন করতে গিয়ে যদি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনাকে ব্যক্তিবিশেষ ভুল হিসেবে দেখে, তবে সেই ধরনের পর্যবেক্ষণকে বলা হয় ব্যক্তিগত ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ। এখানে পর্যবেক্ষণগত ভুলটি হল কোনো একজন ব্যক্তির, সার্বিকভাবে কোনো ভ্রান্তি নয়। যেমন-দূরের কোনো গাছের কাণ্ডকে দেখে মানুষ মনে করা, কোনো মহিলাকে দেখে পুরুষ মনে করা ইত্যাদি।


[2] সার্বিক ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণমূলক দোষ: কোনো ঘটনার পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিবিশেষের ভ্রান্তি না হয়ে যদি তা কোনো সার্বিক নীতির ফলে ভ্রান্তি হয়, তবে সেই ধরনের পর্যবেক্ষণকে বলা হয় সার্বিক ভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ। এখানে ব্যক্তিবিশেষের ভ্রান্তির কোনো ভূমিকা থাকে না। এখানে থাকে সঠিক কোনো নীতির ভ্রান্তিমূলক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, জলপূর্ণ কাঁচের পাত্রে ডোবানো কোনো লাঠিকে বাঁকা দেখার ভ্রান্তি, সমউচ্চতাসম্পন্ন পরপর বাড়িগুলিকে ক্রমান্বয়ে বেশি উচ্চতাসম্পন্নরূপে দেখার ভ্রান্তি ইত্যাদি।


7. [i] একটি আবশ্যিক বিষয় বা শর্তকে কারণ বলে মনে করার দোষ কী? উদাহরণ-সহ আলোচনা করো।

  [ii] সংক্ষিপ্ত টাকা লেখো: সহকার্যকে কারণ বলার দোষ  


উওরঃ


[i] একটি আবশ্যিক শর্তকে কারণ বলার দোষ


কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করার ক্ষেত্রে কার্যের পূর্ববর্তী ঘটনারূপে যে সমস্ত বিষয় লক্ষ করা যায় সেগুলি কতকগুলি শর্তের সমষ্টি মাত্র। এই সমস্ত শর্তগুলির কোনো কোনোটি আবশ্যিক বা অনিবার্য (necessary) রূপে গণ্য হতে পারে, আবার সেগুলির কোনো কোনোটি অনাবশ্যক বা অবান্তর রূপেও গণ্য হতে পারে। কারণের ক্ষেত্রে আবার একাধিক অনিবার্য শর্তও থাকতে পারে। একাধিক অনিবার্য শর্তের সমষ্টিকে কারণরূপে উল্লেখ না করে, যদি তাদের মধ্যে থেকে একটিমাত্র অনিবার্য শর্তকে কারণরূপে উল্লেখ করা হয়, তাহলে যে দোষের উদ্ভব হয়, তাকে বলা হয় একটি আবশ্যিক শর্তকে কারণ বলে মনে করার দোষ।


উদাহরণ

বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার ফলেই বৈদ্যুতিক ট্রেন চলতে শুরু করল। অতএব, সিদ্ধান্ত করা যায় যে, বৈদ্যুতিক সংযোগই হল বৈদ্যুতিক ট্রেন চলার কারণ।





ব্যাখ্যা

উদাহরণটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ সংযোগই হল ট্রেন চলার একমাত্র কারণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র বিদ্যুৎ সংযোগই ট্রেন চলার কারণরূপে গণ্য হতে পারে না। কারণ, বিদ্যুৎ সংযোগ ট্রেন চলার একটি আবশ্যিক শর্ত মাত্র, কখনোই তা সম্পূর্ণ কারণ নয়। এরূপ একাধিক আবশ্যিক শর্ত কারণের ধারণার মধ্যে থাকতেই পারে, যেমন- ট্রেনের ইঞ্জিন ঠিক থাকা, ড্রাইভারের ট্রেন চালানো, ট্রেন লাইন যথাযথ থাকা ইত্যাদি। ট্রেন চলার জন্য এই সমস্ত শর্তগুলোও একান্ত প্রয়োজন। এগুলোও আবশ্যিক শর্তরূপে গণ্য। কিন্তু এই সমস্ত শর্তগুলোকে কারণের অন্তর্ভুক্ত না করে যদি শুধুমাত্র বিদ্যুৎ সংযোগকেই ট্রেন চলার কারণরূপে উল্লেখ করা হয়, তাহলে এরূপ একটি আবশ্যিক শর্তকে কারণ বলে মনে করার দোষ উৎপন্ন হয়।



[ii] সহকার্যকে কারণ বলার দোষ



কার্যকারণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায় যে, কারণ হল কার্যের পূর্ববর্তী ঘটনা এবং কার্য হল কারণের অনুবর্তী ঘটনা। কিন্তু কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমরা সবসময় যথাযথভাবে এই পূর্ববর্তী ও অনুবর্তী ঘটনার হিসেবটি মাথায় রাখি না। আমাদের অভিজ্ঞতায় অনেক সময় দেখা যায় যে, একই সার্বিক নীতির ফলে দু-ধরনের কার্য সংঘটিত হয়। এই দু-ধরনের কার্য তাই একে অপরের সহকার্যের সম্পর্কে আবদ্ধ। সেকারণেই এই দুটির একটি কখনোই অন্যটির কারণ হতে পারে না। দুটি সহকার্যের একটিকে যদি অন্যটির কারণ বা কার্য বলে মনে করা হয় তাহলে যে দোষের উদ্ভব হয়, সেই দোষের নাম হল সহকার্যকে কারণ বলার দোষ।


উদাহরণ

দিনের পর রাত্রি আসে।

সুতরাং সিদ্ধান্ত করা যায় যে, দিন হল রাত্রির

অথবা

জোয়ারের পর ভাটা আসে

 .. জোয়ার হল ভাটার কারণ।




ব্যাখ্যা

এই উদাহরণগুলিতে দেখা যায় যে, দিন ও রাত্রি এবং জোয়ার ও ভাটা নামক ঘটনাগুলি একই সার্বিক কারণ থেকে নিঃসৃত। এই সার্বিক কারণটি হল পৃথিবীর আহ্নিক গতি। সেকারণেই দিন ও রাত্রিকে এবং জোয়ার ও ভাটাকে সহকার্যরূপে গণ্য করা হয়। এগুলির একটি তাই অপরটির কারণ হতে পারে না। সেকারণেই এরূপ যুক্তিগুলিতে সহকার্যকে কারণরূপে মনে করার দোষ ঘটেছে।

 


8.নীচের আরোহ যুক্তিগুলির দোষ বিচার করো: হেমন্তের পর শীত আসে। অতএব হেমন্ত শীতের কারণ।


উওরঃ


আরোহ যুক্তি

হেমন্তের পর শীত আসে। অতএব, হেমন্ত শীতের কারণ।

দোষ

সহকার্যকে কারণ মনে করার দোষ (fallacy of mistaking coeffect as a cause)।

সিদ্ধান্ত

ভ্রান্ত ও দোযযুক্ত



ব্যাখ্যা ও বিচার

এই আরোহ যুক্তিটি সহকার্যকে কারণ বলে মনে করার দোষে দুষ্ট। কারণ, হেমন্ত ও শীত এই দুটি ঋতু হল একই কারণ তথা পৃথিবীর বার্ষিক গতি থেকে উদ্ভূত। সুতরাং, এই

দুটি ঋতু সহকার্য রূপেই গণ্য। এই দুটির একটিকে তাই কখনোই অপরটির কারণ বা কার্য বলা যায় না। অথচ এখানে সেটাই করা হয়েছে বলে আরোহ যুক্তিটি উক্ত দোষে দুষ্ট হয়েছে।



9.চের আরোহ যুক্তিটির বিচার করো এবং কোনো দোষ থাকলে তা উল্লেখ করো:

ছাত্রটির পরীক্ষায় খারাপ ফলের কারণ হল তার গৃহশিক্ষকের অনুপস্থিতি।


উওরঃ


আরোহ যুক্তি

ছাত্রটির পরীক্ষায় খারাপ ফলের কারণ হল তার গৃহশিক্ষকের অনুপস্থিতি।

দোষ

একটি আবশ্যিক শর্তকে কারণ বলে মনে করার দোষ (fallacy of mistaking a necessary condition as a cause) অথবা, প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার অপর্যবেক্ষণমূলক দোষ (fallacy of non-observation of relevant instances)।

সিদ্ধান্ত

ভ্রান্ত ও দোষযুক্ত







ব্যাখ্যা ও বিচার

এই যুক্তিটির ক্ষেত্রে যে দোষের উদ্ভব হয়েছে, তা হল একটি আবশ্যিক শর্তকে কারণ বলে মনে করার দোষ। কারণ, গৃহশিক্ষকের অনুপস্থিতি ছাত্রটির পরীক্ষায় খারাপ ফলের একটি আবশ্যিক শর্ত হতে পারে, কিন্তু কখনোই তা সমগ্র কারণরূপে বিবেচিত হতে পারে না। গৃহশিক্ষকের অনুপস্থিতি ছাড়াও ছাত্রটির পরীক্ষার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি না নেওয়া, শরীর সুস্থ না থাকা, বাড়িতে অশান্তি হওয়া এবং প্রশ্নপত্র কঠিন হওয়া প্রভৃতি নানাবিধ শর্তই থাকতে পারে। এখানে সেই সমস্ত শর্তগুলিকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র একটি আবশ্যিক শর্তকে ঘটনার সমগ্র কারণ বলে মনে করায় উক্ত দোষের উদ্ভব হয়েছে।আবার ছাত্রটির পরীক্ষায় খারাপ ফলের জন্য যে সমস্ত পারপার্শ্বিক অবস্থা জড়িত আছে, সেগুলিকে আদৌ পর্যবেক্ষণ করা হয়নি বলে এই আরোহ যুক্তিটি প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার অপর্যবেক্ষণমূলক দোষেও দুষ্ট।



10. কারণ সংক্রান্ত দোষ কোনগুলি? উদাহরণ-সহ অবান্তর বা অপ্রাসঙ্গিক শর্তকে কারণ মনে করার দোষটি আলোচনা করো।


উওরঃ

কারণ সংক্রান্ত দোষ


আরোহ অনুমানের সিদ্ধান্তে আমরা যে একটি সামান্য সংশ্লেষক বচন প্রতিষ্ঠা করি তার মাধ্যমে একপ্রকার কার্যকারণ সম্পর্কের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। সিদ্ধান্তে এই কার্যকারণ সম্পর্কটিকে যথাযথ বা সার্বিকভাবে নির্ণয় করতে হয়। কিন্তু কার্যকারণ সম্পর্কটি যদি যথাযথ বা সার্বিকভাবে নির্ণয় না করে অযথার্থ বা ভুলভাবে নির্ণয় করা হয়, তাহলে আরোহ অনুমানের ক্ষেত্রে কারণ সংক্রান্ত দোষ-এর আবির্ভাব ঘটে। কারণ সংক্রান্ত দোষরূপে যেগুলিকে উল্লেখ করা যায়, সেগুলি হল-[1] অবান্তর শর্তকে কারণ বলার দোষ, [2] একটি আবশ্যিক শর্তকে কারণ বলার দোষ, [3] সহ-কার্যকে কারণ বলার দোষ এবং [4] কাকতালীয় দোষ প্রভৃতি।


অবান্তর বা অপ্রাসঙ্গিক শর্তকে কারণ বলে মনে করার দোখ


কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করার ক্ষেত্রে আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি কোনো ঘটনার প্রকৃত কারণটিকে উল্লেখ করতে। কিন্তু কোনো ঘটনার প্রকৃত কারণকে নির্ণয় করা কখনোই সহজসাধ্য নয়। কারণকে বলা হয় কার্যরূপ ঘটনার নিয়ত পূর্ববর্তী ঘটনা। এই পূর্ববর্তী ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিভিন্ন রকম শর্ত (conditions)। সমস্ত শর্তগুলি প্রাসঙ্গিকও হতে পারে, আবার তা অপ্রাসঙ্গিকও হতে পারে। কার্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে সমস্ত শর্ত বা ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, সেগুলিকে বলা হয় প্রাসঙ্গিক শর্ত। আর যে সমস্ত শর্ত বা ঘটনার কোনো ভূমিকাই নেই, সেগুলিকে বলা হয় অপ্রাসঙ্গিক বা অবান্তর শর্ত। কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমাদের কাজ হল এই সমস্ত অপ্রাসঙ্গিক বা অবান্তর ঘটনাগুলিকে সরিয়ে রেখে প্রাসঙ্গিক শর্তসমূহকে কারণরূপে উল্লেখ করা। কিন্তু আমরা সবসময় এরূপ প্রয়াে সফল হই না। অনেক সময় আমরা তাই ভুলক্রমে অথবা অজ্ঞতা অনুসা কোনো অপ্রয়োজনীয় অবান্তর শর্তকে কারণ বলে মনে করি এবং এভাে কার্যকারণ সম্বন্ধকে প্রতিষ্ঠা করি। যখনই এরূপ করা হয় তখন যে দোলে আবির্ভাব হয়, তাকে বলে অবান্তর শর্ত বা বিষয়কে কারণ বলে মনে ক দোষ। সাধারণত অন্বয়ী পদ্ধতি এবং সহপরিবর্তন পদ্ধতির অপপ্রে এরূপ দোষের উদ্ভব ঘটে।


উদাহরণ

জলের সঙ্গে বিভিন্ন রকম ওষুধ খেয়ে বিভিন্ন রকম রোগের নিরাময় হয়েছে।

.: অন্বয়ী পদ্ধতির সাহায্যে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, জলই হল রোগ নিরাময়ের কারণ।



 ব্যাখ্যা

উদাহরণটিতে দেখা যায় যে, বিভিন্ন রকম রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম ওষুধের ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ, কোনো একটি নির্দিষ্ট ওষুধ কখনোই সবক্ষেত্রে উপস্থিত নয়। কিন্তু বিভিন্ন রকম রোগ নিরাময়ের সবক্ষেত্রেই জলপান সাধারণভাবে উপস্থিত বলে জলপানকেই রোগ নিরাময়-এর কারণরূপে অনুমান করা হয়। বাস্তবে কিন্তু জলপানের সঙ্গে রোগ নিরাময়ের কোনো প্রকৃত কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। জলপানকে তাই রোগ নিরাময়ের একটি অবান্তর শর্ত বলা যায়। এক্ষেত্রে তাই অবান্তর বিষয়কে কারণ বলে মনে করার দোষের উদ্ভব হয়েছে।


11.সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো-মন্দ উপমা


উত্তর:  মন্দ উপমা


আরোহ অনুমানের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, অনেক সময় আমরা উপমা বা সাদৃশ্য ব্যবহার করেও অনুমান গঠন করি। উপমা বা সাদৃশ্য ব্যবহার করে আমরা যখন কোনো অনুমান গঠন করি তখন তাকে বলা হয় উপমা বা সাদৃশ্য যুক্তি (argument by analogy)। উপমা যুক্তিতে দুটি বিষয় বা ঘটনার মধ্যে যদি কয়েকটি বিষয়ে মিল বা সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় এবং এদের কোনোটিতে যদি অন্য শ্য একটি নতুন বিশেষ গুণ লক্ষ করা হয়, তাহলে অনুমান করা যায় যে, ওই নতুন


আরোহমূলক দোষ


বিশেষ গুণটি অপুরটির মধ্যেও আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, যুক্তিবাক্যে যে সমস্ত গুণের সাদৃশ্য বা মিলের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্তে অপর কোনো নতুন বিষয়ের সাদৃশ্য অনুমান করা হয়, তাকে প্রাসঙ্গিক তথ্য দরকার যে, যুক্তিবাক্যে যে সমস্ত গুণের সাদৃশ্য বা মিলেছিলে সাদৃশ্য বা উপমা যুক্তিটি উত্তম উপমা (good analogy) রূপেই গণ্য হয়। কিন্তু সাদৃশ্য যদি যথাযথ বাঘা হতে হয়। যদি এরুপ যথাযথ সাদৃশ্য দেখা যায় তায়, তাকে বলা হয় মন্দ উপমা (bad analogy)-র দোষ। অর্থাৎ, উপমার অপপ্রয়োগেই এরূপ দোষের উদ্ভব ঘটে।



উদাহরণ

একটি টেবিলের সঙ্গে একটি গোরুর কিছু বিষয়ে মিল দেখা গেল, যেমন—উভয়েরই একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা আছে, উভয়েরই চারটি পা আছে ইত্যাদি। আবার দেখা গেল যে, গোরু আমাদের দুধ দেয় (যা গোরুর মধ্যে একটি নতুন গুণরূপে গণ্য)। সুতরাং, উপমার ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, টেবিলও আমাদের দুধ দেবে।



ব্যাখ্যা

এরূপ উদাহরণটি হল একটি মন্দ বা দুষ্ট উপমার (bad analogy) উদাহরণ। কারণ এখানে যুক্তিবাক্যে গোরু এবং টেবিলের মধ্যে যে সাদৃশ্য বা উপমা রচনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে সিদ্ধান্তে অনুমেয় সাদৃশ্যটি কখনও প্রাসঙ্গিক বা যথাযথ নয়। এরূপ উপমাটি একেবারেই অবাস্তব এবং কাল্পনিক। সেকারণেই এরূপ যুক্তিটির ক্ষেত্রে মন্দ উপমার উদ্ভব হয়েছে।