Chapter 19
বাংলা গানেব় ইতিহাস
----------------------------------------
MCQ
1. কোন যুগ পর্যন্ত পৃথিবীর যে-কোনো ভাষার সাহিত্যকে প্রকৃত প্রস্তাবে সংগীত আখ্যা দেওয়া যায়?
(a) আদিযুগ
(b) আদি মধ্যযুগ
(c) আধুনিক যুগ
(d) বাউল গান
2. বাংলা সংগীতের আদিতম লিখিত নিদর্শন কী।
(a) চর্যাপদ
(b) শ্রীকৃয়কীর্তন
(c) বৈয়ব পদাবলি
(d) বাউল গান
উত্তব়ঃ (a) চর্যাপদ
3. চর্যাগানের মোট পদ সংখ্যা কত?
(a) ছেচল্লিশ
(b) সাতচল্লিশ
(c) পঞ্চাশ
(d) একান্ন
4. চর্যাপদ রচিত হয় আনুমানিক-
(a) অষ্টম থেকে নবন শতাব্দীব় মধ্যে
(b) নবম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে
(c) দশম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে
(d) দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে
5.চর্যাগানগুলির আবিষ্কারক
(a) বসন্তরঞ্জন রায়
(b) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
(c) দীনেশরঞ্জন সেন
(d) মুনিদত্ত
6. চর্যাপানের রচয়িতা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের সিদ্ধাচার্যরা।
(a) বৌদ্ধ
(b) জৈন
(c) শাক্ত
(d) বৈয়ব
7. চর্যার যুগে সংগীতের কয়টি অঙ্ক দেখা যায়।
(a) দুটি
(b) চারটি
(c) পাঁচটি
(d) ছয়টি
8. চর্যাপদ-এর এই রাগটি এখনও প্রচলিত আছে-
(a) কামোদ
(b) গউড়া
(c) শবরী
(d) বঙ্গাল
9. চর্যাপদ-এর কোন রাগটি বর্তমানে অপ্রচলিত বা বিলুপ্ত?
(a) মল্লারী
(b) কামোদ
(c) ভৈরবী
(d) শবরী
10. চর্যার যুগে তালের বোল উচ্চারণ করতে কোন অঙ্গ ব্যবহৃত হত?
(a) স্বর
(b) বিরুদ্ধ
(c) তেনক
(d) পাট
11. চর্যাপদ-এ স্তুতিবাচক অঙ্গটি কী?
(a) বিবুদ
(b) তেনক
(c) পাট
(d) তাল
12. চর্যাপদ-এ মঙ্গলবাচক অঙ্গটি কী?
(a) স্বর
(b) বিরুদ্ধ
(c) পাট
(d) তেনক
13. গীতগোবিন্দম্ গ্রন্থের ভাষ্য কী?
(a) সংস্কৃত
(b) পালি
(c) প্রাকৃত
(d) বাংলা
14. শ্রীকৃয়কীর্তন কাব্যের মোট পদসংখ্যা কত?
(a) ৪৮১
(b) ৪১৮
(c) ৮১৪
(d) ৪১৪
15. শ্রীকৃয়কীর্তন এর রাগরাগিণীর সংখ্যা কত?
(a) ২৮
(b) ৩২
(c) ২৫
(d) ৩৫
16. শ্রীকৃয়কীর্তন এর খণ্ডিত পুথিটি পাওয়া গিয়েছিল-
(a) বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামে
(b) নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে
(c) নদীয়া জেলার নবদ্বীপে
(d) মথুরার কৃল্পমন্দিরে
17. মাধব-কন্দলি কোন্ গ্রন্থের অনুবাদ-কাব্য রচনা করেন?
(a) রামায়ণ
(b) মহাভারত
(c) ভাগবৎ
(d) গীতগোবিন্দম্
18. 'লাচাড়ি' কীসের নাম?
(a) রাগ
(b) রাগিণী
(c) অঙ্গ
(d) ছন্দ।
19. পাণ্ডববিজয় পাঞ্চালিকা গ্রন্থের রচয়িতা হলেন-
(a) মাধব কন্দলি
(b) শংকর দেব
(c) পরমেশ্বর দাস
(d) জয়দেব গোস্বামী
20. পয়ার বা মহাপয়ার বা ত্রিপদী বা লাচাড়ি ছন্দে গাওয়া হত বলে রামায়ণ মহাকাব্যের অনুবাদ-কাব্যকে বলা হত-
(a) রামকথা
(b) শ্রীরামকীৰ্তন
(c) শ্রীরাম পদাবলি
(d) শ্রীরাম পাঁচালি
Long Question Answer
প্রশ্ন.1 সূচনা পর্ব থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বাংলা গানের ধারা সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তব়ঃ বাংলা গানের ক্রমবিবর্তনের ধারাটিকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথমটি প্রাচীন যুগ। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এই যুগ বহমান ছিল। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের সৃষ্ট 'চর্যাগীতি', কবি জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃয়কীর্তন ও বহু কবির রচিত বিভিন্ন 'মঙ্গলগীতি' এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। এই যুগটিকে আমরা বাংলা সংগীত সৃষ্টির 'আদিপর্ব' বলেও উল্লেখ করতে পারি। পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়ের সময়সীমা। বাংলা সাহিত্যের মতোই বাংলা গানে মধ্যযুগের সূচনাও চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে। এই পর্যায়ে নানক, কবির, তুলসীদাস, মীরাবাঈ প্রমুখের আবির্ভাব ও তাঁদের রচিত ভক্তিভাবনামূলক গান ও দোঁহাগুলি অনুবাদের মধ্যে দিয়ে বাংলা গানের
মধ্যপর্বটি সমৃদ্ধ হয়েছিল। বাংলা গানে আধুনিক যুগের সূচনা রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, নিধুবাবু, দাশরথি রায়, লালনফকির, হাসনরাজা প্রমুখের হাত ধরে হলেও কারও কারও মতে তা রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমেই ঘটেছিল। কারণ, রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী বেশিরভাগ গীতিকারই মূলত ভক্তিগীতি রচনা করেছিলেন। যদিও কবিওয়ালা এবং বাউল গোষ্ঠীর গীতিকারগণ তাঁদের সৃষ্টিতে মানুষকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী সময় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলামের গানে বিষয় হিসেবে মানবতা এবং দেশাত্মবোধই প্রধানত জায়গা পেয়েছে। এই পর্বের সময়সীমা মোটামুটিভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিস্তৃত। কবিওয়ালাপর্ব, বাউলগান, রবীন্দ্রপর্ব, স্বদেশিগান, স্বাধীনতার গান, স্বর্ণযুগের গান, গণসংগীত, লোকসংগীত, সিনেমার গান, উচ্চাঙ্গ বা ধ্রুপদি সংগীত, জীবনমুখী গান, বাংলা ব্যান্ডের গান ইত্যাদি বহুধা ধারায় প্রবাহিত আজকের বাংলা গান। ড. মহম্মদ শহীদুল্লাহ যাঁকে বঙ্গের আদিকবি বলে উল্লেখ করেছেন, সেই মীননাথ বা রহস্যেন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের হাতে পুষ্পিত পল্লবিত হয়ে আজকের এই উত্তর-আধুনিক বাংলা গানের ধারা সজীব এবং বৈচিত্র্যময়।
প্রশ্ন.2 বাংলা গানের আদিপর্ব সম্পর্কে যা জান লেখো।
উত্তব়ঃ সাধারণত চর্যাগীতিকে বাংলা গানের আদি নিদর্শন বলে ধরে নিলেও চর্যার আগেও বাংলায় সংগীতের চর্চা ছিল। গুপ্ত যুগে এবং পাল রাজত্বের উপস্থাপন করা হত উৎকর্ষ লাভওবা তার সাংগীতিক রূপ কেমন ছিল আজ তা জানা যায় না। বা বিভিন্ন খননকা যোয় নাগ বাদ্যযন্ত্রের নির্দশন থেকে তার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়। আনুমানিক অষ্টম থেকে শুরু করে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে চর্যাগীতির সাথে সাথে নাথগীতি, চাচুর ও হোলি নামক কতকগুলি গীতিরীতির প্রচলন বাংলা দেশে ছিল, যা বর্তমানে হারিয়ে গেছে। এ মুহূর্তে তাই চর্যাগীতিগুলিই বাংলা ভাষায় রচিত আদি বা প্রাচীনতম বাংলা গান। কবি জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দম্ সংস্কৃত ভাষায় লেখা হলেও ভাব, ভাষা, ছন্দ, প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কাছাকাছি। বৈয়ব পদাবলির কবি বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরামদাস প্রমুখের হাতে এই পর্বের বাংলা গান সমৃদ্ধ হয়েছিল। বেয়ব পদাবলি-পূর্ব যুগে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃয়কীর্তন বাংলা গানে সৌন্দর্য, লাবণ্য ও বৈচিত্র্য এনে দিয়েছিল। রাধাকৃয় প্রেমলীলা এই গানগুলির মূল উপজীব্য। এর পাশাপাশি বাংলা গানের যে ধারাটি আবহমানকাল বাংলার প্রাচীন জনজীবনকে মুগ্ধ করে রেখেছিল তা 'মঙ্গলগীতি'। মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, কালিকামঙ্গল প্রভৃতি কাব্যগুলি বিভিন্ন কবি তথা গীতিকারের হাতে ঐশ্বর্যমন্ডিত হয়ে ওঠে। বিজয়গুপ্ত, নারায়ণ দেব, কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তী, রূপরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র প্রমুখ এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও গীতিকার।
প্রশ্ন.2 বৈয়ব পদাবলীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাংলা কীর্তনগান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
উত্তব়ঃ 'কীর্তন'-এর উৎপত্তি সন্ধানে অনেকের মতে এর শিকড় রয়েছে বেদের 'অনুকীর্তন' নামক প্রার্থনাসংগীতের মধ্যে। জয়দেবের গীতগোবিন্দ-র সময় থেকে কীর্তনের সূচনা বলে দাবি করেছেন অনেকে। তবে চৈতন্যদেবই কীর্তন গানকে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
কীর্তন দুই ভাগে বিভক্ত-নামকীর্তন এবং লীলাকীর্তন। নামকীর্তনে চার বা আট প্রহর, কখনো চব্বিশ প্রহর ধরে শুধু ঈশ্বরের নাম সংকীর্তন করা হয়। বহু মানুষ বা ভক্তরা মিলিতভাবে নামগান করে থাকে। কৃষ্ণনাম বা কৃষ্ণের অষ্টোত্তরশতনামই সাধারণত গাওয়া হয়ে থাকে। নামকীর্তন যখন দলবদ্ধভাবে নগরের পথে পথে গাওয়া হয়, তাকে বলা হয় 'নগর কীর্তন'।
অন্যদিকে কৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা নিয়ে যে কীর্তনগান প্রচলিত তার নাম লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন। বাল্যলীলা, গোষ্ঠলীলা, পূর্বরাগ, রূপানুরাগ, অভিসার, মান, মাথুর ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে লীলাকীর্তন বিভক্ত। চৌষট্টি প্রকার রসের বিস্তার ঘটলেও মূল রস শৃঙ্গার বা মধুর। লীলাকীর্তনে একজন থাকেন মূল গায়েন। তিনি একটি লাইন গাওয়ার পরে কয়েকজন 'দোহার' সেই পংক্তিটি পুনরায় গেয়ে থাকেন। এই সকল কথার যোজনাকে বলা হয় 'অলংকার', 'আখর' বা 'কাটান'। কীর্তনের পাঁচটি অঙ্গ যথাক্রমে-কথা, দোঁহা, আখর, তুক ও ছুট।
শ্রীচৈতন্য শ্রীবৎসের গৃহে কীর্তন অনুষ্ঠান করতেন। নীলাচলে রথযাত্রায় চৈতন্য সাতটি সম্প্রদায়কে একত্রিত করে কীর্তন অনুষ্ঠান করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে খেতুরির মহোৎসবে নরোত্তম দাস ঠাকুরের পরিচালনায় গরানহাটি রীতির উদ্ভব হয়। পরে মনোহর দাস মনোহরশাহি রীতির প্রবর্তন করেন। রেনেটি ধারার উদ্ভাবন করেন বিপ্রদাস ঘোষ। এ ছাড়াও আরেক ধারা ছিলো মন্দারিনি ধারা।
হয়ে
কীর্তন গানে প্রত্যেক পালা শুরুর আগে সেই রস ও পর্যায়ের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে একটি করে গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ গেয়ে নেওয়া রীতি। এই পদগুলোকে বলা হয় গৌরচন্দ্রিকা। বিভিন্ন কালের উল্লেখযোগ্য কীর্তনীয়াগণ হলেন-কমলা ঝরিয়া, রাধারমণ কর্মকার, রাধারাণী দাসী, গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, নরোত্তম জানা, ললিতা দাসী প্রমুখ।
প্রশ্ন.4 বাংলা গানের ইতিহাসে কবিওয়ালাদের অবদান সম্পর্কে যা জান লেখো।
অথবা, বাংলা গানে কবিগানের গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তব়ঃ অষ্টাদশ শতকে নবাবি শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কালে বাংলা কবিগানের উদ্ভব, পুরোনো কলকাতার ধনী সম্প্রদায় ছিলেন এই গানের প্রধান ত্রাদি পৃষ্ঠপোষক। এক্ষেত্রে মহারাজা নবকৃয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কবিওয়ালাগণ দেবনির্ভরতা বা অলৌকিকতাকে তাঁদের সৃষ্টিতে বর্জন করেছিলেন। পরিবর্তে এনেছিলেন যুক্তি, মানবতাবাদ এবং বিভিন্ন সামাজিক বোধকে। তাঁরা আসরে দাঁড়িয়ে মুখে মুখে গান রচনা করতেন। বিপক্ষের সাথে ছন্দ এবং সুর বজায় রেখে চালিয়ে যেতেন 'কবির লড়াই'। আসরে উপস্থিত শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করা এবং নিজের তথা নিজের দলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা মূল করাই এই গানের মূল উদ্দেশ্য ছিল। আর তা করতে গিয়ে প্রায়শই ভাষা ব্যবহারে সংযম হারাতেন কবিয়ালরা। বেশিরভাগ কবিওয়ালাদেরই প্রথাগত শিক্ষাদীক্ষা বিশেষ না থাকলেও উপস্থিত বুদ্ধি, পুরাণ সম্পর্কে জ্ঞান, আর সংগীতে অসাধারণ দখল ছিল। ঢোল আর কাঁসি ছিল কবিগানের বাজনা।
এই ধারার প্রাচীনতম কবি গোঁজলা গুঁই। তিনি ভারতচন্দ্রের সমসাময়িক। তাঁর শিষ্য রঘুনাথ দাস। রঘুনাথের শিষ্যদের মধ্যে রাসু, নৃসিংহ ও হরু ঠাকুর কবিওয়ালা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। এই হরু ঠাকুরের শিষ্য ছিলেন ভোলাময়রা। অপর শিষ্য রামপ্রসাদ ঠাকুর। অনেকের মতে, কবিগানের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাধর ■ ছিলেন রামজির শিষ্য রাম বসু। তবে কবিওয়ালা হিসেবে সর্বাধিক জনপ্রিয় হয়েছিলেন অ্যান্টনি কবিয়াল। পশ্চিমবঙ্গ কবিগানের মূলকেন্দ্র হলেও পূর্ববঙ্গে এর অস্তিত্ব যথেষ্টই ছিল। মৈমনসিংহের রামু মালী, ফরিদপুরের নারায়ণ বালা, বরিশালের বিজয় দত্ত এবং গঙ্গমণি দাসী, ত্রিপুরার হরি আচার্য এবং বিলাসিনী দাসীর নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে ইংরেজি সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলার শ্রোতাদেরও রুচির পরিবর্তন ঘটে। বিলুপ্ত হয় কবিগানের ধারা।
প্রশ্ন.5 টপ্পা সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তব়ঃ উত্তর ভারতীয় রাগসংগীতে ধ্রুপদ, খেয়াল ও ঠুংরির সঙ্গে টপ্পাও একটি বিশিষ্ট শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। 'টপ্পা' শব্দের অর্থ লম্ফ। এর গতি এবং তান উল্লম্ফনযুক্ত হওয়াতেই এইরূপ নামকরণ বলে অনেকে মনে করেন। টপ্পার দুটি স্তবক বা তুক-স্থায়ী ও অন্তরা। এর সঙ্গে দ্রুত খেয়ালের গভীর সাদৃশ্য রয়েছে। টপ্পায় ভৈরবী, খাম্বাজ, দেশ, সিন্ধু, কাফি, ঝিঁঝিট, পিলু, বারোঁয়া প্রভৃতি রাগ ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত করুণরসাত্মক প্রণয়সংগীত।
বাংলায় অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে টপ্পার প্রচলন। রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু) বাংলা টপ্পার পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃত। তবে বাংলা টপ্পা সর্বতোভাবে পাঞ্জাবি টপ্পার অনুকরণ নয়। একে বাঙালির প্রকৃতি ও রুচি অনুযায়ী বিন্যাস করা হয়েছে। এতে দ্রুত তানের পরিবর্তে আন্দোলনযুক্ত তান ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলায় টপ্পার আবেদন অত্যন্ত মধুর ও গভীর। উনবিংশ শতাব্দীতে বহু সংগীতজ্ঞ সুললিত, অপূর্ব টপ্পা রচনা করে গেছেন। এঁদের মধ্যে রাধামোহন সেন, কালীমির্জা, শ্রীধর কথক, দাশরথি রায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও আগমনী গান, শ্যামাসংগীত, ভক্তিরসাশ্রিত গানে টপ্পার বিশেষ প্রভাব পড়েছে।
প্রশ্ন.6 যাত্রাগান সম্পর্কে যা জান আলোচনা করো।
উত্তব়ঃ বাংলা দেশে 'যাত্রাগান' এর উদ্ভব ষোড়শ শতাব্দীতে। 'যাত্রা' শব্দের অর্থ নির্বিঘ্নে দীর্ঘপথ অতিক্রম করা। বাংলা ভাষায় শব্দটির একটি বিশেষ যোগরুঢ় অর্থ দাঁড়িয়েছে-উৎসব-অনুষ্ঠানে কোনো গ্রথিত কথাবস্তুর গীত-নৃত্য-সংলাপ সহযোগে অভিনয়। বিশেষ এক মণ্ডপে সমবেত হয়ে দেব-মাহাত্ম্যমূলক সংগীত, নৃত্য ও নাট্য। তখন থেকেই যাত্রার পালাগানকে 'যাত্রা' বা 'যাত্রাগান' বলা হয়। পীতগোবিন্দম্ অনেকটা যাত্রাগানের আকারেই রচিত। শ্রীকৃয়কীর্তনও সেই যুগের কুন্নযাত্রা পালা। এ ছাড়া চন্ডীযাত্রা, মনসামঙ্গল, কংসবধ, যযাতি যজ্ঞ ইত্যাদি নিয়েও যাত্রাগান রচিত হয়েছে। কৃন্নযাত্রার রচয়িতা হিসেবে কৃয়কমল গোস্বামীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গোপাল উড়ে ও মধুসুদন কিন্নর যাত্রাগানের জগতে এখনও প্রসিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের গানেও যাত্রাগানের প্রভাব দেখা যায়। যাত্রাগানের মধ্যে সুসাহিত্যের উপাদান ও অভিজাত সংগীতের নিদর্শন লক্ষ করা যায়। সেই সময় সমাজে কুয়যাত্রা থেকে শুরু করে সবরকম যাত্রাগানই একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। জনচিত্তে তা গ্রহণযোগ্যও হয়েছিল। বর্তমানে আর যাত্রাগানের প্রচলন নেই।
প্রশ্ন.7 পক্ষীর গান সম্পর্কে যা জান আলোচনা করো।
উত্তব়ঃ ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে কলকাতায় নাচ-গানের আসরে সুকণ্ঠ গায়ক হিসেবে রূপচাঁদ পক্ষীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সংগীতরচয়িতা রূপচাঁদ শাস্ত্ররসাত্মক সংগীত এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক সংগীত সৃষ্টিতে সমান দক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত সমস্ত সংগীতই 'পক্ষী' বা 'খগরাজ' ভণিতাযুক্ত। তিনি 'পক্ষীর জাতিমালা' নামে শখের পাঁচালি দল তৈরি করেন। সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে তিনি গান বাঁধতেন। আগমনী-বিজয়গান, বাউলগান, দেহতত্ত্বের গান, টপ্পা গান রচনাতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর গানে বাংলা ও ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ ঘটেছে। তাঁর দলের সদস্যরা নানারকম পাখির স্বর অনুকরণ করে নিজ নিজ নাম গ্রহণ করতেন। তাই তাঁর দলকে 'পক্ষীর দল' বলা হয়। রূপচাঁদ খুবই আমোদপ্রিয় ও রসিক পুরুষ ছিলেন। 'পক্ষী' উপাধিকারী বলে তাঁর গাড়িটি কতকটা খাঁচার আকারের ছিল। তিনি সেই গাড়ি চড়ে শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাড়িতে উপস্থিত হতেন। তিনি প্রচুর সংগীত রচনা করেছেন। গঙ্গার পোল, রেল, বিধবাবিবাহ ইত্যাদি প্রসঙ্গেও তিনি সংগীত রচনা করেছেন। বাগবাজারের শিবকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এই দলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রূপচাঁদ জীবিত ছিলেন।
প্রশ্ন.8 'যাত্রা' শব্দের অর্থ ও যাত্রাপালার বিষয় ও ভাবের পরিচয় দাও।
উত্তব়ঃ 'যাত্রা' শব্দের মধ্যে দিয়ে সাধারণত শোভাযাত্রা বা মিছিলকে নির্দেশ করা হত। বিভিন্ন উৎসব ও পূজা-পার্বনের দিনে, গ্রাম অথবা নগরের একশ্রেণির নৃত্য-গীত জানা লোক সকলকে আনন্দ দেওয়ার জন্য রঙিন পোশাক-পরিচ্ছদ পরে বহু-বিচিত্র সমারোহে ও অঙ্গভঙ্গি করে পথে পথে ঘুরত। তাদের 'প্রদক্ষিণ' থেকেই 'যাত্রা' শব্দটি এসেছে বলে মনে করা হয়। এই প্রদক্ষিণ ও পরিক্রমার পথে দর্শকদের নাচ-গান-অভিনয় দেখানোই ছিল যাত্রার প্রধান উদ্দেশ্য। ক্রমে ঘুরে ঘুরে নাচ-গান-অভিনয় বন্ধ হয়ে আসর তৈরি হলেও তার নামটি 'যাত্রা'ই থেকে যায়। বিবিধ যাত্রাপালার মধ্যে চণ্ডীযাত্রা, কৃয়যাত্রা, ভাসানযাত্রা, মোনাই-যাত্রার নাম উল্লেখযোগ্য। কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত শ্রী শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে বিজয়াদশমী তিথিতে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের যাত্রাভিনয়ের বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। 'যাত্রা' লোকশিক্ষার উল্লেখযোগ্য মাধ্যমরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে। সামাজিক নীতি, আদর্শের প্রচারে যাত্রা তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে
গণজাগরণের লক্ষ্যে প্রস্তুত যাত্রাপালার মধ্যে মুকুন্দ দাসের রচনা ও অভিনয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রশ্ন.9 আধুনিক বাংলা গানের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরবর্তী সময়ের গীতিকারদের পরিচয় দাও।
উত্তব়ঃ আধুনিক বাংলা গানের পথপ্রদর্শক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তাঁর হাতেই বাংলা গান বাণী এবং সুরবৈচিত্র্যে মাধুর্যময় হয়ে ওঠে। তাঁর সমসাময়িক কালে গীতিকার হিসেবে আরও কয়েকজন কবি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৪-১৯১০), অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ-সহ এই পাঁচজন কবি-গীতিকারের সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বাংলা গানে আধুনিক পর্যায়ের সূত্রপাত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মূল বিষয় প্রেম, প্রকৃতি, পূজা ও স্বদেশ। মূলত এই চারটি পর্যায় অবলম্বনেই তিনি প্রায় হাজার দেড়েক কালজয়ী গান রচনা করেন।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রোধকে কেন্দ্র করে বাংলা দেশে স্বদেশি আন্দোলনের সূত্রপাত। এই ঐতিহাসিক ঘটনা উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেন 'বাংলার মাটি, বাংলার জল' গানটি। এই পর্বে দ্বিজেন্দ্রলাল লিখেছিলেন 'বঙ্গ আমার, জননী আমার'। রজনীকান্ত সেন ডাক দিলেন 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই'। অতুলপ্রসাদ সেন আশ্বাস দিলেন এই বলে-'বল বল বল সবে, শত বীণা বেণু রবে'। নজরুল ইসলাম গাইলেন মুক্তির গান-'কারার ঐ লৌহকপাট' অথবা 'এই শিকল পরা ছল মোদের এই.....'। তবে বিদ্রোহী কবি বলে পরিচিত নজরুলের একহাতে 'বাঁশের বাঁশরি' আর একহাতে 'রণতুর্য'। তাই তাঁর প্রেমের গানগুলিও অসাধারণ, যেমন-'মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দিব খোঁপায় তারার ফুল'। কবি-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রায় সমস্ত গানই রচনা করেছিলেন নাটকের প্রয়োজনে। তাঁর রচিত ঐতিহাসিক নাটকের গানগুলিতে দেশাত্মবোধ উৎসারিত। রজনীকান্ত সেনের সৃষ্ট গানগুলিকে বলা হয়ে থাকে 'কোমল-কান্ত পদাবলি'। তাঁর গানের প্রধান বিষয় ভক্তি ও দেশপ্রেম। গীতিকার অতুলপ্রসাদ সেন তাঁর গানে প্রেম, স্বদেশপ্রীতি এবং ভক্তি-এই তিনটি ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁর প্রেমের গানে বেদনা আর বিষাদের প্রাচুর্য। স্বদেশ পর্যায়ের গানে দেশামাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের আহ্বান। আর ভক্তি পর্যায়ের গানে আছে আত্মনিবেদনের রাগিণী। আধুনিক বাংলা গানের কিছুটা ভিন্নধারার গীতিকার চারণকবি মুকুন্দ দাস (১৮৭৮-১৯৩৪)। তিনি মূলত স্বদেশি গান রচনা করেন। যাত্রাগান রচনাতেও তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর গান বাঙালির মনে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে।
প্রশ্ন.10 বাংলা গণসংগীতের সূচনা কোন্ ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে? এই ধারার গীতিকার, সুরকার এবং গায়কদের সম্পর্কে লেখো।
অথবা, বাংলা গণসংগীতের ধারা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো। অথবা, 'গণসংগীত' বলতে কী বোঝ? বাংলা গণসংগীতের ধারাটি আলোচনা করো।
উত্তব়ঃ শোষক শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের যে সংগ্রাম সেখান থেকে উঠে আসা গানই গণসংগীত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে এই গান সোচ্চার। মানুষের
জীবনের দুঃখ, যন্ত্রণা দূর করে এক সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখায় এই গান। আমাদের দেশে 'গণসংগীত' শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছে চল্লিশের দশকের প্রথম দিক থেকে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথায়-"স্বাদেশিকতার ধারা যেখানে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার সাগরে গিয়ে মিশেছে, সেই মোহনায় গণসংগীতের জন্ম।” এই
গানের বিস্তার ঘটে খুব সহজেই। সাধারণ মানুষ এই গানের কথা আর সুরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে খুব সহজেই। শৃঙ্খলিত জীবন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগায় এই গান। চেনা সুরের নতুন প্রয়োগ তাই এ গানে যেমন আছে, তেমনি বিভিন্ন ধরনের সুরের ও গায়নভঙ্গির মিশ্রণও ঘটে এই গানে।
রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর এদেশে প্রলেতারীয় মতাদর্শের সূচনা হয়। অক্টোবর বিপ্লব কবি নজরুলকে সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯২৬ সালে কৃল্পনগরে 'নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে 'স্বরণীয় কৃষক ও শ্রমিকদল' তৈরি হয়। সৃষ্টি হতে থাকে মানুষের প্রতিবাদের গান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনাকালে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকাতেই গণসংগীতের জোয়ার আসে।
এই ধারার জনপ্রিয় গীতিকার এবং সুরকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-রমেন শীল, মুকুন্দ দাস, নজরুল ইসলাম, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নিবারণ পণ্ডিত, দিনেশ দাশ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সাধন দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। গণসংগীত যাঁদের কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তাঁরা হলেন-মুকুন্দ দাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, সবিতারত দত্ত, অজিত পাণ্ডে, রুমা গুহঠাকুরতা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রতুল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
Editing By -- Liza Mahanta